ভ্রমণ ও ভক্তিকথায় কামারপুকুর || দ্বিতীয় পর্ব
আমাদের হোটেলের নাম রিলাক্স লজ। নামে লজ হলেও এর বিল্ডিংটা বেশ
বড়োসড়ো এবং চাকচিক্যময়। কেবল গরম জলের ব্যবস্থা ছাড়া আর বাকি সব ব্যবস্থার সঙ্গে
সঙ্গে মোটামুটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিল। দুপুরে আমার একটু বিশ্রাম চাইই
চাই--সে সঙ্গে খানিক নিদ্রা হলে তো সোনায় সোহাগা যাকে বলে!কিন্তু দেখলাম মানসিক
দিক থেকে নিদ্রাদেবী চোখে ভর করলেন না।মনের মাঝে কখন আশ্রমে যাবো, এমনি একটা ভাব
লেগে আছে। কামারপুকুর নিয়ে বিগত দিনের যে সব লেখা আমি পড়েছি তারই কিছু স্মৃতি মনের
কোণে এসে ভিড় করছিল--
এই সেই পুণ্যভূমি
কামারপুকুর। পরম পুরুষ শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের জন্মস্থান।
এখানে যেমন সবুজের সমারোহ চোখে পড়ে, তেমনি পিচ রাস্তা ছাড়িয়ে সামান্য এগিয়ে গেলেই
দেখা যায়
লাল
মাটির রাস্তা চলে গেছে সুদূরে।
কামারপুকুরের অগ্নিকোণে রয়েছে মান্দারণ গড়, এখন এখানে তার চিহ্ন প্রায় নেই বললেই
চলে। এক সময়ের এর দুর্ভেদ্য প্রাচীর গলিয়ে বর্গীদের হামলা চলেছিল
বহুবার। এই গড় মান্দারণ একটা ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান। এই স্থানের ওপর
ভিত্তি করেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস "দুর্গেশনন্দিনী" লিখেছিলেন। প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত এই গড়
মান্দারণ দুর্গের ভগ্ন তোরণ, স্তূপ ও একটু দূরে
অবস্থিত শৈলেশ্বর শিব মন্দির রয়েছে।ক্ষীণতোয়া আমোদর নদী ও অপর প্রান্তের
জঙ্গলাকীর্ণ স্তূপ আজও ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে।এই গড় মান্দারণ কামারপুকুর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সে সব ইতিহাস আজ কালের গর্ভে তলিয়ে
গেছে। এখন শুধু পড়ে আছে তার স্মৃতিটুকু। এই
মান্দারণ গড়ের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আমোদর নদী আজ মৃতপ্রায় বললেই চলে।
কামারপুকুর থেকে দেরে গ্রামের দূরত্ব ছিল দেড়
ক্রোশ, মানে পাঁচ মাইলের কাছাকাছি। সেখানেই একদা বাস করতেন সদাচারী সত্যনিষ্ঠ
ব্রাহ্মণ ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়। তিনি নিজের ঘরে প্রতিষ্ঠিত রঘুবীর ও শীতলা দেবীর নিত্য পূজা করে তবেই অন্ন-জল
গ্রহণ করতেন। সেখানকার তদানীন্তন জমিদার ছিলেন রামানন্দ রায়। তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্বার্থপর। রামানন্দ এক জনের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে তার ওপর আদালতে
মামলা করেন। সেই মামলায় মিথ্যা সাক্ষী দিতে ক্ষুদিরামকে প্ররোচিত করেন। কিন্তু ক্ষুদিরাম
কিছুতেই মিথ্যা সাক্ষী দিতে রাজি হন না। রামানন্দ রায় শেষে ক্ষুদিরামের উপরে
মিথ্যে মামলা দায়ের করেন। এরপর ক্ষুদিরাম সপরিবারে দেরে গ্রাম ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েন
অন্য কোন আশ্রয়ের খোঁজে। পথে তাঁর বন্ধু শুকলাল গোস্বামীর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তিনিই
তাদের নিয়ে আসেন নিজের গ্রাম কামারপুকুরে। শুখলাল নিজের বাড়ির কয়েকটা চালা ঘর ও এক
বিঘে ১০ ছটাক জমি চিরকালের জন্যে লিখে দিলেন ক্ষুদিরামের নামে। দেরে গ্রামের লোকদের
মনে আক্ষেপ রয়ে গেল, ক্ষুদিরাম যদি এই গ্রামে থাকতেন তবে ঠাকুর রামকৃষ্ণ এই
গ্রামেই জন্ম গ্রহণ করতেন। এই গ্রামই কামারপুকুরের জায়গায় হয়ে উঠত পুণ্যভূমি দেরে গ্রাম। দেরে গ্রামে
ক্ষুদিরামের বাসস্থানে তৈরি হয়েছে এক
মন্দির আর তাঁর বসত বাড়ি মডেল হিসাবে দর্শণার্থ রাখা আছে। সে সময় কামারপুকুরে লাহা
ও পাইনরা ছিলেন সম্ভ্রান্ত বংশ।
ক্ষুদিরাম যেমন সদাচারী ও সত্যনিষ্ঠ ছিলেন
তেমনি তাঁর স্ত্রী চন্দ্রমণি ছিলেন স্নেহ ও সরলতার প্রতিমূর্তি।রামকৃষ্ণের জন্মের
আগে চন্দ্রমণির প্রায়ই দেবদর্শন হত। একদিন তিনি যোগীদের শিবমন্দিরে পূজা দিতে গিয়ে অপূর্ব এক জ্যোতি দর্শন
করেন।তিনি দেখেন শিব লিঙ্গ থেকে উঠে আসছে এক জ্যোতি, সে জ্যোতি এসে চন্দ্রমণির
দেহে এসে প্রবেশ করে। ওই সময়টায় ক্ষুদিরাম গয়াতে যান।সেখান থেকে কিছু
তীর্থক্ষেত্র ঘুরে তিনি ফিরে আসেন। তখন চন্দ্রমণি তাঁর অদ্ভুত জ্যোতি দর্শনের কথা
স্বামীকে খুলে বলেন।আর এরই কিছুদিন পরে ১৮৩৬ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারী, বাংলার ১২৪২
খ্রিস্টাব্দের ৬ই ফাল্গুন, বুধবার শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে তাঁদের কোল আলো করে এক দৈব
সন্তানের আবির্ভাব ঘটে। সেই সন্তানই হলেন পরম পুরুষ শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ।
পরম পুরুষ শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের আবির্ভাবের ফলস্বরূপ উনিশ
শতকের জাগরণ ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় অধ্যায়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এই জাগরণই আমাদের পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তি দিয়েছিল।এই জাগরণ বাংলার ধর্মে, সাহিত্যে,
শিল্পকলায় যথেষ্ট
প্রভাব ফেলেছিল। ভগবানের জন্ম লীলাও বড় বিচিত্র।
আর এই প্রসঙ্গেই
নেতাজীর কামারপুকুরে আসার কথা মনে পড়ে যায়। কামারপুকুরে এসেছিলেন স্বয়ং সুভাষচন্দ্র বোস।তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর কিছু অনুগত
ভক্ত। রামকৃষ্ণ মঠে আসার পর সকলে নেতাজীকে খুঁজছিলেন। কোথায় গেলেন নেতাজী? খুঁজতে খুঁজতে শেষে তাঁকে পাওয়া
গেল।অনুগামীরা দেখতে পেলেন তিনি আশ্রমের এক বটবৃক্ষকে জড়িয়ে ধরে আছেন।সঙ্গীরা
বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি হল
নেতাজী, আপনি কি
করছেন?
আসলে সেই বট গাছের নীচেই একদা
রামকৃষ্ণদেব ধ্যানে বসতেন।নেতাজী সে গাছটিকে জড়িয়ে ধরে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, আপনারা জানেন না? এখানে একদিন স্বয়ং ভগবান কঠোর
তপস্যা করতেন। আমাদের জন্য তিনি যে রেখে গেছেন বিরাট সম্পদ! তাই আমরা এত বড়
সম্পদের অধিকারী আজ।
বিবেকানন্দও কামারপুকুরে এসেছিলেন। ১৮৮৯ সালে
স্বামীজী এখানে এসেছিলেন। কামার পুকুর
প্রসঙ্গে স্বামীজী একবার বলেছিলেন, যারা ভাগ্যবান তারাই এই স্থান
দর্শন করতে পারেন।
এই কামারপুকুরে কলকাতা হয়ে আসতে গেলে ধর্মতলা থেকে পাবেন অনেক বাস। এ ছাড়া হাওড়া স্টেশন থেকে রয়েছে ট্রেন। হাওড়া থেকে গোঘাট প্রায় ৯০ কিলোমিটারের রাস্তা, ট্রেনে ঘণ্টা তিন সময় লাগে। গোঘাট থেকে কামারপুকুরের দূরত্ব
মাত্র ৭ কিলোমিটার। গোঘাট স্টেশন থেকে অটো, টোটো, রিক্সা ভ্যান আছে আপনাদের এখানে পৌঁছে দেবার। এ ছাড়া বর্ধমান,
আরামবাগ কিংবা তারকেশ্বর থেকে অনেক বাসের এখানে যাতায়াত রয়েছে। এ সব জানাজানির ব্যাপারটা আমি হোটেলের রিসেপশনিস্টের কাছ থেকেই পেয়ে গেলাম।
এ সময় পাশে দাঁড়ানো স্ত্রী বলে
উঠলেন, এখনই কলকাতা যাচ্ছি না আমরা। আমার মুখ থেকে ‘এ্যাঁ’ শব্দটা বেরিয়ে এলো।
পরের ইচ্ছেটা স্ত্রী আমার অনায়াসে
বলে দিলেন, এরপর আমরা বিষ্ণুপুর যাবো!
কর্ত্রীর ধর্ম কর্ম। যাহা মুখ ব্যদন
হইতে নিঃসৃত হইবে তাহা অবজ্ঞা করিব এমন সাধ্য অন্তত আমার নাই। তাই বুঝি মনের মাঝে
সুস্থ ভাবনাকে জন্ম দিবার জন্য আমি ভাবিয়া লইলাম—মন্দ নয়--বিষ্ণুপুর অনেক পুরনো
শহর। শুনেছি তা ছাড়া সেখানে মন্দিরের নাকি ছড়াছড়ি। টেরাকোটা কাজের জন্য বিষ্ণুপুর বিখ্যাত শুনেছি।আমি আপাতত নিজের পদমর্যাদা রক্ষার্থে বলে উঠলাম, ঠিক আছে, আপাতত টেরাকোটা ন্যাড়াকোটা ছেড়ে
এখানকার দর্শনটা সেরে আসি চলো তো!
দু’মিনিটের পায়ে পায়ে
হেঁটে পৌঁছে গেলাম আশ্রমের প্রধান গেটের সামনে। বিরাট গেটের শীর্ষদেশে লেখা আছে,
রামকৃষ্ণ মঠ, কামারপুকুর। এখানে এমনি একাধিক গেট আছে।গেট বন্ধ করার লৌহ
দ্বারের শিকের ওপর ঝুলছিল একটা বোর্ড,
তাতে লেখা আছে মন্দিরে প্রবেশের সময়কাল।গেটের এক পাশে দেয়ালে চোখে পড়ল আরও এক বিজ্ঞপ্তি,তাতে
কামারপুকুরের দ্রষ্টব্য স্থানগুলির নাম দেওয়া আছে।
ঢুকে গেলাম মিশন চত্বরে আজই সকালে মিশন অফিসে গিয়েছিলাম বিফল মনোরথে ফিরে এসেছিলাম। ডান দিকের সেই অফিস ঘরটার দিকে
একবার
তাকালাম। আমাদের যদিও যেতে হবে বাঁদিকে। রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছি দু’দিকেই সুন্দর বাগান, বাঁদিকে ক্যারি করা
ঘাস, মেন্দির বেড়া, তারই মাঝে নানা রকম ফুলের সমারোহ। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে কোণায় জুতো
রাখার ঘর দেখলাম। ঘরের বাইরে শতাধিক জুতা চপ্পল
গড়াগড়ি খাচ্ছিল।নিজের জুতোর দিকে একবার তাকালাম, নতুন বলতে হবে,
দেড় হাজার
টাকা দামের জুতো। এমন জায়গাতে এসেও বিশ্বাসটা কেমন যেন একটু ঠেলা খেল। স্ত্রীকে ডেকে জুতো রাখার ঘরের ভিতর গিয়ে ঢুকলাম।এক
কোণায় আমার আর স্ত্রীর দু’জোড়া জুতো প্লাস্টিকের
বস্তাতে ভোরে তুলে রাখলাম র্যাকের একেবারে
ওপরের এক কোণায়। মনে রাখার চেষ্টা করলাম এসে যেন সঠিক স্থান ভুলে
না যাই। জুতার অদল-বদলের সম্ভাবনা কতটা থাকতে পারে এমনটা ভাবতে ভাবতে আমরা এগিয়ে
গেলাম মন্দির চত্বরের দিকে। এদিকের পরিসরের শুরুতেই ডান দিকে প্রধান
মন্দির রয়েছে।আসলে রামকৃষ্ণদেবের বসত বাড়ির সবটা ঘিরেই এই রামকৃষ্ণ মিশনের স্থাপনা হয়েছে।মন্দিরটির সামনে একটা
নাটমন্দিরও আছে। রামকৃষ্ণ মিশন
ঠাকুরদের এই পৈতৃক জায়গা ছাড়াও পরবর্তীকালে আরও
প্রায় ৮৪ বিঘা জমি কিনেছে।১৯৪৯ সালের ১লা মার্চ বিখ্যাত শিল্পী শ্রী নন্দলাল বসু
পরিকল্পিত এই স্মৃতি মন্দিরটি চুন ও বালি দ্বারা নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল।এখানেই ছিল ঢেঁকি শালা যেখানে একদিন গদাধর জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই ঢেঁকিশালাকে ঘিরেই এই মন্দিরের প্রধান বেদিটি তৈরি হয়েছিল। মন্দিরের বেদীটির ওপরেই প্রায়
আড়াই ফুট উচ্চতায় ঠাকুরের সমাধিমগ্ন মর্মর মূর্তিটি প্রতিষ্ঠিত।
Post a Comment