বিদ্যের জাহাজ হয়ে শতাব্দীর রণতরী পার করলেন অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায়
বাংলাতে একটি প্রবাদ খুব প্রচলিত 'শেষ নেই যার, বাংলায় তার সার।' যে প্রবাদটি বাঙালি সম্পর্কে নিখুঁত বার্তা দেয়। বাংলা যে প্রতিভার আঁতুড়ঘর এ কথাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। যুগে যুগে বাংলার ঘর আলো করে জন্ম নিয়েছেন শত শত মনীষী। কেউ বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বসভায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন, কেউ বিজ্ঞানে বাংলার মুখ উজ্জ্বল করেছেন, কেউ বা চলচ্চিত্রে বাংলার সম্মান বৃদ্ধি করেছেন। বাংলাতে কোনোকালে প্রতিভার অভাব ছিলনা, আজও নেই। বাঙালির ইতিহাস নাড়াচাড়া করলে দেখা মেলে একগুচ্ছ বঙ্গ দামালদের নাম৷ বাংলাতে শত শত মনীষী জন্মানোর পরও আমরা বিস্তৃতির অতলে ঠেলে দিই বেশিরভাগ মনীষীদের। যেমন আজ নিঃশব্দে পার হতে চলেছে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক, অধ্যাপক ও গবেষক অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায়ের শততম জন্মবার্ষিকী।
১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ৩রা জুন উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার বনগাঁ মহকুমার নকফুলে জন্মগ্রহণ করেন তিনি৷ দেশে-বিদেশে তখন স্প্যানিশ ফ্লুর দাপট চলছে। চারিদিক মহামারির আকার নিয়েছে। একদিকে পরাধীন ভারত, ব্রিটিশ শাসন অন্যদিকে স্প্যানিশ ফ্লুর সংক্রমণ। এমন একটি অস্থির পরিস্থিতিতে জন্ম তাঁর৷ আজকে তাঁর শততম জন্মবার্ষিকীর প্রাক্কালেও অচেনা এক ভিনদেশী ভাইরাসের আতঙ্কে সময়টা হয়ে উঠেছে কঠিন৷
অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কীর্তি হলো তাঁর রচিত সমস্ত লেখনী। বাঙালি সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজ, ধর্ম ও দর্শন নিয়ে তিনি বিস্তর গবেষণা করেছিলেন। তাঁর লেখা অন্যতম গ্রন্থ হলো 'বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত'। এই গ্রন্থটি নয়টি খণ্ডে প্রকাশিত হয়। যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থ। এছাড়াও বাংলার নবজাগরণ নিয়ে তিনি লিখেছেন খানকয়েক গ্রন্থ যেমন 'বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর', 'সাহিত্য জিজ্ঞাসায় রবীন্দ্রনাথ', 'হাওড়া শহরের ইতিহাস' এবং 'ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ ও বাংলা সাহিত্য'। নিজস্ব লেখনী ছাড়াও তিনি কতগুলো গ্রন্থও সম্পাদনা করেন। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থগুলির মধ্যে 'জীবনের গল্প গল্পের জীবন', 'বিদ্যাসাগর রচনাবলী', 'সঞ্জীব রচনাবলী' ও 'শ্রেষ্ঠ গল্প শ্রেষ্ঠ লেখক'। গ্রন্থ রচনা ও সম্পাদনা বাদেও তিনি 'বিস্মৃতির দর্পণ' নামে একটি আত্মকথাও লিখেন৷
সেকেলের কলকাতার মানুষ তাঁকে বিদ্যের জাহাজ বলে সম্বোধন করতেন৷ তাঁর পাহাড়-প্রতিম কীর্তি, তাঁর গ্রন্থাবলী সারস্বত সমাজে বিশেষ শ্রদ্ধার আসন অধিকার করেছিল৷ তিনি মানুষ হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক ও রসিক৷ তিনি রসিকতা করতে বেশ পছন্দ করতেন। তিনি বাঙালিদের শতবর্ষ বেঁচে থাকার প্রসঙ্গে একটি কথা প্রায়শই বলতেন যে 'আমরা যারা হাওড়া থেকে কলকাতা শাসনের চেষ্টা করি, আমাদের পরমায়ু টেন পার্সেন্ট সাবসিডির যোগ্য'। মানে নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে বিষাক্ত হাওয়া, ট্র্যাফিক জ্যাম ও হাওড়া ব্রিজের দৈনন্দিন ব্যথা হাসিমুখে সহ্য করে জীবিত থাকলে এই শতবর্ষে আমরা তাঁর বয়স ১১০ বছর ঘোষণা করতাম৷ তিনি এও বলছেন 'অমন যে রবীন্দ্রনাথ, যিনি অনন্তকাল রাজত্ব করবেন, তিনিও নার্ভাস হয়ে আবেদন করে ফেললেন, আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি?' তিনি সশরীরে একশো বছর পূর্ণ না করতে পারলেও তাঁর কীর্তি সগৌরবে শতাব্দীর রণতরী পার করেছে৷
অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায়ের জন্ম বনগাঁ মহাকুমার নকফুলে হলেও তাঁর শৈশবকাল কেটেছে হাওড়াতে। বয়স যখন পাঁচ তখন তাঁর পরিবার নকফুল ছেড়ে উঠে আসে হাওড়াতে অর্থাৎ ১৯২৫ সালে। ১৯৩৮ সালে হাওড়া জিলা স্কুল থেকে বাংলাতে ৭৭ শতাংশ নম্বর নিয়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় হাওড়া জেলার বাংলা বিষয়ে প্রথম স্থানে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন তিনি। অধুনা সুরেন্দ্রনাথ কলেজ যার প্রাচীন নাম রিপন কলেজ, এই কলেজ থেকে আই.এ পরীক্ষায় বাংলা ও আসামের পরীক্ষার্থীদের মধ্যে তিনি প্রথম স্থান দখল করেছিলেন৷ এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে বি.এ ও এম.এ উভয় পরীক্ষাতে স্বর্ণপদক লাভ করেন তিনি৷ কলেজ জীবনে পাঠরত অবস্থায় তিনি সুভাষচন্দ্র বসুর ইংরেজি বক্তৃতাগুলো বাংলায় অনুবাদ করে ফরোয়ার্ড পত্রিকায় প্রকাশ করতেন৷ ফরোয়ার্ড পত্রিকা ছাড়াও তিনি দেশ ও অদ্বৈত মল্লবর্মণের 'নবশক্তি' পত্রিকায় গল্প প্রকাশ করতেন৷ এম.এ উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন৷ তারপর কিছুদিন সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ও পরবর্তীকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন৷ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অধ্যাপক হয়েছিলেন তিনি৷ এরপর ১৯৮৫ সালে অধ্যাপনা থেকে অবসর নিয়ে শেষজীবনে বাংলা সাহিত্য অ্যাকাডেমির সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করেন। সাহিত্য অ্যাকাডেমির দেকভাল করার সাথে সাথে এশিয়াটিক সোসাইটিতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গবেষকের দায়িত্বও সামলাতেন।
বাংলার প্রবাদপ্রতিম মহাপুরুষদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বেসর্বা। আজ শতবর্ষে পদার্পণ করলেন তিনি ৷



Post a Comment