Header Ads

সদ্য প্রয়াত কিংবদন্তি চিত্রগ্রাহক বৈদ্যনাথ বসাকের দূর্দিনে এগিয়ে এসেছিল টলিপাড়া


সেলুলয়েডে ক্যামেরার সামনের মানুষদের দেখতে দেখতে আমরা ভুলে যেতে বসেছি ক্যামেরার পিছনের মানুষগুলোকে৷ তাদের চেনা তো দূরের কথা, কখনো তাদের খোঁজও নিই না। শিল্পীদের সম্মান দেওয়া এ দেশ কখনো জানে না। শিল্পসত্ত্বা এ দেশে গুমরে গুমরে কাঁদে৷ যার ফলে মেঘের আড়ালে থেকে যায় শিল্পীদের নাম৷ এই অভাগা দেশে প্রতিভা তার দাম পায়না। যার প্রমাণ অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী থেকে পরিচালক ঋত্বিক ঘটক। অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীকে শেষ বয়সে দুর্ভিক্ষের সাথে সংগাম করতে হয়েছিল। ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র কেউ বোঝার চেষ্টা করলেন না। আরো এমনই শত উদাহরণ লুকিয়ে আছে। আজকে এ পোড়াদেশে যদি শিল্পের মর্যাদা থাকতো তাহলে কিংবদন্তি চিত্রগ্রাহক বৈদ্যনাথ বসাককে না খেতে পেয়ে দিন কাটাতে হতো না। বেচারা লোকটাকে অভাব গ্রাস করে নিল। যে লোকটি মহানায়ক উত্তম কুমারের ৭২ টি ছবিতে সিনেমাটোগ্রাফি করলেন, আজকে তাঁকে থালা হাতে দু'মুঠো খাবারের জন্য ঘুরতে হয়েছিল। গত বৃহস্পতিবার অভাবের সাথে লড়াইতে নিভে যেতে হলো তাঁকে। ছিয়ানব্বই বছর বয়সে না ফেরার ঠিকানায় পাড়ি দিলেন বৈদ্যনাথ বসাক। 


২০১৮ সালে সোশ্যাল মিডিয়া হঠাৎ করে উত্তাল হয়ে উঠেছিল তাঁকে ঘিরে৷ মানুষের মনে প্রশ্নে জেগেছিল  এতো বড়ো চিত্রগ্রাহকের এ দৈন্য দশা কেন? কেন তাঁকে ভিক্ষার অন্নতে পেট ভরাতে হচ্ছে? এর উত্তর জানা যায়নি। কারণটা স্পষ্ট, আমরা অভাগার স্বর্গে বাস করছি। তাঁর নাম কিছুটা জানাজানি হওয়ার পর রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনে তাঁর খাবারের বন্দোবস্ত হয়। ভবঘুরের মতো এদিক-ওদিক ঘুরে ঘুরে দিন কাটছিল তাঁর। লড়ঝড়ে শরীর নিয়েও চার কিমি পায়ে হেঁটে রামকৃষ্ণ মিশনের অন্নপূর্ণা প্রকল্পে দু'মুঠো ভাত খেতে আসতেন তিনি৷ নিঃসহায়, সম্বলহীন, আর্তপীড়িত ও পথ উন্মাদ মিলিয়ে জনা পশ্চাশ লোকেদের সাথে একসাথে বসে ক্ষুধা নিবারণ করতেন তিনি৷ এক থালা গরম ভাত খেয়ে কোনো পর্ণমোচীর ছায়ায় একটু বিশ্রাম নিয়ে ফিরে আসতেন তিনি। বার্ধক্যজনিত সমস্যার কারণে গত বৃহস্পতিবার রাত তিনটার সময় জীবনের সকল হিসেবের সমাপ্তি ঘটলো।

তিনি যাদের সাথে বসে পেট চালাতেন, তারা কেউই চিনতে পারতেন না তাঁকে। রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনের দুই মাইল দূরে পশ্চিম পানশিলার খালপাড়ের একচিলতে বাড়িতে তিনি বসবাস করছিলেন। তবুও কারও চোখের নজরে তিনি পড়লেন না। তাঁর ছবি বাড়িতে বাড়িতে টিভিতে চলছে অথচ তিনি পদে পদে অবহেলিত হয়ে রইলেন।  

সাধারণ মানুষ তাঁর দুর্দিনে এগিয়ে আসেননি। কিন্তু বাঙালি চলচ্চিত্র তারকারা তাঁর অভাবের দিনে এগিয়ে এসেছিলেন। পুরো টলিপাড়া তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিল। স্বনামধন্য অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ, অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায় ও অভিনেত্রী মমতা শংকর থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র ও নাট্য জগতের বহু মানুষ তাঁর অভাব মোচনে এগিয়ে এসেছিলেন। এমনকি সাংসদ ও অভিনেতা দেবও তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। শোনা যায়, নেপালের রাজপরিবার তাঁকে রাজপ্রাসাদে আশ্রয় দিয়েছিল কিন্তু কলকাতার টানে তিনি নেপাল ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন৷ নবীন পরিচালক রাজ বন্দোপাধ্যায় ২০১৮ সালে 'পাড়' নামক এক শীর্ষক চলচ্চিত্রে চিত্রগ্রাহক হিসেবে বৈদ্যনাথ বসাককে ব্যবহার করেন। এটাই বৈদ্যনাথ বসাকের শেষ কাজ ৷

বাংলার অন্যতম ছবি যেগুলোকে বলা হয় বাংলা ছবির ইতিহাসের মাইলস্টোন। সেই সব ছবিতে তিনি ক্যামেরার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বাংলা ছবির স্বার্থে তিনি বহুবার হিন্দি ছবির অফার ফিরিয়ে দিয়েছেন। বাংলাতে সবার উপরে, বাদশা, সাগরিকা, নায়িকা সংবাদ, লালু ভুলু, সোনার খাঁচা, অগ্নিপরীক্ষা, ছদ্মবেশী, অপরাহ্নের আলো, সূর্যসাক্ষী ও আপন ঘরের মতো অজস্র ছবিতে তিনি চিত্রগ্রাহকের কাজ করেছেন৷ সুব্রত মিত্র আর্কাইভের তরফ থেকে তাঁকে সুব্রত মিত্র পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। ফিল্ম হেরিটেজও তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দেয় ও তাঁকে চিকিৎসার খরচ দিয়ে সাহায্য করতে থাকে। চলচ্চিত্র সমাজের মানুষদের নিয়ে অনেকেই কুরুচিপূর্ণ কথা বলেন। চলচ্চিত্র শিল্পীদের জন্য সর্বদা তোলা থাকে একরাশ অপমান। চলচ্চিত্র শিল্পী সম্পর্কে চরিত্রহীন, লম্পট, লোভী, স্বার্থান্বেষী প্রভৃতি বিভিন্ন শব্দ মানুষের মুখ দিয়ে শোনা যায়৷ কিন্তু সমাজের দর্পণ হিসেবে চলচ্চিত্র শিল্পীরা নানা কাজকর্ম করছেন। সেই কথা মানুষ ভুলে যান। সাধারণ মানুষ বৈদ্যনাথ বসাককে কোনোদিনই সম্মান দেননি, শিল্পসমাজের মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে তাঁর৷ সাধারণ মানুষের অভিমানে বোঝা বুকে নিয়ে নিঃশব্দে বৈদ্যনাথ বসাকের অমৃতলোকে যাত্রা বেশ বেদনাদায়ক। এই বেদনার ক্ষত আজীবন বাংলার শিল্পসমাজকে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে। 

প্রতিবেদন- সুমিত দে

No comments