Header Ads

অবসর সময়ে নিজেকে নিয়ে সময় কাটানোর সঠিক বই 'উটকপালে স্মৃতি'


পুরানো দিনের কথা ভাবতে আমাদের সবারই ভালো লাগে। আমাদের ব্যস্ত জীবনে অনেক কিছুই আমরা হারিয়ে ফেলি। আবার সেই হারিয়ে ফেলা বস্তুগুলোকে হাতড়ে খোঁজারও চেষ্টা করি। বয়সের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয় অনেক কিছুই। সেটা আমাদের বাড়ির পরিবেশ হতে পারে কিংবা আমাদের সমাজও হতে পারে। জীবনের চলার পথে সবকিছুকেই মেনে নিতে হয়। বর্তমানে সারা পৃথিবী জুড়ে ভর করেছে এক অজানা মারণ ভাইরাস। যে ভাইরাস আসার ফলে আমরা পরিচিত হলাম লকডাউন বলে একটি ইংরেজি শব্দের সাথে। এই লকডাউনে মানুষের কাছে অবসর সময়ের অভাব নেই বললেই চলে। লকডাউনে অবসরকে কাজে লাগিয়ে একটা আস্ত বই লিখে ফেললেন লেখক প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত। কলমের আঁচড়ে তিনি বইয়ের পাতায় বন্দী করলেন নিজের শৈশব ও যৌবনকালের নানান স্মৃতি। 


লেখক বইটির নাম রেখেছেন 'উটকপালে স্মৃতি'৷ এ নামটিতেই একটা পুরানো সময়ের কথকতা লুকিয়ে রয়েছে। পুরানো দিনের কথাগুলোকে তিনি গল্পের আকারে কয়েকটি ভাগে সাজিয়েছেন। যেমন স্কুল পালিয়ে ছবিঘরে, ক্যাসেটের দিনগুলো, সার্ভিস প্রিভি, ভরসা থাকুক বনধের দিন, সঙ সাজা, কেন তোমরা তাদের ডাকো, ভোট-টোটের ব্যাপার, বিসর্জনের নাচ, ঘুড়ি আর বাজি ও রেজাল্টের দিন প্রভৃতি। লেখকের পুরানো দিনগুলোর গল্পগুলো ভাবুক প্রকৃতির মানুষদের যথেষ্ট মুগ্ধ করবে। শুধু ভাবুক বলাও ভুল হবে, যে-কোনো রসবেত্তা মানুষের ভালো লাগবে লেখকের পুরানো দিনের গল্পগুলো। এই গল্পগুলো কেবল নিছকই সাধারণ গল্প কিন্তু নয়, এ গল্পগুলো হলো সাহিত্যের চোখ দিয়ে জীবনদর্শন। 

লেখকের পুরানো দিনের সাথে চলমান দিনকালের যে প্রবাহ সেগুলোকেও প্রতিফলিত করা হয়েছে। মান্ধাতার আমলের অনেক জানা-অজানা কথা, সামাজিক রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান, উৎসব, কালচার প্রভৃতি যাবতীয় বিষয় বিশদে জানা যাবে এই বইটির মাধ্যমে। আমাদের শৈশবের সাথেও অনেক ঘটনার মিল রয়েছে এই বইতে। অবসর সময়ে নিজেকে নিয়ে সময় কাটানোর সঠিক বই হলো 'উটকপালে স্মৃতি।' বইয়ের প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা অবধি নজরকাড়া। রঙিন ও সাদা-কালো ছবির মিশেলে খুব সুন্দরভাবে অলঙ্কৃত করা হয়েছে বইটিকে।

'উটকপালে স্মৃতি' বইটির প্রসঙ্গে লেখক প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত জানান "অবসর-ধাঁচের জীবনে দেখলাম প্রায়ই পুরানো দিনের কথাগ‌ুলি মনে পড়ে যায়। তবে যে-কথাগ‌ুলি স্মৃতিতে বেশি করে ফিরে আসে, সেগ‌ুলি আমার কাছে না-হলেও কারও কাছে অপ্রিয় হতে পারে। সেই সব স্মৃতির কথা লেখার মতো বুকের পাটা দেখলাম এখনও তৈরি করতে পারিনি। তার মধ্যে থেকেই ঝাড়া-বাছা করে যতটুকু লেখার সাহস কােনোক্রমে সঞ্চয় করা গেল, সেই ‘উটকপালে স্মৃতি’গ‌ুলির একাংশ লিখে রাখলাম। আর তার অনেকটা দিয়ে রাখলাম 'সামাজিক মাধ্যমে', সোশ্যাল মিডিয়াকে বাংলায় বোধহয় তা-ই বলে। লকডাউেনর ফাঁড়া কাটলে এর একটা মুদ্রিত সংষ্করণের কথাও ভাবা যাবে।"

এই বইয়ের কয়েকটি কথা না লিখলেই নয়, অধ্যায়ে ব্যবহৃত দু'একটা ঘটনা বলে রাখা ভালো। স্কুল পালিয়ে ছবিঘরে অধ্যায়টি পড়লে অনেকের বায়োস্কোপে ছবি দেখার কথা মনে পড়ে যেতে পারে। ছেলেবেলাতে ছবি দেখতে যাবার ব্যাপারটিকে তিনি উৎসবের সাথে তুলনা করেছেন৷ বাড়ির অনুমতি নিয়ে নতুন ছবি দেখতে যাওয়ার আলাদা স্বাদ ও ইচ্ছের কথাও তিনি যত্ন সহকারে বর্ণনা করেছেন। স্কুল পালিয়ে ছবিঘরের পরের অধ্যায় হলো ক্যাসেটের দিনকাল। যে অধ্যায়ে লেখক বলছেন "স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে পৌঁছতে না পৌঁছতেই দেখলাম রেকর্ডের যুগ শেষ হয়ে ক্যাসেটের দিন চলে এসেছে।" এরপর পরবর্তী অধ্যায় সার্ভিস প্রিভিতে লেখক লিখছেন "কেউ বলত ডাবা। কেউ বলত চাড়ি। জিনিসটা হলো একটি বিশাল মাটির গামলা, যা রাখা থাকত খাটা পায়খানার নীচে। বর্জ্য জমা হওয়ার জন্যে। এভাবেই ধারাবাহিক ভাবে অধ্যায়ের ভিত্তিতে নিজের স্মৃতিচারণা করেছেন তিনি।" 

লেখকের পুরানো দিনগুলোর সঙ্গে যেমন উৎসব, ছাত্রজীবন, দিনযাপনের পাঁচালী লক্ষ্য করা যায় তেমনই তাঁর সাথে জড়িত বহির্জগতের কথাও তিনি তুলে ধরেছেন৷ সেই বহির্জগতের সাথে জড়িত ভরসা থাকুক বনধের দিন ও ভোট-টোটের ব্যাপার অধ্যায়টি। যেখানে খানকয়েক ঘটনার উল্লেখ আছে, তার মধ্যে একটি অধ্যায় তুলে ধরছি৷ "একবার তো কিড স্ট্রিটের এম-এল-এ হােস্টেলে এক বিধায়কের হত্যার প্রতিবাদে বন্ধ-টন্ধ হওয়ার পর দেখা যায় লোকটিকে খুন করিয়েছে তার স্ত্রী। তখন এক ধরনের মজার বন্ধও দেখেছি। যারা সরকার গড়েছে, বন্ধ ডাকছে সেই রাজনৈতিক দলই। কতকটা যেন 'ছায়ার সাথে যুদ্ধ করে গাত্রে হলো ব্যথা।' কিংবা "দশ-পনেরো বছর আগেও কথায়-কথায় বনধ ডাকার একটা রেওয়াজ ছিল।" অথবা "সেই দিনগ‌ুলিতে বোমাবাজি লেগেই থাকত। শব্দ শোনা যেত যখন-তখন। আওয়াজ কোন্ দিক থেকে আসছে আন্দাজ করে কোথায় গণ্ডগোল লেগেছে, বোঝার চেষ্টা করতেন অনেকে। শ‌ুনতাম, তখনকার মার্ডারগ‌ুলো বেশিরভাগ করা হত ছুরি, চপার, ভোজালি, বা কদাচিৎ দেশ পিস্তল ব্যবহার করে। সাইকেলের ফ্রেম কেটে বার করা পাইপকে নল বানিয়ে নাকি একরকম বন্দুক তৈরি হত হাওড়ার লোহার কারখানায়। তার চলতি নাম ছিল পাইপগান।" এগুলো বাদেও বাকী অধ্যায়গুলোও চমকপ্রদ। 

আবহমান সময়ে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত শরীরে একটু প্রাচীনত্বের ছাপ দিতে সকলেরই পড়া উচিৎ এই বইটি। লেখক দক্ষতার সাথে অদ্ভুত ভাবে এই বইটি সৃষ্টি করেছেন। এই বইটি কোনো গল্পগ্রন্থ বা উপন্যাস নয়, আক্ষরিক অর্থে বলা যায় এটি একটি আত্মকথামূলক পুস্তক৷ করোনার আবহে এমন একটি বই সকল বইপ্রেমী মানুষদের উপহার দেওয়ার জন্য  লেখককে শতকোটি কুর্নিশ। 

প্রতিবেদন- সুমিত দে




No comments