প্রবাদপ্রতিম এক বিজ্ঞান অধ্যাপকের কথা
১৯৩৯ সাল।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গড়া বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগে যোগ দিলেন এক নামজাদা বিজ্ঞানের অধ্যাপক। যোগ দিয়েই তিনি সবাইকে মাত করে দিতে চাইলেন। যেমনটা, করেছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞান পড়ানোর ক্ষেত্রে। তো, সেই অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথের সমস্ত লেখা ‛রবীন্দ্রনাথ রচনাবলী’ নামে প্রকাশ করতে চাইলেন অধ্যাপকের কি দুঃসাহস! কেননা তখন পৃথিবীর বেশ অস্থির অবস্থা। একে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে, সারা ইউরোপ জুড়ে বিশেষ করে জার্মানিতে হিটলারি তাণ্ডব। এর মাঝে আবার গ্রন্থনবিভাগের সেরকম অর্থও নেই। এর আগে, কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা ওই অধ্যাপক মহাশয়েরই ছাত্র বিশিষ্ট পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্তচন্দ্র মহালনবীশের উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সে সমস্ত বইয়ের চাহিদা বাজারে বেশি ছিল না। এসবের পরেও কিনা অধ্যাপক মহাশয় চাইলেন ‛রবীন্দ্র রচনাবলী’ প্রকাশ করতে! এই দুঃসাহসিকতার কথা শুনে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো বলেই বসলেন, "এইবার গ্রন্থন বিভাগ ডুববে।" কিন্তু, বাস্তবে হল এর ঠিক উল্টো। গ্রন্থন বিভাগ ডুবেনি, বরং বলা যায় ফুলে ফলে আরও পল্লবিত হয়েছে। আর ‛রবীন্দ্র রচনাবলী’-র ছাব্বিশ খণ্ড আজ মোটামুটি বাংলার সব বাড়িতে এমনকি বিদেশেও এসবের ইংরেজি অনুবাদ শোভা পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, রবীন্দ্র রচনাবলী এক অভিজাত্যের নিদর্শনও বটে বিশেষ করে সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে তো বটেই। এই রবীন্দ্র রচনাবলীর মাধ্যমেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যেন আমরা ফিরে পাই। তাই এক সেট রবীন্দ্র রচনাবলীর চাহিদা কেমন তা নতুন করে আর বলতে হবে না।
আর কে এই অধ্যাপক? যাঁকে নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। এই অধ্যাপক মহাশয়টি হলেন চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য। তাঁর শরীরটা ছিল রোগা, মাথাটা ছিল উঁচু। আর পরতেন মোটা ফ্রেমের চশমা। তিনি রোজ ভোর চারটের সময় ঘুম থেকে উঠতেন। বাঙালি বা ভারতীয় হয়েও, তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী। কোন ব্যাপারে? না তিনি ব্রিটিশদের মতোন ঘড়ি ধরে সব কাজ করতেন। এক চুলও এদিক ওদিক হত না। আর তাই তাঁকে দেখে ঘড়ির কাঁটা মেলানো যেত।
বিশ্বভারতীর গ্রন্থন বিভাগ থেকে প্রকাশিত হত 'বিশ্ববিদ্যা সংগ্রহ' এবং 'লোকশিক্ষা' গ্রন্থমালা। এই দুই গ্রন্থমেলার উদ্দেশ্য ছিল মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সাথে সাধারণ মানুষ বিশেষত স্কুল-কলেজের বিদ্যার্থীদের পরিচয় করানো। এর মূল পরিকল্পনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হলেও, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য দায়িত্ব নেওয়ার পরেই এই দুই গ্রন্থমালা সিরিজের বইগুলো প্রকাশিত হয়। তবে, লোকশিক্ষার প্রথম বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একমাত্র বিজ্ঞান গ্রন্থ 'বিশ্বপরিচয়'। বাংলা বিজ্ঞান সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে পরিচিত এই বিজ্ঞান গ্রন্থটি ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে (১৯৩৭ সালে) প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটি বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে উৎসর্গ করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিগুরুর প্রয়াণ হয়েছিল ১৯৪১ সালে। এর দু’বছর পরে চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য 'বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ' গ্রন্থমালার কাজ শুরু করেছিলেন। সাধারণ মানুষ বিশেষ করে পড়ুয়াদের মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার পরিকল্পনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়েছিলেন। তাঁর সেই পরিকল্পনা বা স্বপ্নকে রূপ দিয়েছিলেন কিংবা বলা ভালো সার্থক করেছিলেন চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য। এই সিরিজের প্রথম বই ছিল তাঁরই যা তাঁর অন্যতম প্রিয় স্যার বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুকে নিয়ে লেখা। বইটির নাম 'জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কার' যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৫০ বঙ্গাব্দের(১৯৪৩ সালের) ভাদ্র মাসে। এখানে বলে নেওয়া ভালো যে এই দুই গ্রন্থমালা সিরিজের মধ্যে বিজ্ঞানের বই বেশি ছিল। লোকশিক্ষা গ্রন্থমালার দশটা বইয়ের মধ্যে পাঁচটাই ছিল বিজ্ঞানের বই। আবার, 'বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ' গ্রন্থমালার ছিল দেড়শো বই। আর এই দেড়শো বইয়ের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ প্রায় পঞ্চাশ খানা বই ছিল বিজ্ঞানের।
এবার জেনে নিই এই চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যের জীবনের কিছু কথা। ১৮৮৩ সালের ২৯ শে জুন (১২৯০ বঙ্গাব্দের ১৬ আষাঢ়) অর্থাৎ আজকের দিনে তিনি চব্বিশ পরগণার হরিনাভীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম বসন্ত কুমার ভট্টাচার্য। আর মায়ের নাম মেনকা দেবী। চারুচন্দ্র অত্যন্ত মেধাবী ও কৃতী ছাত্র ছিলেন। কলকাতা মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন বউবাজার শাখাতে পড়তেন। সেখান থেকে ১৮৯৯ সালে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাশ করেন। ১৯০১ সালে এফ.এ. পরীক্ষায় দ্বাদশ স্থান অধিকার করেছিলেন। ১৯০৩ সালে পদার্থবিদ্যায় অনার্স নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি.এ. পাস করেছিলেন এবং ১৯০৫ সালে পদার্থবিদ্যায় এম.এ ডিগ্রি লাভ করেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
যে কলেজ থেকে তিনি পদার্থবিদ্যায় বি.এ পাস করেছিলেন অর্থাৎ সেই প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগেই ডেমোনস্ট্রেটরের পদে কাজ পেয়ে ১৯০৫ সালে তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। কয়েক বছর পরেই ওই বিভাগেই শিক্ষকের পদে যোগ দেন। এই ১৯০৫ সাল থেকে আরম্ভ করে হাজার ১৯৪০ সাল অবধি―এই দীর্ঘ প্রায় ৩৫ বছর তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে কর্মরত ছিলেন।
আলোচনায় যখন তাঁর শিক্ষা ও কর্মস্থল প্রেসিডেন্সি কলেজের কথা উঠত তখন তিনি একটা মজার কথা বলতেন যা শোনাত এক ধাঁধার মতো। তিনি বেশ গর্বের সাথেই বলতেন, "আমাদের এই বাংলায় পাঁচজন এফ.আর.এস, তার মধ্যে আমি একজনের ছাত্র ও চারজন আমার ছাত্র।" আসলে তিনি যখন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলেন তখন অধ্যাপক হিসেবে লাভ করেছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুকে আর যখন অধ্যাপক ছিলেন তখন ছাত্র হিসেবে পেয়েছিলেন মেঘনাদ সাহা, প্রশান্তচন্দ্র মহালনবীশ, সতেন্দ্রনাথ বসু এবং শিশির কুমার মিত্রকে। তাঁর এই একজন অধ্যাপক ও চারজন ছাত্র প্রত্যেকেই ছিলেন এফ.আর.এস বা ফেলো অফ রয়্যাল সোসাইটি।
আচ্ছা অধ্যাপক হিসেবে চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য কেমন ছিলেন? এই ব্যাপারে তাঁর ছাত্র বিশ্বভারতী ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ও এশিয়াটিক সোসাইটি প্রাক্তন সভাপতি প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত কি বলেছেন জেনে নেওয়া যাক। মাস্টারমশাই চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য সম্পর্কে এই স্বনামধন্য ছাত্র বলেছেন, "চারুচন্দ্র বেকার ল্যাবরেটরির দোতলায় ফিজিক্সের গ্যালারিতে নানারকম এক্সপেরিমেন্ট দেখিয়ে বিজ্ঞানে আমাদের কৌতূহল বাড়ানোর চেষ্টা করতেন। তাঁর এক্সপেরিমেন্টের হাত ছিল অব্যর্থ। খুব কঠিন বিজ্ঞানের কথাকেও তিনি খুব সহজ করে বোঝাতে পারতেন।" এক্ষেত্রে বলে নেওয়া ভাল যে, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানের সেরা শিক্ষকদের মধ্যে একজন ছিলেন।
এবার আসি তাঁর সাহিত্য সাধনায়। প্রথম জীবনে তিনি 'বেপরোয়া' নামের একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। পরে দীর্ঘকাল সম্পাদক ছিলেন 'বসুধারা' পত্রিকার। সমবায় সমিতির মুখপাত্র 'ভাণ্ডার' পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ থেকে ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ-এই দীর্ঘ ছ’বছর। এখানে উল্লেখযোগ্য এই যে, ১৩১২-১৩১৩ বঙ্গাব্দে এই ‛ভাণ্ডার’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলায় বিজ্ঞান সাহিত্যিক হিসেবে তাঁকে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, জগদানন্দ রায়, যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির যোগ্য উত্তরসূরি বলা যায়। ১৩২৫ বঙ্গাব্দে (১৯১৮ সালে) তাঁর লেখা প্রথম জনপ্রিয় বিজ্ঞান গ্রন্থ 'নব্য বিজ্ঞান’ প্রকাশিত হয়। ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ 'বাঙালির খাদ্য'। এই বাঙালির খাদ্য বিষয়ে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ডা.চুনীলাল বসু, ডা.রুদ্রেন্দু কুমার পাল, এ দেশের বায়োকেমিস্ট্রির জনক বীরেশচন্দ্র গুহ সহ অনেকেই লেখালেখি করলেও চারুচন্দ্রের লেখনীর রসধারা ছিল একেবারে অন্যরকম। আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রতিষ্ঠিত 'বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ’-এর প্রথম কার্যকরী সমিতির তিনি অন্যতম সদস্য ছিলেন। বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ থেকে প্রকাশিত ‛জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর লেখা 'আচার্য জগদীশচন্দ্র' প্রবন্ধটি। এই বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের তিনি সহ-সভাপতি ছিলেন ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত। মাঝে, ১৯৫৪ সালে হন সাধারণ সদস্য। তিনি ১৯৬০-৬১ সালে পরিষদের সভাপতির পদ অলংকৃত করেছিলেন।
বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের মতোই এই বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদেও ছিল 'লোকবিজ্ঞান' ও 'বিজ্ঞান প্রবেশ’ গ্রন্থমালা। বিশ্বভারতীর গ্রন্থন বিভাগের বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ গ্রন্থমেলার মতোই বিজ্ঞান পরিষদের 'লোকবিজ্ঞান' গ্রন্থমালার প্রথম বই হিসেবে ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হয় চারুচন্দ্রের লেখা 'তড়িতের অভ্যুত্থান' বইটি। এমনকি, 'বিজ্ঞান প্রবেশ' গ্রন্থমালার প্রথম চারটে বইও তাঁরই রচিত। আর সেই চারটে বইও ছিল পদার্থবিজ্ঞানের। প্রথম বইয়ের নাম 'প্রারম্ভ' যা প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে। আর বাকি তিনটে বই 'পদার্থবিদ্যা' গ্রন্থের তিন খণ্ড হিসেবে ওই একই বছরে প্রকাশিত হয়। চারুচন্দ্রের সাথে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের নিবিড় সম্পর্কের প্রসঙ্গে বলে রাখা যায় যে, ১৯৫৬ সালের ৩১শে ডিসেম্বর বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের ট্রাস্টি গঠন করা হয় ফেডারেশন হলের এক সভায়। সেই ট্রাস্টিতে ছিলেন আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু, নিখিলরঞ্জন সেন, শ্যামাদাস চট্টোপাধ্যায়, রুদ্রেন্দুকুমার পাল এবং চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য। রাজশেখর বসু (ওরফে পরশুরাম) প্রয়াত হন ১৯৬০ সালে। তাঁকে নিয়েই বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ প্রতিবছর আয়োজন করে 'রাজশেখর বসু স্মারক বক্তৃতা'। আর 'প্রথম রাজশেখর বসু স্মারক বক্তৃতা' দিয়েছিলেন চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য। এমনকি বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ সম্পর্কে প্রসঙ্গে বলে রাখা যায় যে তাঁর সেই বক্তৃতাটি ১৯৬২ সালে 'পরমাণুর নিউক্লিয়াস' শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল। জনপ্রিয় বিজ্ঞানের পাশাপাশি তিনি লিখেছিলেন 'প্রাথমিক বিজ্ঞান' নামে ষষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণির দুটি বই। এখানে উল্লেখ্য যে, এই দুটি বই পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সিলেবাস অনুযায়ী লেখা হয়েছিল। চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যের অন্যান্য বইগুলি হলঃ- 'আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু (১৯৩৮)', 'বিশ্বের উপাদান (১৩৫০ বঙ্গাব্দ)', 'ব্যাধির পরাজয় (১৩৫৬ বঙ্গাব্দ)', 'পদার্থবিদ্যার নবযুগ (আষাঢ়, ১৩৫৮ বঙ্গাব্দ)', 'বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার কাহিনী (১৯৫৩)'।
চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যের খুব ভালো বন্ধু ছিলেন স্বনামধন্য সাহিত্যিক ও রসায়নবিদ রাজশেখর বসু, যাঁকে আমরা 'পরশুরাম' বলে চিনি। যদিও রাজশেখর বসু তাঁর থেকে বছর তিনেকের বড়ো ছিলেন তবুও তাঁদের মধ্যে এক মনের এমনকি স্বভাবেরও মিল পাওয়া যায়। রাজশেখর বসুর মতো তিনিও রসিকের পাশাপাশি ছিলেন অত্যন্ত গম্ভীর বা রাশভারী প্রকৃতির। কথাও বলতেন খুব কম। তবে, আলাপচারিতার সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে নানা মজার কথা বলে পরিচিতজনদের হাসিয়ে মাতিয়ে রাখতেন। পরিভাষা প্রসঙ্গ উঠলে এই দুই মহারথীর নাম আমাদের স্মরণ করতে হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় 'পরিভাষা সমিতি'র সভাপতি ছিলেন রাজশেখর বসু আর সম্পাদক ছিলেন চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য। চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য পরিমাপের মান বিষয়ক যে পরামর্শ কেন্দ্রীয় সরকারকে দিয়েছিলেন তা কেন্দ্রীয় সরকার পুরোপুরি গ্রহণ করছিলেন। এই নিবিড় বন্ধু রাজশেখর বসুর প্রয়াণের পর তাঁর স্মারক বক্তৃতা দিতে হয় চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যকে যার কথা আগে জানালাম।
১৯৬০ 'রবীন্দ্রশতাব্দী জয়ন্তী সমিতি' গঠন করা হয়েছিল। যার সভাপতির ভূমিকায় ছিলেন রাজশেখর বসু। তা সেই বছরের ১৯৬০ সালের ২৭শে এপ্রিলে তিনি আকস্মিকভাবে প্রয়াত হন। তাঁর পরিবর্তে সভাপতিত্ব করেন অতুলচন্দ্র গুপ্ত। কিছুদিন পর তাঁরও মৃত্যু হয়। সমিতির সবাই মিলে চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যকে সমিতির সভাপতি করার জন্যে রাজি করান। ওই সমিতির স্মারকগ্রন্থে চারুচন্দ্র লিখেছিলেন, "স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশিত হইবার পূর্বেই চতুর্থ সভাপতি নিয়োগের প্রয়োজন হইলে আশা করি তাঁহারা তৃতীয় সভাপতির উপর বিরক্ত হইবেন না।" না, তা আর হয়ে ওঠেনি, তিনি রবীন্দ্রশতবর্ষের পরই প্রয়াত হন। যাইহোক, তিনি এইরকম ভাবেই রসিকতা করতেন। তবুও কাছের জনকে হারানোর বেদনা ভোগ করতে হয়েছিল রবীন্দ্র সান্নিধ্যকারী এই বিজ্ঞানীকেও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো চারুচন্দ্র বেঁচে থাকাকালীনই তাঁর এক সন্তানের অকাল প্রয়াণ ঘটে। গ্রন্থন বিভাগের সহকর্মীরা লিখেছেন এই ঘটনার প্রসঙ্গে যে, সন্তান মারা যাবার পরদিন তিনি ঘড়ি ধরে গ্রন্থন বিভাগের অফিসে এসেছিলেন এবং যে সময়ে যাবার কথা সে সময়তেই অফিস থেকে বেড়িয়েছিলেন। যখন সবাই সমব্যথী হয় তাঁর চারপাশে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন, "আমি ভালোই আছি"। আর শুধু এই কথা বলেই জানলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন।
১৯৬১ সালে দেশ জুড়ে পালিত হয় ‘রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ’। আর সেই বছরেই ২৬ শে আগস্ট চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য আমাদের ছেড়ে পরলোকগমন করেন। চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যের অবদানগুলি যদি পর্যালোচনা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে যে তাঁর তিন রকম প্রধান অবদান ছিল। প্রথম অবদান শিক্ষা জগতের ক্ষেত্রে আর তা হল চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য ছিলেন বিজ্ঞানের অন্যতম সেরা শিক্ষক। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবদানগুলো সাহিত্যের ক্ষেত্রে। দ্বিতীয় অবদান হল তিনি রবীন্দ্র রচনাবলী প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর তৃতীয় অবদান হল তিনি বাংলা ভাষায় সহজ-সরল করে আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে বিজ্ঞানের প্রচুর রচনা করেছিলেন। বিজ্ঞানের দুরূহ বিষয়কেও সহজ করে সাধারণের মাঝেও খুব সুন্দরভাবে উপস্থিত করতে পারতেন। তাঁর লেখাগুলো বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ছাড়াও বই হিসেবেও বেড়িয়েছিল। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান রচনায় তাঁকে অন্যতম পথপ্রদর্শক বলাই যায়।
বাংলায় পুস্তক সম্পাদনার অন্যতম প্রাণপুরুষ ছিলেন পুলিনবিহারী সেন। অধ্যাপক চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য সম্পর্কে তাঁর কথা দিয়েই এই জীবনীমূলক লেখাটি শেষ করলাম। পুলিনবিহারী সেন একবার বলেছিলেন, "চারুচন্দ্র কেবল তাঁর নিজের রচনার দ্বারা বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান প্রচারের দৃষ্টান্ত দেখান নি। তাঁর প্রধান কৃতিত্ব এই যে, তিনি এক লেখক গোষ্ঠীকে এই পথে প্রবর্তিত করে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা সম্বন্ধে আশ্বাস সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। এই কারণেও তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।"
এই বিজ্ঞানী, বাংলা ভাষায় অন্যতম বিজ্ঞান প্রবর্তক, অধ্যাপকের প্রতি তাঁর জন্মদিবসে রইলো শতকোটি প্রণাম। এই লেখাটি তাঁর প্রতি এক শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে নিবেদিত।
তথ্যসূত্র- শ্যামল চক্রবর্তী সংকলিত ও সম্পাদিত ছোটদের সেরা বিজ্ঞান রচনা সংকলন চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য
Post a Comment