তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত লিখে রেখে পৃথিবীকে বিদায় জানালেন কালজয়ী সাহিত্যিক দেবেশ রায়
না ফেরার দেশে পাড়ি দিলেন কালজয়ী সাহিত্যিক দেবেশ রায়। শ্বাসকষ্টজনিত কারণে জীবনদীপ নিভে গেল তাঁর। বাংলা সাহিত্য জগতে ভর করেছে শোকের ছায়া। সাহিত্যপ্রেমী মানুষেরা বিশ্বাসই করতে পারছেন না যে তিনি আর নেই। গত বৃহস্পতিবার রাত দশটা পঞ্চাশ মিনিটে কলকাতার বাগুইআটি বেসরকারি নার্সিং হোমে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। গত বুধবার রাতে বুকের ব্যথা নিয়ে নার্সিং হোমে ভর্তি হন তিনি। বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে তাঁর অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে৷ আর রাত দশটা পঞ্চাশে সব শেষ। ঝরে পড়লো তাঁর জীবন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল চুরাশি বছর।
দেশভাগের যন্ত্রণায় বিভোর তখন এপারের মানুষ। দেশভাগ বাংলা সাহিত্যকেও নড়িয়ে দিয়েছিল। দেশভাগের ফলে যেন দ্বিখণ্ডিত হতে হয়েছিল বাংলা সাহিত্যকে। এরকম একটি চরম দুর্দিনে যাঁরা বাংলা কথাসাহিত্যের ভার নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি হলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক দেবেশ রায়। স্বতন্ত্র ভাবনার কলমের আঁচড়ে তিনি জন্ম দিয়েছেন একগুচ্ছ উপন্যাস ও গল্পের। 'যযাতি' নামক এক উপন্যাসের মাধ্যমে তাঁর উপন্যাস লেখার সূচনা। মানুষ কেন খুন করে, মফস্বলী বৃত্তান্ত, সময়-অসময়ের বৃত্তান্ত একের পর এক উপন্যাসের নিরন্ত গতিতে তাঁর সাহিত্য সৃষ্টি নদীর মতো প্রবাহিত হতে থাকে।।
দেবেশ রায়ের জন্ম অধুনা বাংলাদেশের পাবনা জেলার বাগমারা গ্রামে। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দের ১৭ ই ডিসেম্বর। তাঁর শৈশব কেটেছিল উন্মত্ত যমুনা নদীর তীরে। ১৯৪৩ খ্রীস্টাব্দে দেশভাগের চার বছর আগে তাঁর পরিবার পাবনা ত্যাগ করে চলে আসেন জলপাইগুড়িতে। সেখানেই কলেজে পাঠরত অবস্থায় তিনি পরিচিত হন বামপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শে র সাথে। তাঁর লেখার পটভূমিতে চরিত্র হয়ে বারবার ফিরে এসেছে বাংলার উত্তর পাড়ের কথা। রাজনৈতিক কারণে বাংলার উত্তরের প্রতিটি কোণ ছিল তাঁর জানার মধ্যে। তিনি বেশ কিছুকাল কলকাতায় সক্রিয়ভাবে শ্রমিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন।
তিনি লিখেছেন মফস্বলি বৃত্তান্ত, সময় অসময়ের বৃত্তান্ত, তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত, লগন গান্ধার, আত্মীয় বৃত্তান্ত, শিল্পায়নের প্রতিবেদন, দাঙ্গার প্রতিবেদন, খরার প্রতিবেদন, যযাতি, তিস্তা পুরাণ, আঙিনা, ইতিহাসের লোকজন, উচ্চিন্নো উচ্চারণ, একটি ইচ্ছা মৃত্যুর প্রতিবেদন, চেতাকে নিয়ে চীবর জন্ম, নবেলজোড়, বরিশালের যোগেন মণ্ডলের মতো অসংখ্য উপন্যাস। এছাড়াও তিনি বেশ কিছু ছোটোগল্প ও প্রবন্ধ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি ১৯৯০ খ্রীস্টাব্দে তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন। তাঁর লেখা পাঠকদের বারংবার মুগ্ধ করেছে। আজ সেই দেবেশ রায় অমৃতলোকে পাড়ি দিলেন। হয়তো সেখানে বসে আবারো রচনা করবেন তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্তের মতো অমৃতলোকের বৃত্তান্ত। থেকে যাবে তাঁর সমস্ত স্মৃতি। এভাবেই মহান ব্যক্তিরা একদিন সকলে মহৎ কাজ করে হঠাৎই বিদায় নেন পৃথিবী থেকে। তাঁরা সশরীরে হয়তো থাকেন না, কিন্তু বেঁচে থাকে তাঁদের সৃষ্টিরা।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment