বিস্মৃতির আড়ালেই সজল কাঞ্জিলালের মৃত্যুর এক বছর
মনে পড়ে সজল কাঞ্জিলালকে? গত বছর ১৪ ই জুলাইয়ের কথা আপনাদের মনে আছে? আজ সেইদিন। ২০১৯ সালের ১৪ ই জুলাই মেট্রোরেলের গাফিলতির কারণে হাতের কব্জী আটকে জীবনাবসান ঘটেছিল এক বোহেমিয়ান শিল্পী সজল কাঞ্জিলালের। এতোবড়ো একজন মানুষের দুর্ঘটনার পরও দায় এড়িয়েছিল কলকাতার মেট্রোরেল। তারা উল্টে অভিযোগ করে বলেছিল সজল কাঞ্জিলালের কব্জী সরু ছিল বলে নাকি হাত আটকে গিয়েছিল রেলের দরজায়৷ নিজেদের ভুল স্বীকার করতে নারাজ ছিল তারা। প্রশ্ন উঠেছিল মেট্রোতে আজকে সজল কাঞ্জিলাল মারা গেছে কালকে তো আমাদেরও একই বিপদ হতে পারে। মেট্রো দফতর কারো কথা শোনেনি। যেন একটা মানুষের জীবনের দাম নেই তাদের কাছে।
কোনো একজন হিন্দি ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রী মারা গেলে টিভির চ্যানেলে লিখে দেওয়া হয় সব মৃত্যুই সমান দুঃখজনক। আসলেই কী তাই? একদমই নয়, একজন হিন্দি ছবির অভিনেতা, হিন্দিভাষী কোনো শিল্পী বা সাহিত্যিক মারা গেলে তাকে নিয়ে টিভি চ্যানেলগুলো মাসের পর মাস তাকে নিয়ে নানাবিধ চর্চা করে। মৃত্যু নিয়েও আজকে টিভি চ্যানেলে রাজনীতি চলছে। তাদের একটাই লক্ষ্য টিআরপি আর টিআরপি। কিছুদিন আগে প্রখ্যাত সাহিত্যিক দেবেশ রায়, কিংবদন্তি চিত্রগ্রাহক বৈদ্যনাথ বসাক, স্বনামধন্য অভিনেতা অরুণ গুহ ঠাকুরতা, বিখ্যাত যাত্রাভিনেতা ত্রিদিব ঘোষ, মহীনের ঘোড়াগুলির প্রতিষ্ঠাতা রঞ্জন ঘোষাল, বর্ষীয়ান সাহিত্যিক নিমাই ভট্টাচার্য, মিও আমোরের প্রতিষ্ঠাতা অর্ণব বসুর মতো ব্যক্তিত্বরা মারা গেলেন। অথচ কোনো মেইনস্ট্রিম মিডিয়া একবারও এনাদের নিয়ে একদিনের বেশি চর্চা করেনি। প্রথমদিন খবরের হেডলাইনে বা একটি মিডিয়া কভারেজের মাধ্যমে তাকে নিয়ে দু'এক কথা বলা হয়, পরদিন থেকে তার আর খোঁজ নেই৷ এনাদের বেলায় কখনো তারা বলেনি যে সব মৃত্যুই সমান দুঃখজনক।
দেখতে দেখতে সজল কাঞ্জিলালের মৃত্যুর একটা বছর পূর্ণ হলো। আজ সজল কাঞ্জিলালের মৃত্যুবার্ষিকী। কোনো মিডিয়ায় হয়তো তাকে নিয়ে কোনো কিছুই বলবে না৷ এর কারণ কী? বাংলার মেইনস্ট্রিম মিডিয়া কী বাঙালির আত্মসম্মান অন্য জাতির কাছে বিকিয়ে দিয়েছে? মিডিয়ার কাজ কী শুধুর টিআরপি বাড়ানো? মিডিয়ার আসল কাজ কী? অসহায় মানুষের পাশে যদি মিডিয়াই না দাঁড়ায় তাহলে আজকে আর কে দাঁড়াবে? এমন ভাবে মিডিয়া চলতে থাকলে মানুষের মিডিয়ার প্রতি গুরুত্ব হারাবে।
বাঙালির আত্মসচেতন হওয়া কতটা প্রয়োজন তা সজল কাঞ্জিলালের মতো মানুষদের অকালমৃত্যু থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিৎ। বাঙালি সচেতন হলে কেন্দ্র সরকারের মেট্রোরেল কখনো বলতে সাহস পেতনা যে সজল কাঞ্জিলালের কব্জি সরু ছিল বলেই মেট্রোর দরজায় তার হাত আটকে তিনি মারা গেছেন। আমাদের অসচেতনতার অভাবকে সঠিক ভাবে কাজ লাগাচ্ছে তারা। আমরা এই বিষয়গুলোকে ছোটো মনে করে উড়িয়ে দিই৷ অবশেষে আমাদের অজান্তে ছোটো বিষয়গুলো বড় হয়ে মাথা চাড়া দেয়।
সজল কাঞ্জিলালের মৃত্যু অত্যন্ত বেদনাদায়ক। রৌদ্র-ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে কখনো নন্দন চত্বর, কখনো বাসে, কখনো ট্রামে তিনি লিটিল ম্যাগাজিন বিক্রি করতেন৷ নন্দন চত্বরে সারাটা দিন দেখা মিলতো তাঁর। বাংলা লিটিল ম্যাগাজিনকে আর্থিক দিক থেকে চাঙ্গা করতে তিনি জীবনের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়ে লিটিল ম্যাগাজিন বিক্রি করতে বেরিয়ে পড়তেন৷ মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। তিনি বিয়ে করেননি৷ কসবার বোসপুকুরে মায়ের সঙ্গে বাড়িতে একা একা দিন কাটাতেন। তিনি পেশায় ছিলেন একজন ভাস্কর। কলকাতার বিভিন্ন আর্ট কলেজে তাঁর হাতে বানানো ভাস্কর্য, চিত্রকলা তাঁর স্মৃতি হিসেবে সজ্জিত রয়েছে। বহু জায়গাতে মডেল হিসেবেও তিনি কাজ করেছেন৷ নন্দন চত্বরে তিনি নাটকের পত্রিকা বিক্রি করতেন৷ তিনি কর্মসূত্রে যুক্ত ছিলেন কয়েকটি লিটিল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সাথের। আর্ট কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁকে প্রচণ্ড স্নেহ করতো৷ সকলে তাঁকে কাঞ্জিলালদা বলে ডাকতেন। শিল্প ছিল তাঁর জীবনের ধারক-বাহক৷
জীবন তো তাঁর সোজা পথেই চলছিল। সবকিছুই ঠিক ছিল৷ হঠাৎ করে জীবনটা এতো করুণ ভাবে সমাপ্ত হবে জানতেন না কেউই৷ তিনি প্রতিদিন কসবার বাড়ি থেকে সকাল হলেই মেট্রোতে বেরিয়ে পড়তেন। গন্তব্য নন্দন চত্বর। সারাদিন সেখানে তিনি লিটিল ম্যাগাজিন বিক্রি করতেন। আর লিটিল ম্যাগাজিন বিক্রির ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন ভাস্কর্য তৈরি করতেন। দিনের শেষে তিনি অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। শহরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার পর ক্লান্ত মনে ঘুম ঘুম চোখে নন্দন থেকে কসবায় ফিরে আসতেন৷ বাড়িতে ফিরেই রাতের খাবার খেয়ে লম্বা ঘুম। এই ছিল তাঁর দিনরাত্রির রুটিন। ২০১৯ সালের ১৪ ই জুলাই, দিনটা ছিল শনিবার৷ রুটিন মতো কসবার বাড়ি থেকে নন্দনে পৌঁছলেন। তিনিও জানতেন না ওটাই তাঁর জীবনের শেষদিন। দিনের সমস্ত কাজ সেরে বাড়ি ফেরার তাড়াতে মেট্রো ধরতে দাঁড়ালেন। মেট্রোর দরজায় উঠতে প্রস্তুত হলেন। আচমকা দরজা বন্ধ হয়ে তাঁর হাত আটকে পড়লো৷ এমতাবস্থায় মেট্রোরেলকে থামানো হলো না৷ মেট্রোরেলটি তার নিজস্ব গতিতে ছুটে চললো। যে লাইন দিয়ে রেলটি ছুটছিল, সেই লাইনে বিদ্যুৎ পদপিষ্ট হয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। সেদিন মেট্রো কর্তৃপক্ষের উচিৎ ছিল ট্রেনটিকে সিগন্যাল দিয়ে থামানো। তারা সেটা করেনি৷ তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী একমাত্র মেট্রো কতৃপক্ষই। তাঁর অন্তিম যাত্রাকালেও মেট্রো কর্তৃপক্ষ তাঁকে অশ্রদ্ধা জানায়।
সজল কাঞ্জিলালের মৃত্যুকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে দায় এড়িয়ে যায় মেট্রো কর্তৃপক্ষ। কিছু সচেতন বাঙালি সেদিন প্রতিবাদও করেছিল রাস্তায় নেমে৷ তবে সেই প্রতিবাদ ভাষা পায়নি। সেই প্রতিবাদকে দমিয়ে দেওয়ারও প্রবল চেষ্টা চলেছিল। বাঙালির মেরুদণ্ড আজকে ভেঙ্গে গেছে। কোনো বাঙালির অস্বাভাবিক মৃত্যু হলেও কারোও কিচ্ছু যায় আসেনা৷ সজল কাঞ্জিলালের মৃত্যু নিয়ে কেউ ভাবনাচিন্তা করেননি৷ তাঁর অন্তিমযাত্রাটাও সুখের হয়নি। চরম অভিমান নিয়ে ইহলোক ত্যাগ করতে হয় তাঁকে। সজল কাঞ্জিলালের মতো বহু ব্যক্তি দিন দিন আমাদের অন্তরালে মারা পড়ছে অথচ তাদের হিসেব আমরা কোনোমূল্যেই রাখছি না। এ সবেরই মূলে দায়ী হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment