বেঙ্গল কেমিক্যালস এণ্ড ফার্মাসিউটিক্যালস ওয়ার্কস লিমিটেড ইতিবৃত্ত || ষষ্ঠ পর্ব
এই পর্ব থেকে আমরা প্রবেশ করতে চলেছি একেবারে মূল বিষয়, অর্থাৎ জানতে চলেছি কেমন ছিল আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের তত্ত্বাবধানে বেঙ্গল কেমিক্যালের বিভিন্ন বিভাগ ও কাজকর্ম। প্রথমেই ঘুরে আসা যাক বেঙ্গল কেমিক্যাল কোম্পানির অ্যাসিড ঘরটিতে অর্থাৎ এবার আমরা জেনে নেব, আচার্যদেবের আমলে কেমন ছিল এই কোম্পানির অ্যাসিড রাখার জায়গা। অ্যাসিড ঘরে ছ’টা সীসার চেম্বার ছিল। আসলে এই চেম্বারগুলি আগাগোড়াই ছিল সীসা দিয়ে তৈরি, তাই বলা হত সীসার চেম্বার (Lead chamber)। কারখানাতেই দক্ষ লেড্ম্যান নিযুক্ত ছিলেন যিনি ওই লেড চেম্বারগুলির দেখাশোনার দায়িত্বে থাকতেন। এই অ্যাসিড চেম্বার এতই উন্নত ছিল যে তা দেখে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ জানিয়েছিলেন, "বিলাত(ইংল্যান্ড) থেকে পাকা কারিগর আনলেও এর চেয়ে মজবুত এবং সুন্দর অ্যাসিড চেম্বার হত না।" তাহলে, সেকালে অর্থাৎ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সময় কতখানি উন্নত অ্যাসিড চেম্বার বেঙ্গল কেমিক্যালে ছিল তা আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারি। ওই অ্যাসিড চেম্বারে দিন-রাত কাজ হত। আচার্যদেবের লেখা থেকে জানা যায় যে, দিনে প্রায় ২২,০০০ পাউন্ড অ্যাসিড তৈরি হত। তখনকার দিনে বেঙ্গল কেমিক্যালের তৈরি নানারকম অ্যাসিড সরকারি ট্যাঁকশালে, টেলিগ্রাফ ওয়ার্কশপে, গোলাবারুদের কারখানা সহ ইত্যাদি নানান নামকরা প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করা হত।
এবার, ঘোরা যাক তৎকালীন কারখানার ফার্মেসি বিভাগে। ফার্মেসিতে বাসক, গুলঞ্চ, নিম, কালমেঘ, হরিতকী ইত্যাদি ভেষজ গাছ-গাছড়া থেকে বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক উপায়ে নানারকম দেশীয় ওষুধ তৈরি করা হত। গর্বের বা সুখের বিষয় এই যে, সেইসব ওষুধ দেশের ডাক্তারেরা অবাধে ব্যবহার করতেন। বেঙ্গল কেমিক্যাল থেকে সিরাপ, বাসক, কালমেঘের তরলসার, যমানীজল(খুব সম্ভবত জোয়ানের জল বা যাকে আমরা আজ বলি জোয়ানের আরক), গুলঞ্চের তরলসার ইত্যাদি বিখ্যাত দেশীয় ওষুধ তখনকার দেশের প্রতিটা ঘরে ঘরে পরিচিত ছিল। যেমন, আজও বিখ্যাত হজমের ওষুধ জোয়ানের আরক(Aqua Ptychotis), নেপথেলিন বল, ফিনাইল ব্লিচিং পাউডার-সহ ইত্যাদি ওষুধ বা সামগ্রী সকলের কাছেই পরিচিত। বলা বাহুল্য, এইসব ওষুধগুলি বাঙালির জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। বর্তমানে করোনা সংক্রমণের সময় করোনা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে যেমন এই কারখানার তৈরি হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন করোনা রোগের ওষুধ বা প্রতিষেধক হিসেবে জগৎবিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। এখানে উল্লেখ্য এই যে, এই হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন রিউম্যাটয়েড আর্থ্রারাইটিস এবং লুপাসের মতো অটোইমিউন রোগের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় এবং ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক ও চিকিৎসার জন্যেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে।যদিও কিছু দিন আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু করোনা-রোগীদের উপর হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন প্রয়োগ বন্ধ করেছে। এই বেঙ্গল কেমিক্যাল থেকেই বেরিয়েছে বিখ্যাত অ্যান্টিভেনাম সিরাম। যাইহোক, আগে উল্লেখিত ওইসব গাছ-গাছড়া থেকে দেশীয় ঔষধগুলি বেঙ্গল কেমিক্যালই ভরসা করে প্রথমে তৈরি করতে শুরু করেছিল। যদিও পরে অবশ্য আরও অনেক কারখানা এইসব উল্লেখিত দেশীয় ওষুধ বিভিন্ন নাম দিয়ে তৈরি করেছে তবুও গর্বের সাথেই হলপ্ করে বলা যায় যে বেঙ্গল কেমিক্যালই এইসব বিভিন্ন দেশীয় ওষুধ প্রস্তুতের ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল ও করেছে।
আচার্য রায় ছিলেন প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিক্ষা ও সমাজ সম্পর্কে অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। তাঁর এই শ্রদ্ধা প্রতিফলিত হয় তাঁর লেখা বিখ্যাত ‛এ হিস্ট্রি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি(দু’ খণ্ড)’ বইটিতে।আচার্যদেব তাঁর ‛বেঙ্গল কেমিক্যাল’ প্রবন্ধে জানিয়েছেন যে, "চিকিৎসাশাস্ত্র আমাদের দেশে এক সময় অতি উন্নত ছিল। এমন কি-এমন একদিন ছিল যখন তিব্বত, আরব, পারস্য, সিংহল,চীন ইত্যাদি বহুদূর দেশ থেকে ছাত্র এসে আমাদের দেশের চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করে যেত।" কতটা উন্নত ছিল আমাদের দেশ তা প্রাচীনকালের এই চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা জানতে পেরেই বোঝা যায়।আর, প্রাচীনকালের ওই স্বর্ণযুগে জন্মানো বিশিষ্ট চিকিৎসক ও ঋষি চরক ও সুশ্রুতের নাম তো জগতের সকলেই জানেন।আচার্যদেব লিখেছেন যে, "তাঁরা কোন সময়ের লোক ছিলেন, তার ঠিক করে বলা শক্ত, তবে তিন হাজার বছরের এদিকে নয়, একথা বলা যায়।” ভাবলে বিস্মিত হতে হয় যে তিন হাজার বছরের আগে জন্মানো এই দুই মহর্ষি চিকিৎসার দুনিয়ায় সারা বিশ্বে ভারতের স্থান কতখানি উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে গত কয়েকশো বছর থেকে দেশীয় চিকিৎসা ব্যবস্থার অবনতি শুরু হয়।তারপর যখন দেশে বিদেশি শাসকদের হাত ধরে পাশ্চাত্য ডাক্তারি চিকিৎসা আরম্ভ হতে শুরু করল তখন সেই পাশ্চাত্য ডাক্তারি চিকিৎসার দাপটে দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানের বা ওষুধের যে গৌরব অবশিষ্ট ছিল তাও মুছে যাবার বা বিলুপ্ত হবার অবস্থায় চলে গিয়েছিল। আচার্যদেবের ভাষায় যা বলা যায়,"তখন (দেশে পাশ্চাত্য ডাক্তারি চিকিৎসা চালু হবার পর) ওষুধের প্রায় লুপ্ত গৌরবটুকুও মুছে যাবার মতো অবস্থায় এসে পৌঁছল।" কিন্তু সুখের কথা এই যে, এই গৌরবটুকু মুছে যেতে পারেনি, তা যেন পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হল বেঙ্গল কেমিক্যালের হাত ধরে। কেননা, ঠিক সেই সময় বেঙ্গল কেমিক্যাল দেশীয় উপকরণের সাথে আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মিলন ঘটিয়ে নতুন একশ্রেণির ওষুধ বের করেছিল।আর এই বের হওয়ার ফলে সেই সময়ে দেশ আবার তার চিকিৎসাবিদ্যার হারিয়ে যাওয়া গৌরব লাভ করেছিল। এই ব্যাপারে আচার্যদেব লিখেছেন,"বর্তমান সময়ে দেশের হাওয়া আবার বদলেছে।" উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি যে, যে চিকিৎসাবিদ্যার মোমবাতির আলো বিদেশি হাওয়ায় নিভে যেতে বসেছিল তা যেন বেঙ্গল কেমিক্যালের অক্সিজেনে আবার দপ্ করে জ্বলে উঠেছিল। আমরা রসায়নে তো পড়েছি যে, অক্সিজেন দহনে সাহায্য করে থাকে। তাই দেশের রাসায়নিক শিল্পের কথা রাসায়নিক উদাহরণের সাহায্যেই বোঝানো হল।
আবার,অন্যদিকে এখানকার মানুষের দেশীয় ওষুধের প্রতি যে পছন্দ তা অপছন্দে পরিণত হতে শুরু করেছিল। কেননা, সব জিনিসের মতোই কবিরাজি চিকিৎসা ব্যবস্থায় বা কবিরাজি ওষুধে নিঃসন্দেহে অনেক ভালো জিনিস রয়েছে আবার এর সাথে অনেক অনাবশ্যক বা অপ্রয়োজনীয় বাজে জিনিসও প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। কবিরাজি চিকিৎসা ব্যবস্থা যদিও অনেক প্রাচীন তবুও এর ওষুধের মধ্যে অনেক কিছুই রয়েছে যা ঠিক বিজ্ঞানসম্মত নয় এবং সেগুলোকে ওষুধ থেকে একেবারে বাদ যদি দেওয়াও যায় তবে কোনোও ক্ষতি নেই। আচার্যদেব জানিয়েছেন যে, আমাদের দেশে, "বেঙ্গল কেমিক্যাল-ই কবিরাজি ওষুধ বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে তৈরি করতে শুরু করে কবিরাজী-শাস্ত্রকে নতুন জীবন দান করেছে।" অর্থাৎ, বেঙ্গল কেমিক্যাল দেশীয় ওষুধের মতোই এদেশের তথা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন চিকিৎসা ব্যবস্থা-কবিরাজিশাস্ত্রকেও আধুনিকতার ছোঁয়া লাগিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বা বলা ভালো বিজ্ঞান মনস্কতার স্পর্শ ঘটিয়ে দেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় বা গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল।
এবার ঘুরে আসি বেঙ্গল কেমিক্যালের সুগন্ধি (aromatic/ Perfume) তৈরীর বিভাগে। সেখানে আচার্যদেবের আমলে নানারকম বা নানাপ্রকার সুগন্ধি তৈরি হত। সেকালে বেঙ্গল কেমিক্যালের তৈরি হওয়া অগুরু, কস্তুরী ইত্যাদি সুগন্ধির সাথে সকলেই পরিচিত ছিলেন। গর্ব করার বিষয়ে যে, বেঙ্গল কেমিক্যালের তৈরি সুগন্ধির মতো এত কম দামে, এত ভালো ও এত বেশি পরিমাণে দেশী বা বিলাতি কোনও সুগন্ধিও পাওয়া যেত না। বেঙ্গল কেমিক্যালে নানাপ্রকার সুগন্ধি চুলের তেলও তৈরি হত। এই তেলের মধ্যে ক্যান্থার-আইডিন তেল গোটা বঙ্গদেশে এতটাই সুপ্রসিদ্ধ ছিল যে বাংলার ছেলে বুড়ো নির্বিশেষে সকলের কাছেই তা সুপরিচিত ছিল। সকলেই জানত উল্লেখিত এই তেলের কথা।
আচার্যদেবের মস্তিষ্কপ্রসূত ছিল এই বেঙ্গল কেমিক্যাল। আচার্যদেবের মানসিকতা কতটা আধুনিক ছিল বা তাঁর রাসায়নিক শিল্প ও বাঙালির কর্মসংস্থান সম্পর্কে কতটা দূরদর্শীতা ছিল তার প্রতিফলন ঘটেছে বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানা প্রতিষ্ঠা ও চালনার মাধ্যমে। এই রাসায়নিক কারখানা অন্যান্য রাসায়নিক কারখানা থেকে কতটা এগিয়ে ছিল বা আলাদা ছিল তার উদাহরণ তো আগেই পেলাম। এবারেও আচার্যদেবের এক আধুনিক মানসিকতার সাথে পরিচয়লাভ করব। তখনকার দিনে পুরো বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানা জুড়ে ট্রলির জন্য রেল পাতা ছিল। এর ফলে, কারখানার মধ্যে মাল চলাচলের খুবই সুবিধা হত। তৎকালীন পরাধীনতার যুগে, এই অত্যাধুনিক ব্যবস্থা সত্যিই বিস্ময়ে তাক লাগিয়ে দেয়। কারখানার একটি ফায়ার ব্রিগেডও ছিল, যেখানে ফায়ার ব্রিগেডের লোকেরা নিজেদের কাজে ধীরে ধীরে শিক্ষালাভ করে নিপুণ হয়ে উঠতেন।
Post a Comment