জীবনদীপ নিভে গেল বাংলা যাত্রাপালার অতন্দ্র প্রহরী অভিনেতা ত্রিদিব ঘোষের
যাত্রাপালার এক যুগের যবনিকা পতন। প্রয়াত হলেন যাত্রা সম্রাট ত্রিদিব ঘোষ। বাংলার যাত্রাপালা জগতের এক জ্বলন্ত তারকা ছিলেন তিনি৷ গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে শুরু করে শহরের বিভিন্ন জায়গায় যাত্রাতে সাড়া ফেলে দিয়েছিল তাঁর অভিনয়। তিনি মূলত ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করেন৷ গলার কণ্ঠস্বর থেকে তেজ কাঁপিয়ে দিতো যাত্রার মঞ্চ। কেবল যাত্রায় নয়, চলচ্চিত্রেও তাঁর অভিনয় মুগ্ধ করেছিল আমজনতাকে৷ তাঁর প্রয়াণে শোকস্তব্ধ হয়ে ওঠে চিৎপুর যাত্রা পাড়া। গ্রাম-বাংলা জুড়ে তিনি পেয়েছিলেন আকাশছোঁয়া সাফল্য।
'সম্রাট ঔরঙ্গজেব', 'মা বিক্রির মামলা', 'নটি বিনোদিনী', 'নরকের হেডমাস্টার', 'মৃত্যু যজ্ঞের পুরোহিত','আজকের মীরজাফর', 'কালকেউটের ছোবল', 'উলঙ্গ সম্রাট', 'হাটে-বাজারে', 'বুনো ওল বাঘা তেঁতুল','পালা', 'কাশ্মিরী কলি', 'কসাইখানা কাণ্ডারী'র মতো বহু চর্চিত যাত্রাপালার মাধ্যমে তিনি তিন দশক ধরে যাত্রায় অভিনয় করে সবার নজর কেড়েছেন৷ প্রখ্যাত অভিনেতা ভানু বন্দোপাধ্যায়ের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন তিনি৷ নায়ক, খলনায়ক, পরিচালক, দলমালিক প্রতিটি ভূমিকায় স্বমহিমায় তিনি বিদ্যমান ছিলেন।
একটা সময় ছিল যখন প্রতিটি মরসুমে যাত্রার রমরমা ছিল। গ্রাম-বাংলাতে উপচে পড়তো ভিড়। দূর দূরান্ত থেকে বহু মানুষ বাস ও গাড়ি ভাড়া করে যাত্রাপালা দেখতে আসতেন৷ চিনেবাদাম, ঝালমুড়ি, লজেন্স খেতে খেতে যাত্রাপালার স্বাদ উপভোগ করতো সকলে। এককালে বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল যাত্রাপালা। বিশাল সার্কাসের মতো প্যান্ডেলে ত্রিপলের ওপর মাটিতে বসে, চেয়ারে বসে সকলে যাত্রাপালা উপভোগ করতো। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এক জায়গাতে সমবেত হয়ে এক সামাজিক মিলন উৎসবে মেতে উঠতো। বিভিন্ন নামীদামী কোম্পানির যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হতো। যাত্রাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে অসংখ্য যাত্রা কোম্পানি। নট্য কোম্পানি, নেপাল সরকার, মুক্তমঞ্জরীর যাত্রাপালার গুরুত্ব ছিল সবার ওপরে। এদের যাত্রা মানেই একটা শিহরণ জাগানো রাত্রি। আর ত্রিদিব ঘোষের যাত্রা ছিল অন্য মাত্রার।
তাঁর যাত্রাজীবন শুরু হয় চিত্তরঞ্জন অপেরা দিয়ে। তারপর নট্য কোম্পানি, ভারতী অপেরা, অগ্রগামী অপেরা, লোকনাট্য অপেরা, গানবনী অপেরা, নটরাজ অপেরার মতো স্বনামধন্য অপেরায় তিনি অভিনয় করেন৷ বাংলা ছবিতেও তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। 'আশ্রয়', 'আত্মীয় স্বজন', 'বাহাদুর', 'শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ' এর মতো হিট ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। তাঁর হাত ধরে বাংলা যাত্রাজগতে স্বর্ণযুগের সূচনা হয়েছিল৷ বাংলা যাত্রাজগতকে টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি প্রাণপণে লড়াই চালিয়ে গেছেন। গ্রাম-বাংলাতে সময়ের সাথে সাথে যাত্রাপালা প্রায় উঠেই গেছে বলা যায়। কিন্তু এই কঠিন সময়ে দাঁড়িয়েও যেখানে অন্যান্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের যাত্রাপালা চলছে না, সেখানে তিনি একাই যাত্রা করে জনসমাগম ঘটাতেন। যাত্রাপালা তাঁকে কখনো ক্লান্ত করেনি৷ যাত্রাপালাকে ঘিরে একবুক স্বপ্ন দেখতেন তিনি৷
দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে তিনি সাফল্যের সাথে একচেটিয়া যাত্রাতে অভিনয় করে গেছেন৷ যাত্রাপালা বদলে দিয়েছিল তাঁর জীবনচিত্র। যাত্রাপালা যেন তাঁর প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল৷ বাংলার যাত্রা পাড়ায় অন্যতম বড় দল নট্য কোম্পানিতে তাঁর চার ভাই ও তিন বোন এখনও কাজ করেন। বলা চলে তিনি ছিলেন বাংলা যাত্রাজগতের এক অতন্দ্র প্রহরী৷ গত সোমবার ২৯ শে জুন সকালে ৬৮ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে জীবনাবসান ঘটলো তাঁর। বাংলার যাত্রাজগতে তাঁর মৃত্যুতে এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তাঁর চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছেন না নাট্য ও যাত্রাপ্রেমী মানুষেরা৷ আর কী কোনোদিন যাত্রাতে এমন মানুষ আসবে? যাত্রাপালা কী আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? এরকম অজস্র জটিল প্রশ্নে বিভোর হতে হচ্ছে যাত্রাপ্রেমী বাঙালি মানুষদের৷ যে মানুষটি সেদিনও মঞ্চে জীবনের শেষ সময়ে দাঁড়িয়ে চুটিয়ে যাত্রা করছিলেন। গত বছর 'উলঙ্গ সম্রাট' যাত্রার ২০ টি শো করেছিলেন তিনি৷ তারপর হঠাৎ করেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাড়িতে শয্যাশায়ী হয়ে দিন কাটতে থাকে তাঁর। এরপর গত সোমবার চিরঘুমে আছন্ন হলেন তিনি। রেখে গেলেন যাত্রাপালার বহু স্মৃতি।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment