বিলুপ্তির পথে বাঙালির রেডিও
সন্ধেবেলা ভোলাদার দোকানে আড্ডা দিতে এসে দেখি জেঠুর রেডিওটা পড়ে আছে। চালিয়ে চ্যানেল ধরতেই শুনলাম আকাশবাণী মৈত্রী সেন্টারে হারানো দিনের গানের অনুষ্ঠান হচ্ছে। সঞ্চালিকা জ্যোতিকা নাজির গানের ফাঁকে শোনাচ্ছিলেন প্রথিতযশা চলচ্চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদারের ফুলেশ্বরী, পলাতক ছবির গান তৈরির গল্প। সুরকার গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর গীতিকার মুকুল দত্তের জুটির ''ফুলেশ্বরী ফুলেশ্বরী ফুলের মতো নাম'' অথবা ''জীবনপুরের পথিক রে ভাই'' ইত্যাদি কালজয়ী গান তৈরির কাহিনী শুনতে শুনতে ছেলেবেলার দিনগুলোতে ফিরে ফিরে যাচ্ছিলাম বারবার। এই প্রতিবেদন যখন লিখছি তখন অনিল ঘোষের লেখা "দুই অরণ্য" নাটক শুরু হয়েছে।
প্রেম, বিবাহ, বিশ্বাস, অরণ্য, আদিবাসী বিয়ের দেবী, গা ছমছমে আবহ সংগীত শুনতে শুনতে বারে বারে হারিয়ে যাচ্ছিলাম অতীতে। তখন এই স্মার্ট ফোন ছিলোনা, ছিলোনা সব পেয়েছির দেশ। তখন বিনোদনের মাধ্যম বলতে ছিল আকাশবাণী কলকাতার নাটক, ছায়াছবির গানের অনুষ্ঠান, গল্প দাদুর আসর ইত্যাদি। অনেক পরে এফ.এম. পেয়েছি। তবে এখনকার মত এত হিন্দি গান বাজতো না। রেডিও জকিরা হিন্দি, ইংরেজিতে কথা বলতেন না সবসময়। তখন রেডিও ছিল বাঙালির প্রাণের রেডিও।। দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কণ্ঠে রবীন্দ্রগীতি আর আঙুরবালার গলায় কাজী নজরুলের গান দিয়ে ১৯২৭ সালের ছাব্বিশে আগষ্ট গার্স্টিন প্লেসের তথাকথিত ভূতুড়ে বাড়িতে যে রেডিওর জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই রেডিওর সঙ্গে বহু বিখ্যাত বাঙালির নাম জড়িয়ে আছে। সঙ্গীতাচার্য্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের হাত ধরে বাংলা আধুনিক গানের জগতে আকাশবাণীর ভুমিকার কথা বাঙালি আজ হয়তো ভুলে গেছে। এই রেডিওর সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ রাইচাঁদ বড়াল, মোহনবাগানের হাফ ব্যাক রাজেন্দ্রনাথ সেন, নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ি, স্বনামধন্য সংগীতশিল্পী পঙ্কজ মল্লিক আরো কত নাম।
শ্রোতাদের কাছে কলকাতা রেডিওর একটা মস্ত বড় আকর্ষণ ছিল বাংলা নাটক। এই বিভাগটির অন্যতম রূপকার ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ কলকাতা রেডিও স্টেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বহুবছর নাটক প্রযোজনার দায়িত্ব নিয়ে। ওনার উদ্যোগে চমৎকার চমৎকার সব বেতার নাটক প্রচারিত হয়েছে কলকাতা থেকে। সে যুগের বিখ্যাত নাট্য ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব – বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ছাড়াও অহীন্দ্র চৌধুরী, জহর গাঙ্গুলী, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সরযূবালা, শম্ভু মিত্র, বসন্ত চৌধুরী, ছবি বিশ্বাস, মঞ্জু দে ও বিকাশ রায়ের মত অভিনেতারা সেগুলোতে নিয়মিত অংশ নিয়েছেন।
১৯৩১ সালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র পঙ্কজ কুমার মল্লিককে নিয়ে বাণীকুমার রচিত বিখ্যাত 'মহিষাসুর-মর্দিনী' অনুষ্ঠানটি শুরু করেন। শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্রের মত নাট্য ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় এই রেডিওর মাধ্যমেই, যাদের নামই শোনেনি এখনকার নব্য বাঙালিদের অনেকে। আকাশবাণীর ধারাবাহিক রহস্য নাটকের কথা মনে পড়ে? 'সাহেব বাংলোর সাহেব ভূত', 'ব্যবসার নাম শুভ বিবাহ','অপরাধী চিহ্ন রাখেনি' আরো কত নাম মনে পড়ছে। সংবাদ পরিবেশন শুরু হয় ১৯৩৩ সালে। রাজেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন স্থানীয় সংবাদের দায়িত্বে। অল্পদিনের মধ্যেই সেই দলে যোগ দেন বিজন বসু, বিভূতি দাস ও অন্যান্যরা। পরে এটি আর শুধু স্থানীয় সংবাদ থাকে না, যুক্ত হয় দেশ-বিদেশের খবর পাঠ। প্রসঙ্গত, বিজন বসু ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত বাংলা সংবাদ পড়েছেন – প্রথমে কলকাতা পরে দিল্লী থেকে। অবসরের বয়স্ক পাঠকদের সেকথা হয়তো মনে আছে। আরও বহু খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব রেডিওর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিরিশ দশকের শেষদিকে কলকাতা রেডিওতে মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
চল্লিশ দশকের শেষ দিকে যোগ দেন বুলবুল সরকার ('কলিং অল চিলড্রেন' অনুষ্ঠানের পরিচালিকা) এবং বেলা দে ('মহিলা মহল' খ্যাত)। খুব সম্ভবত পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে শুরু হয় খেলার ধারা বিবরণী সম্প্রচার। ইংরেজিতে ক্রিকেট খেলার ধারা বিবরণী দিতেন বেরি সর্বাধিকারী আর পিয়ার্সন সুরিটা – পরে অবশ্য মহারাজ কুমার অফ ভিজয়নগরম (ভিজি), দেবরাজ পুরি, শরদিন্দু সান্যাল, বিজয় মার্চেন্ট, প্রমুখ যোগ দেন। অজয় বসু এবং পুষ্পেন সরকার, কমল ভট্টাচার্যের ধারাভাষ্য আজো বাঙালির নস্টালজিয়া। অমিত রায়, সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত, শোভন চক্রবর্তী, সোহিনী সেনগুপ্ত, অয়ন্তিকা ঘোষ, ঝুমুর চট্টোপাধ্যায়, প্রযুক্তি বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণকলি বসু, সুদীপ বসু, রমাপদ পাহাড়ী প্রমুখ অনুষ্ঠান সঞ্চালকদের সঙ্গে শ্রোতাদের ছিল আত্মীয়তার সম্পর্ক। শ্রোতাদের পাঠানো চিঠিতে লেখা থাকতো কত গল্প, কত অনুভূতি। ফোন কলের মাধ্যমেও রেডিও পরিবারের সঙ্গে চিরস্থায়ী সম্পর্কে বাঁধা পড়তেন বাঙালি শ্রোতারা। বাঙালির ঘর গেরস্থালির সঙ্গে জড়িয়ে আছে শ্রাবন্তী মজুমদারের আদুরে গলায় বোরোলীনের সেই বিখ্যাত বিজ্ঞাপন....'ত্বক যদি কেটে যায়, ফেটে যায়, খসখসে যদি হয়/ রোদ্দুরে ঝলসায়, সারা অঙ্গে মেখে নিন/ সুরভিত অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম বোরোলীন'।
আকাশবাণীর সাহিত্য আড্ডা শক্তি চট্টোপাধ্যায় থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ইত্যাদি বহু বাঙালি সাহিত্যিকের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে আজো অমর হয়ে আছে। রেডিওর গানের কথা বলতে গেলে গোটা একটা বই লিখতে হয়। তবে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, সুমিত্রা সেন, সুবীর সেন, সুবিনয় রায়, দেবব্রত বিশ্বাস, মোহন সিং খাঙ্গুরা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কিশোর কুমার, শ্যামল মিত্র, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, হৈমন্তী শুক্লা, আরতি মুখোপাধ্যায়, গীতা দত্ত, বনশ্রী সেনগুপ্ত, নির্মলা মিশ্র, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, পিন্টু ভট্টাচার্য, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, অমর পাল, নির্মলেন্দু চৌধুরী, আব্দুল জব্বার, আব্বাসউদ্দীন আহমেদ ইত্যাদির গান মুগ্ধ হয়ে শুনতো আপামর বাঙালি। শুধু তাই নয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল আকাশবাণী কলকাতা।
প্রকৃত অর্থে রেডিও ছিল 'বঙ্গ জীবনের অঙ্গ'।গান, নাটক, কবিতা, সংবাদ, কৃষি কথার আসর, গল্প দাদুর আসর, খেলার ধারাভাষ্য, মহালয়া, মহিলা মহল ইত্যাদি আট থেকে আশি সকলের বিনোদনের খোরাক জোগাত। খুব মনে আছে আমার দাদু আটটার খবর শেষ হলে রাতের খাবার খেতেন। তখন অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারে দেওয়াল ঘড়ির বিকল্প ছিল রেডিও। সবচেয়ে বড় কথা তখন একলা বসে কানে হেডফোন দিয়ে রেডিও শুনতেন না কেউ। সম্পত্তি নিয়ে বিবাদমান দুই পড়শি হোক বা সাপে নেউলে সম্পর্কের দুই জা একসাথে রেডিও শুনতেন। তাই সামাজিক মেলবন্ধনের অন্যতম মাধ্যম ছিল রেডিও। বাঙালির নাড়ির সঙ্গে থাকা সেই রেডিও আজ বিলুপ্তির পথে। রেডিওতে এফএম চ্যানেল আসার পর নব্য প্রজন্মের মধ্যে এফএম শোনার প্রবণতা বেড়েছিল কিছুকাল। কিন্তু সহজলভ্য ইন্টারনেটের যুগে এফএম এখন সেকেলে হয়ে গেছে। যে কটা এমএম চ্যানেল এখনো টিকে আছে তাতে বাংলা ও বাঙালিয়ানার ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। খুব ভোরবেলা বা মাঝ রাত্তিরে ছাড়া বাংলা গান প্রায় শুনতে পাওয়া যায়না বললেই চলে। আমার জানা বহু রেডিও জকি বাংলায় কথা বলতে না পেরে রেডিও চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। আমার এমএম নামে বাংলা চ্যানেলটিতো বন্ধই হয়ে গেল। শুধু ফ্রেন্ডস এমএম, রেডিও মির্চিতে কিছু কিছু বাংলা অনুষ্ঠান শোনা যায় এখনো। ওটাও না চলার মতোই বলা চলে৷ আধুনিকতার করাল গ্রাসে এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির নিজস্বতা, বাঙালির প্রাণের রেডিও।
Post a Comment