বাংলা গানকে কোণঠাসা করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক সঙ্গীতশিল্পী শিলাজিৎ ও সিধু
বাংলার ভৌগোলিক পরিবেশের জন্য বাঙালিরা হয়ে উঠেছে সৃষ্টিমুখর। সেই সৃষ্টির প্রকাশ ঘটেছে সুর সৃষ্টিতে, সংগীতে। বাঙালির এক মৌলিক চাহিদা হলো সংগীত, বাঙালির আবেগকে ধারণ করার এক আশ্রয়ও বটে। কথা-সুর-ছন্দ-তালের স্তিমিত মিশ্রণে গড়ে ওঠে সংগীত৷ বাঙালির নিজস্ব সঙ্গীত হলো তার মাতৃভাষা বাংলার গান। বাঙালির মাতৃভাষা বাংলার গান বহুধা বিস্তৃত৷ বাংলা গানের প্রসার গোটা বিশ্বজুড়েই৷ বাংলা গান নদীর উপনদী ও শাখা-প্রশাখার মতো নানান ধারাতে বিভক্ত৷ বাংলাতে কত রকমের গান। লোকসঙ্গীত, বাউল, ঠুমরি, টপ্পা, ভাওয়াইল, ঝুমৈর, পাঁচালি, কবিগান, ধামাইল, ধ্রুপদী, খেয়াল, রামপ্রসাদী, সুফি, বিষ্ণুপুর ঘরানা, বাংলা মার্গসংগীত, রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল গীতি, অতুলপ্রসাদী, আধুনিক গান, বাংলা ব্যান্ড তালিকার যেন শেষ নেই।
বাংলা গানের এক গৌরবময় ইতিহাস লুকিয়ে আছে। বাংলা গান এতোটাই শক্তিশালী যে সূদুর পর্তুগাল থেকে এদেশে আসা পর্তুগীজ কবি ও সঙ্গীতশিল্পী অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি বাংলা গানের টানে বাংলা ভাষা শিখেছিলেন৷ বাংলা ভাষার মধ্যযুগ থেকে আজকের যুগ পর্যন্ত কত শত মহান শিল্পী বাংলা গান তৈরি করে সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা গানকে। সারা বিশ্বের মধ্যে বাংলা গানের এক অমূল্য ভাণ্ডার সঞ্চিত আছে। সেকেলের বাংলা ছায়াছবির গান অথবা মৌলিক গান বেতারের মাধ্যমে সকল বাঙালির কানে কানে পৌঁছে যেত৷ হৈমন্তী শুক্লা, নির্মলা মিশ্র, বনশ্রী সেনগুপ্ত, কালিকা প্রসাদ ভট্টাচার্য, স্বপন বসুর মতো কিংবদন্তি শিল্পীরা বেতারের মাধ্যমে পরিচিত হন৷
বাংলা গানের ধারা নদীর মতো প্রবাহমান। পুরানো প্রজন্ম বলুন আর নতুন প্রজন্ম বলুন, নিত্যনৈমিত্তিক বাংলা গান তৈরি একেবারেই থেমে নেই। কিন্তু সময় বদলে গেছে নাকি সময়কে বদলানো হয়েছে জানেন না কেউই। বাংলার বেতারগুলোতে বাংলা গানের রমরমা এখন আর নেই৷ সেদিনের বেতার আজকের এফএমে পরিণত হয়েছে যেখানে বাঙালি শিল্পীদের চক্রব্যূহে ঘিরে ধরে বাংলা গানের সর্বনাশ ঘটানোর চেষ্টা চালাচ্ছে ভিন রাজ্যের পুঁজিপতিরা৷ বাংলা গান এক পা এক পা তার নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম হারাতে থাকছে।
গত দশ বছরে এফএমে বাংলা গানকে কোণঠাসা করে দেওয়া হয়েছে। এর পিছনে কাজ করেছে বিশাল এক স্বার্থান্বেষী অবাঙালি পুঁজিদারদের আর্থিক দম্ভ। তাদের মুখোশ খুলে দিতে ও এফএমে বাংলা গানকে তার সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে আন্দোলনে শিল্পীদের নিয়ে রণক্ষেত্রে অগ্রসর বাংলা শিল্পী পক্ষ৷ এই আন্দোলনে এবার সাড়া দিলেন সঙ্গীত শিল্পী শিলাজিৎ ও ক্যাকটাসের সিধু।
সঙ্গীত শিল্পী শিলাজিৎ নিজের ফেসবুক পেজে একটি পোস্টের মাধ্যমে উগরে দিয়ে লিখেন "গানের কোম্পানি ন্যায্য পাওনা পয়সা দেবে না। টেলিভিশন বলবে কম পয়সা তে কাজ !! তা ও কবে পেমেন্ট পাবে তার নেই ঠিক। রেডিও তো বাংলা গান বাজায় ই না; পয়সার কথা তো দূরের, প্রোগ্ৰাম অর্গানাইজার বলবে পয়সা নেই। লাখ লাখ নাকি ভক্ত? তার মধ্যে অর্থ দিয়ে গান শুনতে চায় এরকম শ্রোতার সংখ্যা হাতে গোনা, তার ওপরে খাঁড়ার ঘা? আমার গান অনলাইন লাইভে গাইতে নাকি পয়সা দিয়ে গাইতে হবে??? আমার গান...আমার বাপের ও না। যে ক'জন পয়সা দিয়ে শুনবে, তাদের জন্য গেয়ে যা পাব তাতেই পেট চালাব। দেখি কে আটকায়? আরও কতগুলো বলিউডের অভিনেতাদের মতো খবর তৈরি করতে তারা প্ররোচনা দিতে চাইছেন, সাবধান!! শিল্পীদের পেটে লাথি মারার পরিকল্পনা থেকে দূরে থাকুন। সব শিল্পীরা দুর্বল নয়। আগুন জ্বলে যাবে।"
অন্যদিকে সঙ্গীত শিল্পী সিধু ভিডিও বার্তা দিয়ে বলেন "এটা খুবই নিষ্ঠুর সত্যি যে রেডিও সেভাবে বাংলা গান একদমই প্রমোট করে না। রেডিওতে যেটুকু বাংলা গান বাজে তাতে শুধুমাত্র ফিল্মের গান চলে। কিন্তু ফিল্মের গান বাদেও যে ননফিল্মি গান কিংবা আধুনিক গান চিরকাল ই বাঙালির ঐতিহ্যের একটা অঙ্গ ছিল। এটা আজকের কথা নয়। এটা গত ষাট থেকে সত্তর বছরের কথা যে তখন ফিল্মের পাশাপাশি ননফিল্মের একটা আলাদা জায়গা ছিল, শ্রোতাও ছিল। সেটাকে অঙ্ক কষে কমিয়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা চলছে৷ যেটা একদমই শুভ লক্ষ্মণ নয়। আমি কাউকে বাদ দেওয়ার কথা বলছি না। কাউকে বাদ দিয়ে আমাকে নাও, আমার মিউজিককে নাও। আমাদের মিউজিককে নাও যারা ননফিল্মি ক্যাটাগরিতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে চলেছি। সবাই সহাবস্থান করুক। যদি সেগুলো না হতো তাহলে এই বক্তব্য আজকে রাখতে হতো না।
ননফিল্মি ক্যাটাগরির একটা শক্তিশালী প্রশাখা হলো ব্যান্ড, আমাদেরকে কিন্তু এখন চেপে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। এফএম চ্যানেলগুলোকে নালিশ করলে বলে আমাদের হেড অফিস বম্বেতে, আমাদের হেডঅফিস দিল্লিতে। সেখান থেকে যা নির্দেশিকা আসে আমরা সেই অনুযায়ী চলি। কলকাতায় কী গান চলবে, কী চলবে না সেটা কী করে অন্য শহর থেকে নির্দেশিকা আসে? বা কীসের ভিত্তিতে আসে? এটা নিয়ে ভীষণই ক্ষুব্ধ আমি৷ রেগে আছি বলে এই নয় যে ভাষণ দিয়ে চিৎকার করে বলবো৷ এটা ঠিক যে ননফিল্মি গানগুলোক বঞ্চিত করার একটা চক্রান্ত চলছে। আমি তার তীব্র বিরোধিতা করছি৷ কে বা কারা চক্রান্ত করছে আমার সীমিত জ্ঞানে আমি জানি৷ যে বা যারা করছেন সাবধান হয়ে যান। কারণ আমরা যারা ননফিল্মি ক্যাটাগরিতে কাজ করি আমরাও কিন্তু আমাদের জায়গাতে সংঘবদ্ধ হয়ে পড়ছি।"
বাংলা গানকে বঞ্চিত রাখার বিরুদ্ধে লড়াই এভাবেই অব্যাহত থাকুক৷ বাংলা গান ফিরে পাক তার নিজস্ব পরিসর।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment