Header Ads

নজরুলের স্মৃতিধন্য ত্রিশালে একদিন


ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তাঁকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয়। প্রথমে যোগ দেন বাসুদেবের কবি দলে। এর পর একজন খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা এবং সবশেষে আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন। এভাবে বেশ কষ্টের মাঝেই তাঁর বাল্য জীবন অতিবাহিত হতে থাকে। এই দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের দারোগা কাজী রফিজ উল্লাহসাথে তার পরিচয় হয়। দোকানে একা একা বসে যে সব কবিতা ও ছড়া রচনা করতেন তা দেখে রফিজউল্লাহ তাঁর প্রতিভার পরিচয় পান। তিনিই তাঁকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। বন্ধুরা এতক্ষণে আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি কার কথা বলছি। আমি বলছি আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথা।



অনেক দিন ধরে প্ল্যান করছি আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতি ধন্য ত্রিশালে ঘুরে আসবো। আমার ছোট ভাই পিকু আসল নাম স্বপ্ন দীপ মজুমদার অনেক দিন ধরে বলছিল ওর এখানে যেতে,ময়মনসিংহে নটরডেম কলেজে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র পিকু ও বলেছিল ত্রিশালের কবির স্মৃতি বিজড়িত স্মৃতি জাদুঘর শুক্র, শনি বার বন্ধ থাকে তাই অফিস থেকে একদিনের ছুটি নিলাম ৭ ই আগষ্টএদিকে মনে মনে সঙ্গী খুঁজছিলাম কাকে নেওয়া যায়, সাথে কাউকেই পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ বিকেলে পিকু আমাকে ফোন দেয় ও ঢাকায় এসেছিল কাজে। ওকে যেন নিয়ে কাল ময়মনসিংহ যাই আর আমার কাছে সাপে বরের মতই কারণ একা একা ট্রেন জার্নি ভাল লাগে না। সকাল ৭ টা ২০ মিনিটে আমি কমলাপুর রেল ষ্টেশনে পৌঁছে পিকুর জন্য অপেক্ষা করছি। গন্তব্য তিস্তা এক্সপ্রেস করে ময়মনসিংহ ৭টা ২৫ মিনিটে পিকুর দেখা নাই মোবাইলে কল দিচ্ছি বার বার কিন্তু কল রিসিভ করছে না। আমি মনে মনে ভাবছি আজ বোধহয় আমাকে একাই যেতে হবে। ময়মনসিংহে শেষ পর্যন্ত পিকুর দেখা মিলল ও দৌড় দিয়ে আসছে আমি কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। আমাদের ধারণা ছিল আমাদের বাংলাদেশ রেলওয়ে সেই আগের মত সময়ের থেকে আধা ঘণ্টা এক ঘণ্টা দেরি করে ছাড়ে কিন্তু আমাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হল আমাদের ট্রেন ঠিক ৭টা ৩০ মিনিটে আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করলো। ট্রেন তার কু ঝিক ঝিক ছন্দে এগিয়ে চলছে। এয়ার পোর্ট ষ্টেশন পেরিয়ে এগিয়ে চলছে। অল্প কিছুক্ষণের পরে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু হলো ট্রেনে বসে আমরা বৃষ্টি কে উপভোগ করছি। গফরগাঁও ষ্টেশনে এসে আমাদের ট্রেন দ্বিতীয় বার এর মতো থামলো এদিকে আমাদের পেটে রাম রাবণের যুদ্ধ শুরু হয়েছে। অগত্যা গফরগাঁও ষ্টেশনে গরম গরম সিঙ্গাড়া খেলাম এতটাই গরম যে জিভ পোড়ার যোগাড়। দেখতে দেখতে আমরা এসে পৌঁছালাম ময়মনসিংহ ষ্টেশনে। আমাদের কে ট্রেন নামিয়ে দিয়ে ট্রেন ছুটে চললো তার পরবর্তী গন্তব্য দেওয়ানগঞ্জ এর দিকে। আমরা ট্রেন থেকে নেমে রিক্সা ঠিক করলাম ত্রিশাল বাস স্ট্যান্ডে যাবার জন্য। 




আমাদের ব্যাটারি চালিত রিক্সা তুফানের গতিতে এগিয়ে চলছে আর আমি উপভোগ করছি। ময়মনসিংহ শহরকে বেশ ঘিঞ্জি শহর অফিস খোলার দিন থাকায় রাস্তায় বেশ জ্যাম। গাঙ্গিনার পাড়, সি কে ঘোষ রোড, সেহড়া ঢাকা রোড দিয়ে এগিয়ে চলছি। ত্রিশাল বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে আমরা পদ্মা গেট লক সার্ভিসের বাসে উঠলাম প্রায় বিশ মিনিট পর। বাস আমাদের বইলর নামক স্থানে নামিয়ে দিল। এর পর বাস থেকে নেমে আমরা ব্যাটারি চালিত অটো করে পৌঁছে গেলাম আমাদের  বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর স্মৃতি ধন্য দারোগা বাড়িতে। 



গেইট পেরিয়ে আমরা ভেতরে প্রবেশ করে দেখি নজরুল স্মৃতি কেন্দ্রে তালা ঝুলছে সাথে সাথে হাতের ঘড়ি দেখি তখন মাত্র বারোটা বাজে। আর কোনো বন্ধ বার না যে বন্ধ থাকবে মনটা খুব খারাপ লাগছিল। অগত্যা আমরা আসে পাশে ঘুরে দেখছিলাম। আর মনে মনে কোন লোক পাওয়া যায় কিনা দেখছিলাম শেষ পর্যন্ত পুকুর পাড়ে গিয়ে দেখা মিলল এক মানবের। উনি বললেন এই স্মৃতি কেন্দ্রের কেয়ার টেকার দিনের বেশির ভাগ সময়ই তালা মেরে ঘুমিয়ে থাকেন। বুঝি আল আমিন বলে ডাক দেন উনি আসবেন। আমরা চিৎকার করে ডাকা শুরু করলাম কোন সাড়া শব্দ নাই। আমরা ও নাছোড়বান্দা শেষ পর্যন্ত ওই ভদ্র লোক একজনের মোবাইল নাম্বার দিলেন। বললেন ওনার সাথে কথা বলেন। ফোন দেওয়ার পর মোবাইলের ওপর পাশের লোক কে বললাম আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। উনিই বললেন আপনারা কিছু সময় অপেক্ষা করেন আমি লোক পাঠাচ্ছি। আমাদের ও দাঁড়িয়ে থাকতে আর ভাল লাগছিল না পরে সামনের চা স্টলে গিয়ে চা খেলাম দেখা হল ওই অঞ্চলের প্রবীণ ব্যক্তি রহিম সাহেবের সাথে। উনি বলছিলেন অনেকবছর পার হলেও ভবনটিতে প্রয়োজনীয় লোকবল না থাকার কারণে ভবনের সার্বিক কাজে অসুবিধার সৃষ্টি হচ্ছেপ্রায় আধ ঘণ্টার পর দেখা মিললো এক জন আপা আসছেন তিনিই জিগ্যেস করলেন আপনারা কি ঢাকা থেকে এসেছেন? আমরা হ্যাঁ বললাম উনি পরিচয় জানতে চাইলে বললেন ওনার নাম ইন্নি, তিনি কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি ডিপ্লোমা তে শেষ বর্ষের ছাত্রী, উনিই আমাদের কে পুরো এলাকা ঘুরিয়ে দেখালেন। উনি বলছিলেন ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে জাতীয় কবির জন্মদিন উপলক্ষে প্রদত্ত বাণীতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বলেছিলেন, নজরুল বাংলার বিদ্রোহী আত্মা ও বাঙালির স্বাধীন ঐত্যিহাসিক সত্তার রূপকার। ১৯২৯ সালে ১৫ ডিসেম্বর কলকাতা আ্যালবার্ট হলে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে দেওয়া জাতীয় সংবর্ধনা সভায় প্রদত্ত মানপত্রের জবাবে নজরুল বলেছিলেন, সুন্দরের ধ্যান, তাঁর স্তবগানই আমার উপাসনা আমার ধর্ম। যে কুলে যে সমাজে যে ধর্মে যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি সে আমার দৈব। আমি তাঁকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই আমি কবি। নজরুলের এ ধরনের বলিষ্ঠ উচ্চারণ নিয়ে গবেষণার সহযোগী ক্ষেত্র এখন এই পাঠাগার। এখানে কবি নজরুল যে ঘরটিতে থাকতেন সেটি পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। 



কবি তাঁর কবিতা গানে যে সকল গাছের নাম উল্লেখ করেছেন সেই গাছগুলো দিয়ে নজরুল স্মৃতি কেন্দ্রে ব্যতিক্রমধর্মী দৃষ্টিনন্দন বৃক্ষ বাগান তৈরি করা হয়েছে। এখানে কবি যে পুকুরে গোসল করতেন সেটিও সংরক্ষণ করা আছে। বিলের পাড়ে একটি বট গাছের নীচে কবি নজরুল আপন মনে বাঁশিতে সুর তুলতেনএটি এখন নজরুল বটবৃক্ষ। দুই বাংলার নজরুল ভক্তদের কাছে এটি তীর্থ স্থানের মর্যাদা পেয়েছে। বটের নিচে প্রায়ই বসে কবিদের আসর। আজ কবি নেই কিন্তু এই বট গাছটি আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে কবির অস্তিত্ব ঘোষণা করছে। এখানকার মনোরম পরিবেশ পর্যটকদের মোহিত করবে। নীচ তালায় ময়মনসিংহ ত্রিশালে অবস্থান কালে যে খাটে ঘুমোতেন কবির সে খাটটি রয়েছে সাথে রয়েছে মিলনায়েতন, দ্বিতীয় তলায় উঠে আমরা দেখা পেলাম কবির বিভিন্ন ধরনের ছবি যা যে কাউকেই মুগ্ধ করবে। সাথে লাইব্রেরীর দেখা পেলাম। প্রায় কয়েক হাজার বই আছে এই লাইব্রেরীতে এখানে যত্ন সহকারে রয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের স্বহস্থে লিখিত বই, নজরুল জীবন নিয়ে লেখা বই, নজরুলকে নিয়ে সমালোচনা করা সহ বিভিন্ন গানের রেকর্ড। কবির ওপর বই ছাড়াও সমসাময়িক লেখক দের বইও আছে এখানে। এর পর আমরা গেলাম ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ডের পাশেই নজরুল একাডেমী। 



কবির স্মৃতিবিজড়িত দরিরামপুর হাই স্কুলই বর্তমানে নজরুল একাডেমী। এই স্কুলে কবি ৭ম ও ৮ম শ্রেণিতে লেখাপড়া করেছেন। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার খাতায় নজরুল লিখেছিলেন আমি এক পাড়া গাঁয়ে স্কুল-পালানো ছেলে, তার উপর পেটে ডুবুরি নামিয়ে দিলেও '' অক্ষর খুঁজে পাওয়া যাবেনা। স্কুলের হেডমাস্টারের চেহারা মনে করতেই আজও জল তেষ্টা পেয়ে যায়। কবির স্মৃতিকে ধরে রাখতে কবির সেই ক্লাস রুম ও দেয়ালে এই কবিতার লাইন খোদাই করে সংরক্ষণ করা আছে। স্কুল মাঠের পাশেই রয়েছে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে নজরুল মঞ্চ ও শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত আধুনিক রেস্ট হাউস। দেখতে দেখতে আমাদের বিদায়ের সময় চলে এলো আমরা আবার ৫ টা ২০ এর তিস্তা এক্সপ্রেস করে ফিরে গেলাম সেই চির চেনা শহর পানে।



কীভাবে আসবেনঃ 

ঢাকার মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে ভোর ৫টা থেকে প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে সৌখিন, এনা, নিরাপদ বাস ছেড়ে আসে। টিকেটের মূল্য ২২০ টাকা। সময় লাগবে ২ ঘণ্টা অথবা সকাল ৭টা ৩০ মিনিটের তিস্তা এক্সপ্রেস করে ময়মনসিংহে ঘুরে আবার ৫ টা ২০ মিনিটের ট্রেনে ফিরে যেতে পারেন ঢাকাতে ট্রেন এর ভাড়া ১২০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা। 







No comments