Header Ads

নিঃশব্দ প্রহরে স্মৃতিকথায় কিরীটী স্রষ্টা নীহাররঞ্জন গুপ্ত


দেশভাগ তিনি মেনে নিতে পারেননি৷ বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর চিন্তা হতো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবর শুনতেন তিনি মন দিয়ে। শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত হন তিনি৷ হঠাৎ একদিন খবর পান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারা যেন গুলি করে হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর কয়েক বছর পর তিনি বাংলাদেশে যান। সেখানে গিয়ে তিনি হাতড়াতে থাকেন বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি। তাঁর সাথে দেখা হলো মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার সাথে। হাসিনা তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন। হাসিনা শোকাতুর বুকে বঙ্গবন্ধুকে কোথায় কোথায় গুলি করা হয়েছিল তা দেখাতে লাগলেন। হাসিনার মুখে তাঁর বাবার হত্যার গল্প শুনে তাঁর চোখ অশ্রুতে ভরে উঠেছিল। তিনি বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন 'জয় বাংলা'। নরম মনের এই অমায়িক মানুষটিই একদিন লিখে ফেললেন জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র 'কিরীটী'। তিনি আর কেউ নন, প্রখ্যাত সাহিত্যিক নীহাররঞ্জন গুপ্ত ৷ 


ওপার বাংলার সাথে নীহাররঞ্জন গুপ্তের নিবিড় সম্পর্ক ছিল৷ তাঁর পরিবারের বহু স্মৃতি লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের সাথে। দেশভাগ তাঁকে কিছুটা উন্মত্ত করে রেখেছিল। ১৯১১ খ্রীস্টাব্দের ৬ ই জুন তিনি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল বাংলাদেশের নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার ইতনা গ্রাম। তাঁর বাবার কর্মসূত্রে তাদের ওপার বাংলা ছেড়ে এপারে চলে আসতে হয়। তাঁর পিতা সত্যরঞ্জন গুপ্তের কেরাণীসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় বদলি হওয়ার কারণে নীহাররঞ্জন গুপ্তকে বিভিন্ন জায়গায় পড়াশোনা করতে হয়েছে। ১৯৩০ সালে কোন্নগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাটিকুলেশন ও কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন৷ এরপর তিনি কলকাতার কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করেন ও ব্রিটেন থেকে চর্মরোগ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে তিনি যোগ দেন। বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে ভ্রমণ করে সেবাদানের সূত্রে তিনি সাক্ষী হয়েছিলেন বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার সাথে৷ যার ছাপ পাওয়া গেছে তাঁর লেখা বেশ কিছু পুস্তকে।    

শৈশবকাল থেকেই নীহাররঞ্জন গুপ্তের বই লেখার একটা আলাদা শখ ছিল৷ সেই শখের বশেই তিনি কম বয়সে লিখে ফেললেন 'রাজকুমার' নামের একটি উপন্যাস। একদা তিনি শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদ গ্রহণসহ তাঁর অটোগ্রাফ সংগ্রহ করেন৷ ব্রিটেনে থাকাকালীন সময়ে গোয়েন্দা লেখার প্রতি তাঁর আগ্রহ জন্মায়। সেই রচনা করার আগ্রহ থেকে তিনি সাক্ষাৎ করেন ব্রিটেনের বিখ্যাত গোয়েন্দাকাহিনী রচয়িতা আগাথা ক্রিস্টির সাথে৷ তাঁর প্রথম যৌবনে জমিদারবাড়ির নিষ্ঠুর এক হত্যা রহস্য একাকার হয়ে তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল৷ এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে তিনি লিখে ফেলেন 'জোড়া-খুন' নামের একটি গল্প। যে গল্প থেকেই জন্ম হয়েছিল 'কিরীটী' নামক জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্রটির৷ 'কিরীটী' লেখার পিছনে আগাথা ক্রিস্টির সাথে সাক্ষাৎ ছাড়াও লেখক পাঁচকড়ি দে'র কয়েকটি রহস্য উপন্যাস তাঁকে অনুপ্রাণিত করে তুলেছিল৷ তাঁর রহস্য উপন্যাস থেকে তিনি ক্রাইমজগতের সাথে পরিচিতি লাভ করেছিলেন৷    

তাঁর লেখনীতে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। গল্পের প্রেক্ষাপট থেকে চরিত্র নির্ধারণ, কথোপকথন সবেতেই তিনি ছিলেন বেশ তুখড়৷ ছোটো ও বড়ো উভয় শ্রেণীর মানুষদের উপযোগী গল্প তিনি উপহার দিয়ে গেছেন৷ তাঁর লেখা ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ করেছিল বাংলা সাহিত্যকে। দুই বাংলাতেই তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। কালোভ্রমর, মৃত্যুবাণ, কালনাগ, উল্কা, উত্তরফল্গুনী, হাসপাতাল, কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী, লালুভুলু, রাতের রজনীগন্ধা, কিরীটী অমনিবাস ও অপারেশনের মতো অসংখ্য উপন্যাস সৃষ্টি করেছেন তিনি৷ তাঁর রচিত গ্রন্থ সংখ্যা ছিল দুই শতাধিক।  তাঁর লেখা উপন্যাস ও গল্প উঠে এসেছে সেলুলয়েডে। তিনি চেয়েছিলেন কিরীটী সেলুলয়েডে উঠে আসুক অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়ের হাত ধরে৷ যদিও অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়ের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। বাংলা ও হিন্দি ভাষা মিলিয়ে তাঁর গল্প-উপন্যাস থেকে প্রায় ৪৫ টিরও বেশি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। বর্তমানে টলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে আধুনিক সময়ের প্রেক্ষাপটে কিরীটীকে নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। 

নীহাররঞ্জন গুপ্ত ছিলেন একদম খাঁটি বাঙালি। বাংলা সাহিত্য যেমন তাঁর প্রিয় ছিল, তেমনই তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদেও ছিল নিখাদ বাঙালিয়ানার ছাপ৷ গায়ে তাঁর থাকতো বোতামখোলা জামা আর লুঙ্গির মতো করে কোচানো ধূতি। তিনি সর্ষে-ইলিশ খেতে খুব পছন্দ করতেন৷ সারাটাদিন ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হতো তাঁর। ডাক্তারি চেম্বার, লেখালেখি, পুজোর্চণা, পোষ্যের যত্ন আর বন্ধুবান্ধবদের সাথে তাঁর গল্পগুজব তো লেগেই থাকতো৷ সকালে প্রাতঃভ্রমণে নিয়মিত বের হতেন তিনি। রবীন্দ্র সরোবরের ধারে তাঁর অ্যালসেশিয়ান পোষ্যকে নিয়ে প্রাতঃভ্রমণ করতেন৷ তাঁর পোষ্যের নাম রেখেছিলেন তিনি জ্যাকলিন। সহজ কথায় নীহাররঞ্জন গুপ্ত ছিলেন মাটির মানুষ৷ আদ্যন্ত বাঙালি এই সাহিত্যিক মানুষটি বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল তারকা। যার অবদান অমর হয়ে থাকবে অনন্তকাল যাবৎ।

No comments