Header Ads

বেঙ্গল কেমিক্যালস এণ্ড ফার্মাসিউটিক্যালস ওয়ার্কস লিমিটেড ইতিবৃত্ত || পঞ্চম পর্ব


                                  
বেঙ্গল কেমিক্যাল যখন একটি লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয় অর্থাৎ ১৯০১  সালে তখন তাঁর মূলধন ছিল ২৫০০  টাকা। পঁচিশ বছর পর, অর্থাৎ ১৯২৬ সালে যখন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’ প্রবন্ধটি লিখছিলেন তখন সেই কোম্পানির মূলধন ছিল ১৯,০০,০০০ (উনিশ লক্ষ) টাকা এবং রিজার্ভ ফান্ড সহ ইত্যাদি ফান্ড ধরলে দেখা যেত কোম্পানির মূলধন পঁচিশ লক্ষেরও বেশি। একটা কোম্পানি কতটা লাভবান হলে এতটা মূলধন করতে পারে বিশেষ করে তখনকার পরাধীনতার যুগে তা ভাবলে বিস্মিত হয়ে যেতে হয়।


লিমিটেড হবার প্রায় চার বছর পরে ১৯০৫ সালের আশেপাশে ৯০, মানিকতলা মেন রোডে কোম্পানির কারখানা স্থাপিত হয়েছিল। এই মানিকতলা মেন রোডের কারখানায় বাজারে চালান বা জোগান দেওয়ার মতো প্রচুর পরিমাণে মহাদ্রাবক বা সালফিউরিক অ্যাসিড এবং অন্যান্য দ্রাবক তৈরি করতে আরম্ভ করেছিল। এর ফলে কোম্পানির এবং সমাজের উভয়েরই লাভ হয়েছে কেননা তখনকার দিনে এইসব দ্রাবক জোগান দেওয়ার কোম্পানি বেশিরভাগই বিদেশি ছিল আর তাদের তৈরি করা জিনিসের দ্রব্যমূল্যও অনেক বেশি ছিল। স্বদেশী কোম্পানি বেঙ্গল কেমিক্যাল যখন এইসব নানারকম দ্রাবক বাজারে জোগান দেওয়া শুরু করল তখন দেখা গেল দ্রাবকের মূল্য ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ টাকা কমে গেছে। এই কোম্পানির দ্রাবক সহ অন্যান্য সামগ্রীর গুনগত মানও খুব ভালো ছিল আবার দামেও অনেক কম ছিল যার ফলে এইসব জিনিসগুলি সহজেই বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে যেত। 

মানিকতলায় বেঙ্গল কেমিক্যালের কারখানাটির মোট জমি ছিল চল্লিশ বিঘেরও বেশি। বেঙ্গল কেমিক্যালের সেই কারখানাটিতে অ্যাসিড সহ অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য, ওষুধ, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ইত্যাদি তৈরি করার নানারকম ব্যবস্থা ছিল। বেঙ্গল কেমিক্যাল শুধু এক রাসায়নিক কারখানাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। রাসায়নিক কারখানা ছাড়াও বিভিন্ন আনুসঙ্গিক বিভাগও সেখানে ছিল যেমন ছুতোরখানা, প্যাকিংঘর, ঢালাইঘর, গুদাম, কর্মচারীদের থাকার জন্যে মেস ও বাড়ি, ছাপাখানা ইত্যাদি। এ সমস্তই খুব সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো ছিল। যেখানে যেটার থাকার কথা বা থাকার দরকার সেখানে সেটা তেমনভাবেই ছিল। আচার্যদেব লিখেছেন যে, উত্তর কলকাতা শহরের মতো এই কারখানা আপনা থেকেই গজায়নি। একে খুব ভালো প্ল্যান করেই বাড়ানো হয়েছে।

এবার আসি কারখানার ছাপাখানায়। সেই ছাপাখানাতে কারখানার তৈরি বিভিন্ন জিনিসের বিজ্ঞাপন, লেবেল, ক্যাটালগ ইত্যাদি ছাপা হত। ছাপাখানা প্রস্তুত হওয়ার আগে উল্লেখিত এই জিনিসগুলি ছাপতে প্রেস বা বাইরের ছাপাখানাকে মাঝে মাঝে খুবই বেগ পেতে হত বা অসুবিধায় পড়তে হত। কেননা বৈজ্ঞানিক সামগ্রীর বিজ্ঞাপন বা লেবেল ইত্যাদি তৈরি করা সহজ কাজ নয়, সেগুলো ছাপতে বিষয়ের জ্ঞান থাকলে ভালো হয়। তাই কোম্পানির মধ্যেই ছাপাখানা খোলার পর সেখানেই উক্ত জিনিসগুলি ছাপানো হত আর বাইরের কাজ করবার কোনো দরকার হত না। কারখানার মধ্যে একটি ওয়ার্কশপ ছিল যেখানে বিভিন্ন রকম বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি তৈরি করা হত। তখনকার দিনে সেসব যন্ত্রপাতি বাজারে বেশ ভালোই চলত। তখন দেশটা ইংরেজদের অধীনে ছিল, অনেক ইংরেজ এই দেশে এসে মিস্ত্রি,ফটোগ্রাফার ইত্যাদির কাজ করতেন। অনেক কোম্পানি ছিল যেগুলো এঁদের কাজে লাগাত। কিন্তু বেঙ্গল কেমিক্যাল কোম্পানি এর ব্যতিক্রম তার কারণ সেখানে বিলেত বা ইংল্যান্ড থেকে কোনো মিস্ত্রিকে আমদানি করা হয়নি। পুরো কোম্পানিটাই দেশীয় লোকেরাই চালাত। আচার্যদেব এ প্রসঙ্গে একটি সুন্দর কথা বলেছেন তা হল, “দেশের লোককে দেশের লোকেরাই গড়ে পিটে তৈরি করে নিয়েছে।” অর্থাৎ, কোনো বিদেশি মিস্ত্রি বা কর্মী নয়, এই কোম্পানিতে দেশের লোকেরাই দেশের লোককে দেশ গড়ার কাজে তৈরি করছেন। এ ধরনের নিদর্শন তখনকার দিনে ব্যতিক্রম তো বটেই এমনকি এখনকার দিনেও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বহন করে চলেছে। 

প্রসঙ্গত, এই কোম্পানি আজও দেশের সরকারই দেশীয় লোকেদের দিয়েই চালাচ্ছে। যাইহোক, কারখানার নতুন যা কিছু তৈরি হত তা সব ওই ওয়ার্কশপেই তৈরি হত। আবার পুরনো কোনো কিছুর মেরামত ওই ওয়ার্কশপ থেকেই হত। মূলত এই মেরামত ও তৈরির কাজ কারখানার দক্ষ লোকেরাই করতেন, এইসব কাজের জন্য বাইরের থেকে মিস্ত্রি ডাকার কোনো দরকার পড়ত না। আচার্যদেবের প্রবন্ধ থেকে জানতে পারি যে প্রতিটা কাজের নক্সা তৈরি থেকে আরম্ভ করে কাজটি শেষ করা অবধি সমস্ত কাজ কারখানার লোকেদেরকে দিয়েই হত। কেবলমাত্র নিজেদের কাজের মধ্যেই কোম্পানি সীমাবদ্ধ থাকত না। বাইরের অনেক কলেজের (রসায়নবিদ্যার) ল্যাবরেটরির পরিকল্পনা থেকে আরম্ভ করে সমস্ত কাজই বেঙ্গল কেমিক্যাল অত্যন্ত পারদর্শীতার সাথেই করতো।

No comments