Header Ads

চেনা মগডালে পাখিদের ফেরাতে অভিনব বাসা বানালো হাওড়ার এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা


পাখি সব করে রব। আমাদের বাড়ির চারপাশে পাখিদের আনাগোনা৷ কিচিরমিচির আওয়াজে এক টুকরো আবেগে ভেসে যাওয়া সে কতই না বৈচিত্র্যময়। সবুজ গাছের ডালে ডালে রঙবাহারি পাখিদের ভিড়। পাখিরা আপন মনে গান করে। খোলা আকাশে আনমনে উড়ে চলে৷ গাছে গাছে অপরূপ বাসা বানায়। এক একটা পাখি যেন শিল্পী হয়ে রঙ ছড়িয়ে এক একটা দিবসকে আলোকিত করে তোলে৷ কিন্তু আকাশে যদি পাখির দেখার বদলে প্লেন দেখতে হয়। সবুজ গাছে যদি শুধু পাখির বদলে কেবল পোকাদেরই দেখে মলে, তাহলে সেই দৃশ্যটি দেখতে অত্যন্ত বেমানান লাগে। 


সভ্যতা ক্রমশ নগরায়নের পথে এগিয়ে চলেছে। মানুষ ক্রমশ যান্ত্রিক হয়ে উঠছে। প্রাকৃতিক শক্তির বদলে মানুষ বেশি করে কৃত্রিম শক্তিকেই ব্যবহার করছে। আজকে আকাশের দিকে তাকালে পাখিদের দেখা নেই৷ গত কয়েক বছর আগে খাল-বিলে ঝাঁক ঝাঁক সাদা জলবকেদের ভিড় দেখা যেত। বাড়ির জানালা, বাড়ির চাল, উঠোনে শত শত চড়ুই পাখি ঘোরাঘুরি করতো৷ জঙ্গলে তিতির ও কোয়েলের মতো পাখি চোখে পড়তো। আজকে সেই সব চিত্র বদলে গেছে। জমিতে ক্রমাগত কীটনাশক প্রয়োগের ফলে বকের সংখ্যা কমে গেছে। জমিতে বিভিন্ন পাখিরা পোকামাকড় খেতে গিয়ে কীটনাশক জাত পদার্থের কারণে মারা পড়ছে। মোবাইল টাওয়ার বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে চড়ুই পাখির সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। গ্রামে চড়ুই পাখির দেখা মিললেও শহরে চড়ুই পাখি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য পাখির সংখ্যা কমছে। ইতিমধ্যেই মেটে তিতির, বাদা তিতির, গোলাপি হাঁস, বাদি হাঁস, বড় হাড়গিলা, রাজ শকুন, সবুজ ময়ূর, টিয়াঠুঁটির মতো বহু প্রাণী বাংলা থেকে হারিয়ে গেছে। পাখিদের জন্য নির্দিষ্ট সংরক্ষণের অভাবে এমনটা ঘটছে। 

যথেচ্ছ বৃক্ষনিধন, ম্যানগ্রোভ নিধন ও চোরকারবারদের কার্যকলাপের ফলে প্রত্যহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হচ্ছে মনুষ্য সমাজকে। গত কয়েকদিন আগে বাংলাতে সাইক্লোন আমফানের প্রভাবে বহু গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। এর ফলে বাসা হারিয়েছে অবলা পাখিরা৷ কোনো কোনো পাখি মারাও পড়েছে। কোনো কোনো পাখি আহত হয়ে মাটিতে কাতরাতে থাকে৷ 

বাংলাতে বহু পাখি লুপ্ত হলেও এখনও বুলবুলি, মাছরাঙা, চড়ুই, তোতা, কাক, শালিখ, বুনো হাঁসের মতো অনেক পাখিই টিকে আছে। আমফানের আক্রমণে তাদের ওপর নেমে আসে চরম বিপর্যয়। ঝড়ে পূর্ব মেদিনীপুর, উত্তর চব্বিশ পরগণা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা, হাওড়া ও কলকাতা সহ পাঁচ রাজ্যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি লক্ষ্য করা গেছে। এমতাবস্থায় হাওড়াতে পাখিদের বাঁচাতে উদ্যোগ নিয়েছে হাওড়া জেলা যৌথ পরিবেশ মঞ্চ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। হাওড়ার জগৎবল্লভপুর, বাগনান, আমতা ও শ্যামপুরের বিস্তীর্ণ এলাকাতে আমফানের আগে দলে দলে মাছরাঙা, বুলবুলি, শালিখ, কাক, তোতাপাখির বিচরণ লক্ষ্য করা যেত। আমফানের প্রভাবে নীড়হারা সমস্ত পাখির দল৷ এক টুকরো নীড়ের খোঁজে পাখিরা ফিরে আসতে চাইলেও উপায় নেই। হাওড়া জেলা যৌথ পরিবেশ মঞ্চের তত্ত্বাবধানে বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে পাখিদের জন্য নীড়। 

বিশ্ব পরিবেশ দিবসে পাখিদের জন্য এক অভিনব উদ্যোগে সামিল হাওড়া যৌথ পরিবেশ মঞ্চ। জগৎবল্লভপুরের পাতিহাল, মানসিংহপুর ও সাদেশপুরের বিভিন্ন গাছের মগ ডালে তিরিশটি বাসা বানিয়েছে তারা। মাটির কলসি দিয়ে বানানো হয়েছে বাসাগুলি৷ কলসির ভেতরে রাখা হয়েছে ডালপালা। মাটির পাত্রে বাসাটির মধ্যে জল রাখারও ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঝড়ের কবলে বহু পাখির ডানা মচকে গিয়েছিল, কেউ জলের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছিল৷ এমন  অসহায় পাখিগুলোকে সন্তানের মতো যত্ন করে সেবাশুশ্রূষা করছে তারা। ভবিষ্যতে এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণেরও দায়িত্ব নিয়েছে এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। কেবল পাখির বাসায় নয়, পাখিদের সুস্থ সবুজ-সুন্দর পরিবেশ দান করতে বহু মানুষকে গাছ দত্তক দিয়েছে তারা৷ সেই গাছগুলোরও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছে যিনি দত্তক নিয়েছেন। তাদের শর্ত হলো দত্তক গাছটিকে সন্তান স্নেহে লালন করতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে গাছটি যেন কোনো গবাদি পশুর আক্রমণে না নষ্ট হয়ে যায়৷  গাছগুলোর নিয়মিত খবর রাখবে মঞ্চ ও সাথী সংগঠনরা। গাছগুলিতে জীববৈচিত্র্যের আলাদা মাহাত্ম্য থাকবে৷ কোনো প্রকার কীটনাশক বা কৃত্রিম সার ব্যবহার করা চলবে না৷ এরকম নানান শর্তে লাগানো হয়েছে ৫০ এরও অধিক প্রজাতির গাছ। 

এই উদ্যোগের সাথে যুক্ত রয়েছেন হাওড়া জেলা যৌথ পরিবেশ মঞ্চের সভাপতি ডাঃ সৌরেন্দু শেখর বিশ্বাস, সহ সভাপতি চম্পক চক্রবর্তী, সম্পাদক শুভদীপ ঘোষ, যুগ্ম সহ সম্পাদক সম্রাট মণ্ডল, কোষাধ্যক্ষ সায়ন দে, সক্রিয় সদস্য অর্পণ দাস, মানোষ মন্ডল, প্রদীপ রঞ্জন রীত ও ডঃ সৌরভ দোয়ারি৷

পাখির বাসা বানিয়ে দেওয়ার অভিনব উদ্যোগের প্রসঙ্গে হাওড়া জেলা যৌথ পরিবেশ মঞ্চের সম্পাদক শুভ্রদীপ ঘোষ জানান "আমফান পরবর্তী তে জলার ধারে ভেঙে পড়েছিল বাসা৷ হাবুডুবু খাচ্ছিলো পাখিরা জলের মধ্যে। তাদের উদ্ধার করে কাল ওদের জন্য বানিয়ে দেওয়া হলো নতুন বাসা। ফিরিয়ে দেওয়া হলো তাদের চেনা মগ ডালে। মাটি নিয়েছে একাধিক গাছ, তার সাথে ঝড়ে আহত পাখিদের রক্ত ঝরেছে গা দিয়ে। ভেঙে গিয়েছে ডানা তাদের আমরা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছি।  অন্য সমস্ত পাখি দের জন্য আমরা কৃত্রিম উপায়ে বাসার মডেল তৈরি করেছি৷ যে মডেলে পাখির থাকার ও তৃষ্ণা মেটানো সবরকম উপায় আছে।" 

প্রতিবেদন- সুমিত দে

No comments