Header Ads

কয়লা শ্রমিক থেকে শিশুসাহিত্যিক হয়ে ওঠা হাবীবুর রহমান আজ বিস্তৃতির পথে


কবি হাবীবুর রহমান অধুনা প্রায় বিস্তৃত একটি নাম৷ অথচ পঞ্চাশ-ষাটের দশকে তিনি শিশুসাহিত্যিক হিসেবে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর জীবনের একটা অদ্ভুত মোড় রয়েছে, তা হলো কয়লা খনির শ্রমিক থেকে তিনি একজন শিশুসাহিত্যিক হয়ে ওঠেন। আর্থিক-অভাব অনটনের মধ্যেও তিনি মাথা উঁচু করে সমাজে গুরুত্ব লাভ করেন ৷ 


হাবীবুর রহমান সৃষ্টিশীল লেখক হিসেবে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন৷ তিনি কবিতা, শিশুসাহিত্য, উপন্যাস, রূপকথা ও জীবনীগ্রন্থ সহ সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করেছেন৷ তাঁর জীবদ্দশায় তিনি রচনা করেছেন উপাত্ত নামের একটি কাব্যগ্রন্থ, আগডুম-বাগডুম (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড), সাগর পারের রূপকথা, বিজন বনের রাজকন্যা, লেজ দিয়ে যায় চেনা, বনে বাদাড়ে, পুতুলের মিউজিয়াম, গল্পের ফুলঝুরি, হীরা মতি পান্না ও বনমোরগের বাসার মতো শিশুসাহিত্য এবং চীনা প্রেমের  গল্প, জন কেনেডি, জীবনের জয়গান, পাল তুলে দাও এর মতো অনুবাদ সাহিত্য। 

শিশুসাহিত্যিক হাবীবুর রহমান ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট থানার পালিশ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে তিনি প্রবেশিকা পাস করেন। পরবর্তী কালে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। তবে আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে থেমে যায় তাঁর পড়াশোনা। পরিবারের আর্থিক সংকট কেড়ে নিয়েছিল তাঁর পড়াশোনার সুযোগ। অভাবের অত্যাচারে সৃজনশীলতা বর্জন করে কঠিন জীবন তাঁকে মেনে নিতে হয়েছিল৷ 

১৯৪৩ সালে কয়লা শ্রমিক হিসেবে আসানসোল কয়লাখনিতে কর্মজীবনের সূত্রপাত ঘটান৷ এক থেকে দেড় কিলোমিটার ভূগর্ভে পঞ্চাশ ডিগ্রিরও বেশি তাপমাত্রায় কাজ করতে হয় কয়লা শ্রমিকদের। কয়লা খনির আঁতুড়ঘর যেন ইঁদুরের গর্ত৷ ফুটিফাটা গরম, কয়লা ধ্বসের সম্ভাবনা, অগ্নিকাণ্ডের ভয় ও মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে শ্রমিকদের কাজ করতে হয়৷ এক একজন মানুষের জীবন এতোটাই কঠিন হয়ে পড়ে যে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েও তাঁকে বাঁচার রাস্তা খুঁজে নিতে হবে। জীবন-মরণ তুচ্ছ করে কলকারখানাতে শ্রমিকেরা কাজ করে দিনরাত। খাঁটুনি বেশি, আয় কম এটাকেও তাদের মেনে নিতে হয়৷ শরীরের ক্ষমতা না থাকলে শ্রমিকের কাজ চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। আর তাঁর সময়ে ব্রিটিশ শাসন, পরাধীন দেশ। ফলে শ্রমিকের কাজ আরো বেশি শক্ত ছিল।তিনি অল্প আয়ে মৃত্যুভয় ত্যাগ করে কষ্টকে হাসিমুখে মেনে নিয়ে পরিবারের জন্য কাজ করেছেন। 

কয়লা শ্রমিকের কাজ করলেও তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, কারণ তিনি কলকাতার এক মডেল হাইস্কুলে শিক্ষকতার সুযোগ পান। এই সুযোগ তাঁকে আলোর নীচে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছিল৷ ১৯৪৭ সালে তিনি যোগ দেন দৈনিক আজাদ পত্রিকায়। এই পত্রিকা একসময় ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। ঢাকাতে দৈনিক আজাদ পত্রিকা স্থানান্তরিত হওয়ার পর তিনি এ পত্রিকার সহ-সম্পাদকের দায়িত্ব পান। কাজেই কর্মসূত্রে তিনি ঢাকাতে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। এরপর তিনি দৈনিক সংবাদ, সাপ্তাহিক কাফেলা, মাসিক সওগাত ও মহিলা সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকায় তাঁর পদোন্নতি ঘটে। পত্রিকার সম্পাদনার পাশাপাশি তিনি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। তিনি সিলভার বার্ডেট, ইউসিস, ফ্রাঙ্কলিন বুক পোগ্রামসের মতো সংস্থায় বইয়ের অনুবাদ সম্পাদকের কাজ করেন। বাংলাদেশের জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি৷ 

শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার অর্জন করেছেন। কবি হাবীবুর রহমান ১৯৭৬ সালের ১৭ ই জুন প্রয়াত হন। বাংলাদেশে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্য প্রতি বছর সাহিত্যে 'কবি হাবীবুর রহমান শিশুসাহিত্য' পুরস্কার প্রদান করা হয়। বাংলাদেশে হাবীবুর রহমান সম্পাদিত ছোটদের সাহিত্য পাতা থেকেই জন্ম নিয়েছে খেলাঘর আসরের মতো ঐতিহ্যবাহী জাতীয় শিশুকিশোর সংগঠন। বাঙালির শৈশবকালকে তিনি ছড়ার মেলাতে ভরিয়ে দিয়েছেন। বাংলা ও বাঙালির ঘরে এমন মানুষই বারংবার জন্মাক যাদের ছোঁয়াতে ধন্য হবে মানব সমাজ।


তথ্যসূত্র- কালের কণ্ঠ, বাংলাপিডিয়া, প্রথম আলো ও নবদিগন্ত

No comments