Header Ads

নজরুলের স্মৃতি ধন্য তেওতা রাজবাড়িতে একদিন


মন্দির ও রাজবাড়ির সম্মুখ প্রান্ত

সকাল আটটা আমাদের চার চাকার গড়ি ছুটে চলছে নতুন গন্তব্যে। সাথে আছি আমি আর প্রকৃতি বাংলাদেশ এর সুজন সেন গুপ্ত আর তার দলবল। বারে শুক্রবার তাই সবার চোখে আলসে ঘুম ভিড় করেছে আমি আর আমাদের পাইলট মামুন ছাড়া সবার চোখই বন্ধ। যান্ত্রিক ঢাকার পথ পাড়ি দিয়ে এগিয়ে চলছে আমাদের গাড়ি। যেহেতু শুক্রবার তাই রাস্তায় যানজট কম তবে খালি রাস্তায় বেপরোয়া গতিতে কিছু মিনি বাস খালি রাস্তায় প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। এদিকে গাড়ির ভেতরেই বলাই ভাই বিকট শব্দে নাক ডাকা শুরু করলেন আমি কোন উপায় না দেখে গাড়িতে সিডি প্লেয়ার চালাই। আমাদের আবার পাইলট সাহেবের সব পুরনো দিনের গানের কালেকশন মান্না দের কণ্ঠে অসাধারণ সেই সব গান বেজে চলছে... কফি হাউসের আড্ডা আজ আর নেই, দ্বীপ নিভে গেছে, আকাশ এতো মেঘলা যেও নাকো একলা সেই সব কাল জয়ী গান টঙ্গী এসে আমাদের গাড়ি থামল ফিলিং ষ্টেশনে। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল নয়টা সবাই গাড়ি থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে নিলেন। এদিকে সবারই কম বেশি পেটে খিদে লেগেছে। আমাদের মাঝে সবচেয়ে কম বয়সী আনন্দ বলে উঠল মামারা সকালে তো কিছু পেটে পরে নাই খাবার দিবেন না। যে খাবার সাথে বোঝাই করে এনেছেন বেশি ঠাণ্ডা হয়ে গেলে খেতে ভালো লাগবে না। আমি ও আনন্দের কথায় সায় দিলাম শেষ পর্যন্ত সবাইকে খাবারের প্যাকেট দেওয়া হল। খাবার তালিকায় বাংলাবাজারে বিখ্যাত চৌরঙ্গীর পরোটা ভাঁজি অসাধারণ টেস্ট। তবে এর কৃতিত্ব সব পৃথুর ও সকালের খাবারে দায়িত্বে ছিল। যাই হোক আমাদের সকালের ভরাপেট আপ্যায়নের পর আমাদের গাড়ি ছুটে চললো আব্দুল্লাপুর, আশুলিয়া দিয়ে আমাদের ভ্রমণ গন্তব্যে। ও বলাই তো হলো না আমাদের আজকের ভ্রমণ গন্তব্য বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতি বিজড়িত তেওতা জমিদার বাড়ী।

দেশের পুরাকীর্তি স্থাপনার মধ্যে মানিকগঞ্জের তেওতা জমিদার বাড়ী ইতিহাস অন্যতম। রাস্তার পাশে বড় বড় কলকারখানা, গার্মেন্টস পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি। দেখতে দেখতে আমরা এসে পৌছালাম আমাদের কাঙ্খিত গন্তব্যে। গাড়ি থেকে নামার পর প্রকৃতি বাংলাদেশের সুজন সেন গুপ্ত এই জমিদার বাড়ির ইতিহাস আমাদের মাঝে তুলে ধরলেন। শিবালয় উপজেলার যমুনা নদীর কূলঘেঁষা সবুজ-শ্যামল গাছপালায় ঢাকা তেওতা গ্রামটিকে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে দিয়েছে জমিদার শ্যামশংকর রায়ের প্রতিষ্ঠিত নবরত্ন মঠটি। এক সময়ে জমিদারের বাড়ির আঙিনার এই মঠকে ঘিরে দোলপূজা আর দুর্গাপূজার রঙিন উৎসব পালিত হতো। মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার এই তেওতা গ্রামটি আরও বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী প্রমীলার স্মৃতি জড়িয়ে থাকায়। তেওতা গ্রামের মেয়ে প্রমীলা জমিদারবাড়ী পাশেই বসন্তকুমার সেন আর গিরিবালা সেন দম্পতির মেয়ে আশালতা সেন বা প্রমীলা নজরুল। এর ডাক নাম দুলি। ছন্নছাড়া, ভবঘুরে নজরুল কয়েক দফায় এসেছিলেন এই গ্রামে। তবে জনশ্রুতি হয়েছে ১৯২২ সালে প্রমীলার সাথে একবার এসেছিলেন  ঐ বছর সেপ্টেম্বর মাসে নজরুলের লেখা "আনন্দময়ীর আগমনে" কবিতাটি ধূমকেতু পত্রিকায় প্রকাশ হলে ব্রিটিশ সরকার তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করে। প্রমীলাকে নিয়ে তেওতা গ্রামে আত্মগোপন করেন নজরুল। আত্মগোপনে থাকতে আসলেও দুরন্ত নজরুল অবশ্য ঘরের কোনে বসে থাকেননি। যমুনার ছোঁয়ায় গড়ে ওঠা সবুজ শ্যামল পাখিডাকা তেওতা গ্রামে ছুটে বেরিয়েছেন। গান, কবিতা আর অট্টহাসিতে পুরো গ্রামের মানুষকে আনন্দে মাতিয়েছেন। কখন ও বা জমিদার বাড়ির শান বাঁধানো পুকুর ঘাটে রাতের বেলায় করুণ সুরে বাঁশি বাজিয়ে বিমোহিত করেছে রাতজাগা গ্রামের মানুষকে। 

রাজবাড়ির ভেতরের দৃশ্য
রাজবাড়ির ভেতরের দৃশ্য

জমিদার কিরণশঙ্কর রায়ের আমন্ত্রণে একবার নজরুল তার অতিথি হয়ে আসেন। আর সে সময়ই নজরুল এবং প্রমীলার দেখা হয়েছিল। জমিদারবাড়ীর পাশের বাড়ি বসন্তকুমারের মেয়ে দুলি (প্রমীলা) ছিলেন তখনকার জমিদার কিরণ শঙ্কর রায়ের স্নেহধন্য। বেড়াতে এসে নজরুল জমিদারবাড়ীতে প্রতি রাতেই গান-বাজনার আসর বসাতেন। আর সেখানে একমাত্র গায়ক ছিলেন নজরুল। দুলি তখন মাত্র কয়েক বছরের বালিকা। নজরুল গানের ফাঁকে ফাঁকে পান খেতেন। আর দুলির দায়িত্ব ছিল তার হাতে পান তুলে দেয়া। হয়তো এর মাধ্যমেই নজরুল প্রমীলার পরিচয় আরো ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। বিয়ের পর তেওতার জমিদার কিরণ শঙ্কর রায়ের আমন্ত্রণে নজরুল নববধূকে নিয়ে আবার তেওতায় আসেন। প্রায় দুই সপ্তাহ থাকার সময় জমিদারবাড়ীতে নজরুলের গান ও কবিতার আসর বসতো। দর্শকের আসনে জমিদার পরিবারের পাশে প্রমীলাও থাকতো। আর নজরুল যখন "তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় সেকি মোর অপরাধ.... অথবা, মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী দেব খোঁপায় তারার ফুল" গান গাইতেন তখন লজ্জায় রক্তিম হতেন প্রমীলা। ভবঘুরে জীবনে নজরুল যেখানেই গেছেন সেখানেই তিনি কিছু না কিছু রচনা করেছেন। তেওতার স্মৃতি নিয়েও তিনি অনেক কবিতা গান সৃষ্টি করেছেন বলে নজরুল গবেষক রফিকুল ইসলামের গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে। এমনই একটি হচ্ছে নজরুলের "লিচু চোর কবিতা"তেওতার জমিদারদের স্থানীয়ভাবে বলা হতো বাবু। আর তাদের বিশাল পুকুর ঘিরে তাল গাছ থাকায় বলা হতো তালপুকুর। প্রাচীর ডিঙিয়ে এই পুকুর পাড়ের গাছ থেকে একটি বালক লিচু চুরি করতে গিয়ে মালি ও কুকুরের তাড়া খাওয়ার প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে নজরুল এই কবিতাটি রচনা করা হয়েছে বলে স্থানীয়রা মনে করেন বলে রফিকুল ইসলাম তার গবেষণায় উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়াও তেওতা গ্রামের পাশ দিয়ে যমুনা নদীর স্মৃতিতে বেশ কিছু গান ও কবিতা লিখেছেন। যেমন নীল শাড়ি পরে নীল যমুনায় কে যায়। কেন প্রেম যমুনা আজি হলো অধীর। আজি দোল ফাগুনে দোল লেগেছে.....বৃন্দাবনে প্রেম যমুনায়। 

রাজবাড়ির দোতালায়

আমাদের আজকের ভ্রমণের কাণ্ডারী সুজন সেন গুপ্তের বর্ণনার পর আমরা  রাজবাড়ী দেখা শুরু করলাম। জমিদার বাড়িটি এখনো তার কাঠামোতে দাড়িয়ে আছে। যদিও খয়ে গেছে এর ইটের দেয়াল। বাড়ীর সামনে বিশাল একটি পুকুর, এই পুকুরের জল তরঙ্গে পুরো রাজবাড়ীর অবয়ব দর্শন করা যায়। আর একটি পুকুর পেলাম আমরা, ভেতরে  কিন্তু খুবই করুণ অবস্থা তার। বাড়ির সামনে আছে একটি বহুতল মন্দির। কারুকাজময় মন্দিরটি আজ বিলিন হবার পথে। এখনো যেটুকু সৌন্দর্য অবশিষ্ট রয়েছে তার আকর্ষণও কম নয়। এদিকে প্রকৃতি বাংলাদেশের আনন্দ তার ক্যামেরা নিয়ে একের পর এক ছবি তুলতে থাকলো। আমরা বাড়িতে ঘুরছি হঠাৎ চোখে পড়লো দোতালায় ওঠার  সিড়িআমারা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ঊঠে গেলাম। ছাঁদ থেকে পুরোবাড়ির গঠন কাঠামো দেখতে পেলাম অসাধারণ কারুকার্য খচিত। বাড়ির সামনে মাঠের কোণায় একটি কূয়া আবিষ্কার করলেন আমাদের বলাই ভাই বাড়ির সামনেই আছে সবুজ ঘাসের বড়সড় মাঠ। মাঠেই রয়েছে জমিদারদের তৈরি টিনের চালার এক কাচারিবাড়ি। এখানে সেখানে ভেঙ্গে চুরে একাকার হয়ে গেছে। জায়গায় জায়গায় পরিধেয় জামাকাপড় শুকাতে দেয়া হয়েছে। দেখে মন খারাপ হয়। উন্নতবিশ্বে যে সকল স্থাপনা হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষিত হয়, আমাদের দেশে সেই সকল স্থাপনা পড়ে থাকে অবহেলায়, ক্ষয়ে যায় অস্থি-মজ্জা সকল, ঘুণে ধরে বিচূর্ণ হয় ইতিহাসের পাতা। অপূর্ব সকল স্থাপনা আর নির্মাণশৈলী নিয়ে আমাদের বাংলাদেশের আনাচে কানাচেতে পড়ে আছে অসংখ্য জমিদার বাড়ি, রাজবাড়ীসহ আরও কত স্থাপনা। তেওতা রাজবাড়ি দেখা আমরা আশেপাশের এলাকা ঘুরে দেখলাম বিকেল পাঁচটা তেওতা জমিদার বাড়ী দেখে আমরা আরিচাঘাটে এসে টাটকা মাছ-ভাতডাল দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। নদীর পড়ে শেষ বিকেলটা কাটিয়ে আমরা ফিরতি পথ যখন ধরলাম তখন সন্ধ্যা মিইয়ে গিয়ে রাতের ঝাঁপি চারিপাশে। রাত নয়টা নাগাদ ঢাকা শহরের জ্যাম ঠেলে যখন বাসায় পৌঁছলাম রাত তখন প্রায় দশটা।

রাজবাড়ির ফলক

কিভাবে যাবেনঃ

কয়েকটি পথ ধরে আপনি যেতে পারবেন তেওতা রাজ বাড়ি ঢাকা থেকে আরিচার দূরত্ব ৯০ কিঃ মিঃ। ৩ ঘন্টায় বাসে যেতে ভাড়া দিতে হবে ৮০ টাকার মতো। গাবতলী থেকে যাত্রীসেবা, বিআরটিসি, পদ্মা লাইন, ইত্যাদি বাসে আরিচা ঘাট যেতে পারবেন। আরিচা ঘাট থেকে রিকশায় ২৫-৩০ টাকা ভাড়ায় যাওয়া যাবে তেওতা জমিদার বাড়ি। অথবা ঢাকা থেকে বাসে আরিচা ঘাট এসে নামতে হবে। এরপর সি এন জি অথবা রিক্সা যোগে তেওতা যেতে হবে। এছাড়া নদী পথেও আসা যাবে। এজন্য নৌকায় আরিচাঘাটে এসে নামতে হবে। যমুনা নদী দিয়ে বাংলাদেশের যেকোন পয়েন্টে থেকে তেওতা জমিদারবাড়ী আসা যাবে। মাইক্রো বাস ভাড়া করেও যেতে পারবেন। ভাড়া নেবে ৫০০০ টাকা থেকে ৬০০০ টাকা।



No comments