দুই শতাব্দীর তরী পার করলেন লেখক ও বিজ্ঞানসাধক অক্ষয়কুমার দত্ত
আজ ১৫ই জুলাই। গতকাল গেছে ১৪ ই জুলাই, যা এক ঐতিহাসিক দিবস হিসেবে স্বীকৃত কেননা এইদিন ফ্রান্সে বাস্তিল দূর্গের পতন ঘটে এবং একই সঙ্গে সে দেশে এক নবজাগরণের আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল যার ঢেউ এদেশেও এসে পৌঁছে অনুপ্রাণিত করে তুলেছিল মহান স্বাধীনতার আন্দোলনকে। যাইহোক, এর পরের দিন অর্থাৎ ১৫ই জুলাইও এক ঐতিহাসিক দিবস কেননা ১৮২০ সালের এইদিনে বর্ধমান জেলার চুপি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরণের এক বিখ্যাত মনীষী। বলা যেতে পারে বাংলার নবজাগরণের অন্যতম অগ্রদূত। তাঁর নাম অক্ষয়কুমার দত্ত। এই অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন একজন বিখ্যাত বাঙালি সাংবাদিক, প্রবন্ধকার এবং লেখক। সর্বোপরি তিনি ছিলেন বাংলা তথা মাতৃভাষায় বিজ্ঞান প্রচারক। এ বছর আমাদের প্রত্যেককে তাঁকে স্মরণ করতেই হবে কেননা এবছর তাঁর দ্বিশত জন্মবার্ষিকী। আমরা সবাই ফিল্মষ্টার অক্ষয়কুমারকে চিনলেও, বাংলা সাহিত্য জগতের হিরো বা দিক্পাল অক্ষয়কুমার দত্তকে কি সেইভাবে চিনি? বিস্মৃতির সাগরে তলিয়ে গেছে তাঁর নাম আর তাঁর লেখা। এই প্রবন্ধে তাঁকে ও তাঁর মণিমাণিক্যকে তুলে আনার চেষ্টা করি।
অক্ষয়কুমার দত্তের পিতা ছিলেন পিতাম্বর দত্ত ও মাতা ছিলেন দয়াময়ী দেবী। খুবই অল্প বয়সে অক্ষয়কুমার দত্ত তাঁর পিতাকে হারান যার ফলে ছেলেবেলায় দারিদ্র্য সহ নানা বাধাবিঘ্নের সাথে তাঁকে লড়তে হয়েছিল। ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে তিনি কয়েক বছর পড়েছিলেন। কিন্তু আর্থিক অনটনের কারণে স্কুল জীবনেই তাঁকে পড়াশোনা সীমাবদ্ধ রাখতে হয়েছিল। অবস্থা এমনই হয়ে ওঠে যে স্কুল জীবনেই লেখাপড়া ছেড়ে তাঁকে অর্থোপার্জনের পথ খুঁজতে হয়। তিনি স্কুল ছেড়েছিলেন ঠিকই কিন্তু লেখাপড়া কোনোদিনও ছাড়েননি। পড়ার বইয়ের বাইরে বা বলা ভালো স্কুল পাঠ্য বইয়ের বাইরেও তিনি বিদ্যাচচর্চা চালিয়ে গিয়েছিলেন সারাজীবন। কিশোর বয়সেই শিখে ফেলেছিলেন সংস্কৃত ও ফারসি ভাষা। এছাড়াও তিনি কিছুদিনের মধ্যে ইংরেজি, জার্মান, ফ্রেঞ্চ সহ বিভিন্ন ভাষা খুব ভালোভাবেই রপ্ত করেছিলেন। আসলে ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আর তাই এত ভাষা ও বিদ্যয় পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি ‛অঙ্গনমোহন’ নামে একখানা কাব্যগ্রন্থ লিখে ফেলেছিলেন! এর অল্প কিছুদিনের মধ্যে তিনি ঈশ্বরগুপ্তের ‛সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার জন্য ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করে লেখা পাঠাতেন। অতটুকু অল্প বয়সেই হয়ে উঠেছিলেন এক অনুবাদক। এভাবেই তাঁর বাংলা সাহিত্য জগতে গদ্য রচনায় হাতেখড়ি হয়েছিল।
১৮৩৯ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত ‛তত্ত্ববোধিনী সভা’-র সভ্য হন তিনি। শুধু তাই নয়, তিনি এই সভার কিছুদিন সহ-সম্পাদকও ছিলেন। ওই সময় বা বলা ভালো এর দু'বছর পর ১৮৪১ সালে তিনি বাংলায় একটি ভূগোলের বই নাম 'ভূগোল' প্রকাশ করেন। ১৮৪২ সালে তিনি নিজেই একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন যার নাম ‛বিদ্যাদর্শন’। কিন্তু দুঃখের বিষয় অকালেই এই পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৮৪৩ সালের ১৬ই আগস্ট ব্রাহ্মসমাজ থেকে তার মুখপত্র ‛তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ আত্মপ্রকাশ করে। ব্রাহ্মসমাজের বিশিষ্ট নেতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর খুব ভালোভাবেই জানতেন অক্ষয়কুমারের সাহিত্য দক্ষতা তাই তিনি অক্ষয়কুমারকে শুরু থেকেই এই পত্রিকাটির সম্পাদকের দ্বায়িত্বে বসিয়েছিলেন। কথায় বলে না "জহুরী জহর চেনে" সেই কথাটাই হয়ত এখানে খাটলো। কেননা অক্ষয়কুমারের সুদক্ষ পরিচালনা ও বিভিন্ন বিষয়ের বিপুল রচনাসামগ্রীর ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই পত্রিকাটি শ্রেষ্ঠ সাময়িক পত্ররূপে রূপান্তরিত হয়েছিল।
অনন্য এই পত্রিকাটিতে সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের আকর্ষণীয় প্রবন্ধ প্রকাশিত হত। এমনকি তখনকার দিনে যে সমস্ত বিষয় সমাজকে নাড়া দিত সেইসব বিষয় যেমন নারীশিক্ষার বিস্তার সম্পর্কে বা বিধবা বিবাহকে সমর্থন করে এবং বাল্যবিবাহ ও নানান সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে অত্যন্ত যুক্তিসহ বলিষ্ঠ লেখা প্রকাশিত হত। এই পত্রিকাটি আবার রাজনৈতিক সচতনতারও পরিচয় বহন করত। আর এই রাজনৈতিকভাবে বিমুখ ছিল না বলেই অত্যাচারী নীলকর সাহেব ও জমিদারদের করা প্রজাদের উপর অমানবিক নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধেও অক্ষয়কুমার নির্ভীকভাবে লিখে গিয়েছিলেন কারও তাঁবেদারি না করে। অক্ষয় কুমার দত্ত যেমন সাহিত্যিক ছিলেন তেমনি ছিলেন একজন বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তি। তখনকার পরাধীন দেশ অশিক্ষা ও কুসংস্কারে একেবারে জর্জরিত। সেইসময় তিনি তাঁর অসাধারণ রচনা শৈলীর মাধ্যমে সাধারণ এমনকি অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চিন্তা-ভাবনা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে গেছেন। তখন বাংলায় গদ্য লেখা সবে শুরু হয়েছে, তাই বলা যায় বাংলা গদ্য তখন একেবারে বাল্যাবস্থায় ছিল। তা সত্ত্বেও, তিনি ওই সময়ের বিখ্যাত সাময়িকপত্র 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা'-র সম্পাদকের পদে থেকে তিনি তাঁর অসাধারণ বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে দুরহ বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও নানাবিধ তথ্য বাংলায় প্রচার করে গিয়েছেন। এই কাজটি এখন কিছুটা সহজ হলেও তখনকার দিনে মোটেও সহজ ছিল না। তাই বলা যায় যে, এই বাংলায় বৈজ্ঞানিক প্রচারের কাজ তখনকার দিনে তাঁর মতো কেউ করেছেন বলে মনে হয় না। অতি শিক্ষিত মানুষরাই তখন এসব কাজে তেমন এগিয়ে আসতেন না। এই বৈজ্ঞানিক মনস্কতা ও যুক্তিবাদী আচার-আচরণের জন্যে তিনি "বেদ যে অভ্রান্ত" বা "বেদবাক্যই যে একেবারে সঠিক" তা মেনে নিতে পারেননি।
তিনি বেদ সম্পর্কে তাঁর যাবতীয় মতামত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় লিখে প্রকাশ করতে লাগলেন। আর এর ফলেই তিনি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অন্যান্য ব্রাহ্মদের কাছে অপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু শেষে অক্ষয়কুমারেরই জয় হয়। তাঁর অকাট্য যুক্তি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। হিন্দুধর্মের নানা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এবং একই সাথে খ্রীষ্টান মিশনারিদের খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের বিরোধিতা করার জন্যে তিনি নিজেকে একটি সঠিক পথে চালিত করতে চাইছিলেন। যার ফলস্বরূপ তিনি হিন্দুধর্ম পরিবর্তন করে ১৮৪৩ সালের ডিসেম্বর মাসে বিখ্যাত আভিধানিক এবং পণ্ডিত রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। শুধু তিনি একা নন তাঁর সাথে আরও উনিশ জন ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। এইভাবে তিনি ব্রাহ্মধর্মে নিযুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু এখানেও তিনি তাঁর যুক্তিবাদি আচরণ বজায় রাখেন এবং নানান যুক্তি দেখিয়ে ব্রাহ্মদের মধ্যেও নিজেকে ব্যতিক্রমী করে তুলেছিলেন। তিনি মনে করতেন যে মানুষের জ্ঞানের বিশেষত বিজ্ঞান ও দর্শনের যা অগ্রগতী হয়েছে তার পরিপেক্ষিতে হাজার বছর ধরে চলে আসা বেদেরও সংশোধন করা প্রয়োজন। কিন্তু, কে শুনবে তাঁর এই মত? অক্ষয়কুমার জোর দিয়ে বলতেন যে, "দেব-দেবীর পুজো, উপাসনা কখনোই মানুষের চেষ্টা ও পরিশ্রমের বিকল্প হতে পারে না।"
উনিশ শতকের প্রথমদিকের সামাজিক অবস্থা যা ছিল তাতে অক্ষয়কুমারের এই মত অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। অনেকের মনে এক ভীতি সঞ্চারিত হয়েছিল। এমনকি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো একজন প্রগতিশীল ব্যক্তিও সহজেই অক্ষয়কুমার দত্তকে মেনে নিতে পারেননি। অক্ষয়কুমারের যুক্তিবাদী মনস্কতার জন্যই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকাশ্যেই অভিযোগ করেছিলেন যে ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাসী এমন কয়েকজন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য তাঁর ব্রাহ্মধর্ম প্রচারে বিঘ্ন ঘটছে। বোঝাই যাচ্ছে যে, অক্ষয়কুমার দত্তের উদ্দেশ্যেই তিনি এই মন্তব্যটি করেছিলেন। তিনি মনে করতেন যে, এদেশের শিক্ষা হওয়া উচিত মাতৃভাষায়। তিনি নানান যুক্তি উপস্থাপন করে গণশিক্ষা বা যে শিক্ষার দ্বারা সমস্ত মানুষের উপকার হয় এমন শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করার দাবি করতেন। সে সময় পল্লী বাংলার প্রজাদের অতি দুরবস্থা ছিল আর সেই দুরবস্থার কথা তিনি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর লেখার মাধ্যমে কৃষক ও প্রজাদের চরম দুরবস্থার বাস্তব চিত্রটি ফুটে উঠত যা পাঠকের হৃদয়কে স্পর্শ করত। তাঁর লেখায় তিনি সমীক্ষা করে দেখিয়েছিলেন যে, কলকাতার আশেপাশে বহু গ্রামেই শিক্ষার আলো একেবারেই পৌঁছায়নি। এর মূল কারণ বা শিক্ষার এই ঘাটতি হিসেবে তিনি মনে করতেন যে, ইংরেজির মতো একটি বিদেশি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাই এর মূল কারন। আর এই জন্যেই তিনি মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পক্ষপাতী ছিলেন। কেননা, দেশের মানুষ ইংরেজি অতটা না বুঝলেও মাতৃভাষা ঠিক বুঝবেই ।
তিনি নানান বই রচনা করেছিলেন। এই উল্লেখযোগ্য বইগুলির মধ্যে 'বিদ্যাদর্শন', 'ভূগোল (১৮৪১)' তো আছেই আর আছে 'বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার (১ম ভাগ ১৮৫২; দ্বিতীয় ভাগ ১৮৫৩)', 'ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় (১ম ভাগ- ১৮৭০, ২য় ভাগ- ১৮৮৩)', 'ধর্মনীতি সংশোধন বিষয়ক প্রস্তাব(২য় খণ্ড)', 'পদার্থবিদ্যা (১৮৫৬)',‘প্রাচীন হিন্দুদিগের সমুদ্র যাত্রা ও বাণিজ্য বিস্তার', 'ধর্মনীতি (১৮৫৫)‘চারুপাঠ (১ম ভাগ ১৮৫২, ২য় ভাগ- ১৮৫৪, ৩য় খণ্ড- ১৮৫৯)’ ইত্যাদি।
১৮৪৩ থেকে ১৮৫৫ এই দীর্ঘ বারো বছর তিনি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। এরপরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নর্মাল স্কুল স্থাপন করলে সেখানকার প্রধান শিক্ষক পদে যুক্ত হন। কিন্তু শারীরিক কারণে তিনি বেশিদিন সেখানে শিক্ষকতার কাজ চালাতে পারেননি। জানা যায় যে, তত্ত্ববোধিনী সভা থেকে তিনি মাসিক পঁচিশ টাকা লাভ করতেন। কিন্তু তাঁর রচিত বইগুলো বাজারে অত্যন্ত জনপ্রিয়তার ফলে সেগুলোর থেকে আয় বেড়ে যায় আর এই আয় বেড়ে যাওয়ার জন্যে তিনি তত্ত্ববোধিনী সভার বৃত্তিটুকুও নিতে অস্বীকার করেন। তিনি এমনই নির্লোভ ব্যক্তি ছিলেন। শুধু লেখনীর মাধ্যমেই নয়, তাঁর অসাধারণ যুক্তিবাদী মনোভাব তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও প্রতিফলিত হত। যুক্তিবাদী ও কঠোর নীতিপরায়ন ব্যক্তি হলেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা সম্পর্কে তিনি বাংলা ভাষায় নানান প্রবন্ধ লিখে গেছেন। ভূগোল, প্রকৃতিবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান সহ বিভিন্ন বিষয়ের সহজ-সরল প্রবন্ধ তিনি বাংলায় লিখতেন। ভাবতে অবাক লাগে যে অত বছর আগেও তিনি ভূগোল, পদার্থবিদ্যা, বাণিজ্যের মতো বিষয়েও বই লিখে গেছেন। তাঁর রচিত তিন খণ্ডের ‘চারুপাঠ’ একটি উচ্চমানের জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই হিসেবে ধরা হয়। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা ভালো যে, একজন বিশ্ববিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাধাগোবিন্দ চন্দ্র জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয় গবেষণা করার জন্যে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এই ‘চারুপাঠ’ পড়ে। তিনি যখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়তেন তখন তাঁদের পাঠ্যবই ছিল ‘চারুপাঠ’-এর তৃতীয় ভাগ। এই গ্রন্থে অক্ষয়কুমার দত্তের রচিত একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ছিল যার নাম "ব্রহ্মাণ্ড কি প্রকাণ্ড" যা পড়ে রাধাগোবিন্দ চন্দ্র বাল্যবয়স থেকেই জ্যোতির্বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করেছিলেন। তিনি পরিণত বয়সে তাঁর আত্মজীবনীমূলক একটি লেখায় সে কথা স্বীকার করে গেছেন। যা এখানে তুলে ধরা হলোঃ-
"অক্ষয়কুমার দত্তের চারুপাঠ তৃতীয় ভাগ পড়িয়া, নক্ষত্রবিদ হইবার জন্যে আর কাহারো বাসনা ফলবর্তী হইয়াছিল কিনা জানি না, আমার হইয়াছিল। সেই উদ্দাম ও উচ্ছৃঙ্খল বাসনার গতিরোধ করিতে আমি চেষ্টা করি নাই।"
বিজ্ঞানের বিশাল ডিগ্রি বা বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি তাঁর হয়তো ছিল না। কিন্তু তাঁর বৈজ্ঞানিক মনোভাব বা বিজ্ঞানমনস্কতা ও যুক্তিবাদী মনোভাব ও বিষয়ের গভীর চিন্তাভাবনা এবং সবকিছুর অসাধারণ বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষমতার দ্বারা তিনি এক বিজ্ঞানী হিসেবে গণ্য হয়েছিলেন। একজন সুপ্রসিদ্ধ বিজ্ঞান সাধকের মতোই তিনি বিজ্ঞানের দুরহ ও জটিল তত্ত্ব ও তথ্যকে সবার জন্য সহজ সরল করে বাংলা তথা মাতৃভাষায় প্রচার করে গিয়েছিলেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে বিজ্ঞানের অনেক বিশাল পণ্ডিত হয়েও তাঁর মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতার বা যুক্তিবাদী মনোভাবের অভাব রয়েছে। প্রথাগত তেমন শিক্ষা ছাড়াও তিনি যা কাজ করে গেছেন তাতে সবার তাক লেগে যায়। তাঁর লেখা বিজ্ঞান প্রবন্ধ পড়ে অনেকেই রাধাগোবিন্দ চন্দ্রের মতন বিজ্ঞান বিষয়ে উৎসাহিত হয়েছিলেন। তাঁর লেখা আজও আজকের দিনে ও প্রাসঙ্গিক সেই লেখা সম্পর্কে বিখ্যাত বিপ্লবী ও সাহিত্যিক গোপাল হালদারের মন্তব্য এই প্রবন্ধে তুলে ধরা হলোঃ-
"অক্ষয়কুমার রেখে গিয়েছেন নিরাবেগ বৈজ্ঞানিক বুদ্ধির বিশুদ্ধ ঐতিহ্য। তিনি বাংলা সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অগ্রে ও তাঁর সঙ্গেই স্মরণীয়। তথ্যনিষ্ঠ জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুশীলন ও প্রচার তিনিই বাংলায় প্রথম আরম্ভ করেন। অক্ষয়কুমার নিজে নিরাকার উপাসনা ত্যাগ করে ক্রমে অজ্ঞেয়বাদী (agnostic) হয়ে পড়েন— এটি শুধু তাঁর বৈজ্ঞানিক বুদ্ধির ফল নয়, তাঁর সুদৃঢ় নীতিবোধেরও পরিচায়ক।"
সত্যি তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সাথে বাংলা সাহিত্য জগতে একই আসনে সমাদৃত। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতোই তিনি প্রথাগত দেব-দেবীর পূজারী না হয়েও ছিলেন বাংলা মায়ের পূজারী। এই দুই স্বনামধন্য মনীষীর এবছর দ্বিশত জন্মবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে। এই কঠিন পরিস্থিতিতে যখন আমরা সবাই করোনার আতঙ্কে গৃহবন্দী রয়েছি তখন কোথায় যেন আমাদের মনে আনন্দ এনে দেয় আজকের এই বিশেষ দিনে অক্ষয়কুমার দত্তকে স্মরণ করে। এর সাথে, তাঁর সম্বন্ধে আরও জানার ও তাঁর লেখাগুলো পড়ার এক দায়ভারও চেপে বসে যা পালন করা একজন বাঙালি হিসেবে আমাদের কর্তব্য। ১৮৮৬ সালের ১৮ই মে এই মহান ব্যক্তি মর্তলোক ছেড়ে পরলোকগমন করেন। তাঁর শেষ জীবন অতিবাহিত হয়েছিল বালিগ্রামে 'বোটানিক গার্ডেন' নামের একটি বাড়িতে। আজ এই মহান মনীষীর ২০০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে তাঁর উদ্দেশে রইলো সশ্রদ্ধ শতকোটি প্রণাম ও সামান্য শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে এই লেখা।
Post a Comment