অবহেলায় দণ্ডায়মান বাংলার প্রথম চৈনিক উপনিবেশ আছিপুরের নিদর্শন বারুদ ঘর
বুকের মধ্যে বারুদ জমিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত চেহারা নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছিপুরের বারুদ ঘর। দুই শতাব্দী প্রাচীন এই বারুদ ঘর তার স্মৃতিতে সাক্ষী রেখেছে অনেক অজানা ইতিহাস। আছিপুরের নাম অনেকেই হয়তো জানেন বা অনেকেই জানেন না। কলকাতা থেকে ৩৩ কিমি দক্ষিণে বজবজের কাছে হুগলি নদীর তীরে একটি শান্ত ছোট্ট গ্রাম হলো আছিপুর। আমরা ব্রিটিশদের আগমনের পূর্বে ফরাসি, পর্তুগীজ উপনিবেশ স্থাপনের গল্প শুনেছি কিন্তু বাংলাতে চিনা উপনিবেশ স্থাপনের গল্প শুনেছেন কী? নিশ্চয় শোনেন নি। দেশের প্রথম চীনা ঔপনিবেশিক কেন্দ্র হলো আছিপুর৷ চীনা বসতি স্থাপনকারী ব্যক্তি টং আছুর নামানুসারে জায়গাটির নাম রাখা হয় আছিপুর৷
ঐতিহাসিকদের মতে আঠারো শতাব্দীর শেষের দিকে অর্থাৎ ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে টং আছু নামে একজন চৈনিক চা ব্যবসায়ী হুগলির তীরে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। আছুর নজর কলকাতায় পড়েনি, গঙ্গাতীরে বজবজের ছয় মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে এক অচেনা জায়গা তার পছন্দ হয়। সবুজ সুজলা-সুফলা জমি, নির্জন প্রান্তর, খোলা মাঠ মন ভরিয়ে দেয় আছুর৷ তিনি এখানে নগর পত্তনের কথা চিন্তা করতে থাকেন৷ যদিও সেই চিন্তা ত্যাগ করে তিনি ব্রিটিশদের সাথে জমিয়ে ব্যবসা ফাঁদলেন। রপ্তানির প্রধান পণ্য হয়ে ওঠে আফিম৷
পলাশী যুদ্ধের পর চৈনিকদের সাথে ব্রিটিশদের ব্যবসা জমে ওঠে। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিং জেমস ফিল্টন সাহেবের সুপারিশে আছুকে একটি জমি পাট্টা দেন। খাজনা হিসেবে বার্ষিক ৪৫ টাকা ধার্য করা হয়। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেকর্ড অনুসারে প্রায় ৫৬০ বিঘা ফসলি জমি দেওয়া হয়েছিল আছুকে। চৈনিক-ব্রিটিশ ব্যবসায়ীক ঐক্যের স্বার্থে হেস্টিংস এই জমি আছুকে দত্তক দিয়েছিলেন৷ প্রাপ্ত জমির আকার ছিল অনেকটা অশ্বক্ষুরাকৃতি আকৃতির। আখের আবাদ ও চিনির কল স্থাপনের জন্য এই জমি প্রদান করা হয়েছিল৷
জমি অধিগ্রহণের পর আছু একটি চিনির কলের সাথে একটি বেতের বাগান স্থাপন করেন। তিনি তার বৃক্ষরোপণ ও কারখানায় কাজ করার জন্য ১১০ জন চৈনিক শ্রমিক নিয়ে আসেন। এভাবেই ভারতে প্রথম চৈনিক বসতি স্থাপিত হয়।
কলকাতায় বসবাসরত প্রতিটি চৈনিক মানুষ প্রতি বছর আছুকে শ্রদ্ধা জানাতে আছিপুরে তীর্থযাত্রা করে। ভারতের প্রথম সরকারি চীনা বসতি হিসাবে পরিচিত আছিপুরের আকর্ষণীয় ইতিহাস হলো বারুদ ঘর। যা রীত্যনুসারে আছিপুর পাউডার ম্যাগাজিন নামে পরিচিত।
বন্দুক পাচার বহনকারী ব্রিটিশদের জাহাজগুলো হুগলি নদীর তীরে বারুদ সংগ্রহের জন্য ভিড় করতো। জাহাজগুলিকে জরুরি কল এবং সিগন্যালিংয়ের জন্য কেবল ১০০ পাউন্ড গান পাউডার বহন করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। জাহাজগুলি তাদের ফেরার যাত্রার সময়, জাহাজগুলো এই বারুদ ঘর থেকে আমানত সংগ্রহ করতো৷
বেঙ্গল জেলা গেজেটিয়ার্স অনুসারে গান পাউডার সংগ্রহের জন্য কয়েকটি বিধি অবলম্বনের ব্যবস্থা রাখা হয়৷ কেবল ১০০ পাউন্ড গান পাউডারই যে-কোনো জাহাজকে নিতে হবে৷ ১০০ পাউন্ডের বেশি গান পাউডার নিলে জরিমানা করা হতো। পরিমাণের থেকে বেশি বারুদ নিলে বিশাল আকারের বন্দুকের বোর্ডে বিস্ফোরণ ঘটার সম্ভাবনা থাকে। জাহাজে বিস্ফোরণ ঘটলে বন্দর ও শহর দুইই অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারে৷ তাই এই বিধিমালা সকলকেই মানতে বাধ্য করা হতো৷
বারুদ ঘরটির চারপাশ পাঁচিল দ্বারা আবৃত ছিল। মাঝখানে একটি ছোটো ঘর আর তার দুই পাশে দুটো বড় ঘর। ঘরগুলোর বাইরে চার কোণে চারটি গার্ড হাউস নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে এই পাঁচিলগুলো আর নেই৷ শুধু পড়ে রয়েছে একটি মরাগাছ ও তিনটি ভাঙ্গা গার্ড হাউস। ঘরগুলোর বক্ষ চিরে বেরিয়ে এসেছে আগাছার জঙ্গল। ঘরগুলোর পাশে অযত্নে পড়ে রয়েছে একটি খা খা করা সবুজ মাঠ। আছিপুরের বারুদ ঘর আজকে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত জায়গাতে পরিণত হয়েছে। এখন এই বারুদ ঘর ঐতিহাসিক ক্ষতচিহ্ন নিয়ে একা একা নির্জনতাকে সঙ্গী করে দণ্ডায়মান।
তথ্যসূত্র- আমাদের বজবজ ও রঙ্গন দত্ত ব্লগ
Post a Comment