Header Ads

লোধা শবর সম্প্রদায়ের প্রথম মহিলা স্নাতককে বর্ণবৈষম্য আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেয়


কালো চামড়ার মানুষের ওপর সাদা চামড়ার মানুষের বিদ্বেষ, তথাকথিত উঁচু জাতের দ্বারা তথাকথিত নীচু জাতের মানুষদের ওপর পাশবিক নির্যাতন শতাব্দীর পর শতাব্দী ঘটে চলেছে। বর্ণবিদ্বেষের স্বীকার কখনো আমেরিকা, কখনো আফ্রিকা, কখনো ভারত। আফ্রিকার কালো মানুষদের সাদা মানুষদের লড়াইয়ের কথা আমরা সকলেই জানি। ভারতের মাটিতে শূদ্রদের ওপর মধ্যযুগে বর্বরতা চালানোর ঘটনাও সকলের জানা৷ সেসব এখন ইতিহাস। তবে বর্ণবিদ্বেষ বর্তমানেও কোনো অংশে কম নেই। উত্তর ভারতে তথাকথিত উচ্চ বর্ণের মানুষেরা দলিতদের ওপর এই যুগেও নৃশংস ভাবে অত্যাচার চালায়। সম্প্রতি আমেরিকাতে এক সাদা চামড়ার পুলিশ জর্জ ফ্লয়েড নামের একজন কালো চামড়ার মানুষকে বিনা দোষে মেরা ফেলার বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠে গোটা পৃথিবী। বর্ণবিদ্বেষের ঘটনায় বাদ যায়নি আমাদের রাজ্যও। এ রাজ্যেও তথাকথিত নীচু জাতিদের ওপর অত্যাচার করা হতো চল্লিশ বছর আগেও ৷


আজ থেকে চল্লিশ বছর পূর্বে তথাকথিত নীচু জাতির কয়েকটি বিশেষ সম্প্রদায় মূলত দলিত, শবর ও কোটালদের সরকারের দ্বারা শিক্ষা-দীক্ষা, পুঁজি, চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হতো বাংলার বিভিন্ন জায়গাতে। বামুনদের পুকুর কিংবা কুয়োতে জল স্পর্শ করলে তাঁকে গণধোলাই দেওয়া হতো৷ ধর্মীয় স্থানে উঠতে দেওয়া হতো না। এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও পড়াশোনা করে সমাজে মাথা তুলে বাঁচতে চেয়েছিল কোটাল সম্প্রদায়ের সেই মেধাবী মেয়েটা। কিন্তু তৎকালীন রাজ্য সরকারের তার প্রতি অশালীনতা তাকে ঠেলে দিয়েছিল মৃত্যুর মুখে।


মেদিনীপুর জেলার বর্তমান ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার একটি বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে বসবাস করেন লোধা শবর সম্প্রদায়ের মানুষ। দারিদ্রতা, তথাকথিত উচ্চ বর্ণের মানুষদের বৈষম্য ও অনুন্নয়নের কারণে শবর সম্প্রদায়ের মানুষকে আজও লড়াই করতে হয়। বর্তমানে এই অঞ্চলের দারিদ্রতা অনেকটাই কমে গেছে। তবে আশির দশকে এই সমস্ত মানুষকে দুবেলা ভাত ও সামাজিক বঞ্চনার সাথে লড়াই করতে হত প্রতিদিন। 

মেয়েদের ক্ষেত্রে তো জুটত আরো বেশি লাঞ্ছনা। স্কুলে যেতে দেওয়া হতনা, খুব কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হত। বিদ্যালয়ে গেলে বিভিন্ন ভাবে অপদস্থ হতে হতো শিক্ষক ও তথাকথিত উচ্চ বর্ণের ছাত্রছাত্রীর কাছ থেকে। বিভিন্ন ভাবে মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে হত। দলিত সম্প্রদায়ের হওয়ায় বিদ্যালয়ে গেলে বলা হত- ‘তোরাও লেখাপড়া করবি?’ 

যদিও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ লড়াই করেছেন দাঁতে দাঁত কামড়ে। বর্তমানে শিক্ষার হার বেড়েছে, সার্বিক ভাবে এনাদের উন্নয়নও হয়েছে কিন্তু সেই সময়গুলো আজও আমাদের সভ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এরকমই একজন মেয়ের বেড়ে ওঠার গল্প নিয়ে লিখছি।

চুনি কোটাল হলেন লোধা শবর সম্প্রদায়ের প্রথম মহিলা স্নাতক। যিনি ১৯৮৫ সালে স্নাতক হন। তিনি ১৯৬৫ সালে পশ্চিম মেদিনীপুরের গোয়ালডিহি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অভাবের কারণে শৈশবে মাঠে কাজও করতে হতো, প্রায়ই অনাহারে থাকতেও হতো তাঁদের। টাকার অভাবে বই কিনতে পারতেন না, তার মধ্যেই পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন চুনি কোটাল। বঞ্চনা, লাঞ্ছনা, দারিদ্রতার সাথে লড়াই করে তিনিই লোধা শবর সম্প্রদায়ের প্রথম মেয়ে যিনি উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। তারপর তিনি বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিদ্যায় স্নাতক হন। কলেজের সাথে সাথে তিনি  ইন্টিগ্রেটেড ট্রাইবাল ডেভেলাপমেন্টের ঝাড়গ্রাম অফিসে সামাজিক কর্মী হিসেবে কাজ করতেন। এই সময় তিনি উপজাতি অধ্যুষিত গ্রামে প্রচুর পরিমাণে সার্ভে করেন তাদের উন্নয়নের জন্য।

স্নাতক হওয়ার দুই বছর পর চুনি কোটাল মেদিনীপুর শহরের রাণী শিরোমণি এস.সি. এবং এস.টি. গার্লস হোস্টেলের সুপারিন্টেনডেন্ট হিসেবে নিযুক্ত হন। এখানেও তিনি অত্যন্ত অমানবিক ও অস্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশের সন্মুখীন হন।হোস্টেলের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিয়ে তিনি উচ্চপদস্থ অফিসারদের জানালেও কোনো কাজ হত না বরং ওনার কাস্ট নিয়ে আক্রমণ করা হত এবং ওনাকে বিভিন্ন কটু কথা শুনতে হত। হোস্টেলের পরিবেশের উন্নয়নে সাহায্য করা তো দূর, ওনাকে সপ্তাহের ৭ দিন-ই কাজ করতে বাধ্য করা হত। ২ থেকে ৩ ঘন্টার জন্য বাইরে গেলেও অনুমতি নিতে হত এবং অনেক কথার জবাবদিহি করতে হত। তিনি হোস্টেলের অবস্থা ফেরানোর জন্য রাইটার্স বিল্ডিং এ বারংবার চিঠি লেখেন কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। এই হোস্টেলটি খোলা হয়েছিল উপজাতি এবং দলিত শ্রেণির উন্নয়নে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে অবহেলায় ফেলে রাখা হত এই হোস্টেলকে। মেদিনীপুর হাসপাতালে বেড না থাকায় একবার চুনি কোটালের অসুস্থ বাবাকে ওনার নিজের হোস্টেল কক্ষে থাকতে হয়েছিল। যে কারণে একজন উচ্চপদস্থ অফিসার জেলা সদরের অফিসে ওনার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন যে তিনি নাকি হোস্টেলের মধ্যে পুরুষের সাথে ফুর্তি করায় ব্যস্ত ছিলেন। যে কারণে ওনাকে প্রচন্ড পরিমাণে অপমান করা হয়। উনি সব কিছু বলা সত্বেও কোনোরকম সহানুভূতি দেখানো হয়নি।

এর পর তিনি নৃবিদ্যায় এম.এস.সির জন্য বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি পড়ার জন্য হোস্টেল ছেড়ে দেন যে কারণে জেলা সদরের বিভিন্ন অফিসার বার বার তাঁর উপর চাপ দিতে থাকে এবং হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়। কিন্তু বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি তথাকথিত উচ্চবর্ণের অধ্যাপক ও কলেজ কর্তৃপক্ষের দ্বারা বিভিন্ন ভাবে অত্যাচারিত হন। ওনার কাস্ট নিয়ে বারবারই আক্রমণ করতেন অধ্যাপকরা। এমনকি তিনি প্রতিদিন ক্লাসে উপস্থিত থাকা সত্বেও ওনাকে অনুপস্থিত দেখানো হত। যে কারণে তাঁর উপস্থিতির হার খুব কম হয়ে যায় এবং ওনাকে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হবেনা বলা হয়। উনি অনেক কাকুতি মিনতি করে পরীক্ষায় বসার অনুমতি পান। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা তিনি প্রশ্নের উত্তর সঠিক লেখা সত্বেও খুব কম নাম্বার দেন। দ্বিতীয় বর্ষেও একই জিনিস করা হয়। এই বছর তো আবার ওনাকে পরীক্ষায় বসতেই দেওয়া হয়নি যার ফলে ওনার দুটি বছর নষ্ট হয়। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাল্গুনী চক্রবর্তী প্রথম দিন থেকেই ওনাকে নীচু চোখে দেখতেন। শুধুমাত্র দলিত হওয়ার কারণে তিনি স্নাতকোত্তর লাভ করতে পারেননি। তিনি ফাল্গুনী চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে বার বার অভিযোগ দায়ের করেছিলেন কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। ফাল্গুনী চক্রবর্তী বারবার ওনাকে উপজাতি, ‘ক্রিমিনাল’ এই সব বলে অপমান করতেন। নীচু জাত তাই কোনো পড়ার অধিকার নেই, এরকম বলে অপমান করা হতো।

অবশেষে এ ঘটনা জানাজানি হলে প্রচণ্ড চাপের মুখে ১৯৯১ সালে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশে তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। কিন্তু কমিশন হয়েছিল নামমাত্র, কিছুই ব্যবস্থা নেয়নি কমিশন। যার ফলে তিনি কমিশন ও প্রশাসন সবের প্রতিই আস্থা ছেড়ে দিয়েছিলেন। ১৯৯২ সালের ১৩ ই আগস্ট একটি সেমিনারে ফাল্গুনী চক্রবর্তী আবার সকলের সামনেই তার সাথে অপব্যবহার করেন। মহাশ্বেতা দেবী সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন যে কারণে তিনি এগিয়ে আসেন ও চুনি কোটালের সাথে কথা বলেন এবং ওনার সমস্ত অভিযোগ জানেন। তিনি চুনি কোটালের সহপাঠিদের সাথে কথা বলে সব কিছু প্রকাশ্যে আনেন। কিন্তু এই অপমান সহ্য করতে পারেননি চুনি কোটাল। তাই তিনি এই সেমিনারের দুদিন পর ১৬ ই আগস্ট আত্মহত্যা করেন। লোধা শবর কমিউনিটির একটি উজ্বল নক্ষত্র এভাবেই ঝরে পড়ে অকালে।

সরকার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত তদন্ত কমিশন ওনার মৃত্যুর তিন দিন পর রিপোর্ট পেশ করে। ওনার এই মৃত্যু পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি বিদেশেও আলোড়ন তুলেছিল। চুনীর মৃত্যুর পর সমগ্র লোধা শবর, ওরাঁও, সাঁওতাল জাতি এক হয়ে এ ঘটনার প্রতিবাদ করে। বেঙ্গল দলিত সাহিত্য সংস্থা কলকাতায় পথে ঘাটে আন্দোলন করে, পথনাটক ও সেমিনারের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানায়। এ ঘটনা সারা রাজ্যে মানবাধিকার নিয়ে প্রচন্ড ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। ১৯৯৩ থেকেই বেঙ্গল দলিত সাহিত্য সংস্থা প্রতি বছর কলকাতায় চুনি কোটালের স্মৃতিতে সেমিনার আয়োজন করে থাকে। তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে ও লোধা-শবর সম্প্রদায়ের সামাজিক মানোন্নয়নের জন্য 'চুনী কোটাল স্মৃতি সম্মাননা' প্রদান করা হয়। 

মহাশ্বেতা দেবীর পাশাপাশি গৌরকিশোর ঘোষ, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলার প্রফেসর নিকোলাস বি. ডির্কস, আমস্টারডার্ম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জান ব্রিমানও এই ঘটনার প্রতিবাদ করেছিলেন। মহাশ্বেতা দেবী এ ঘটনা নিয়ে আক্ষেপ করে বলেছেন- ‘চুনি কোটালের আত্মহত্যা বাম সরকারের বর্ণভেদ, নিপীড়ন এবং অনুভূতিহীন অযত্নের মুখোশ খুলে দেয়।’ 


তথ্যসূত্র- ফেমিনিজম ইন্ডিয়া, ওয়েব্যাক মেশিন আর্কাইভ

No comments