Header Ads

বাংলার এনসাক্লোপিডিয়া সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়।


যারা বলেন বাঙালির মেধা নেই তারা ভুলের স্বর্গে বাস করেন। অনেকে বলেন বর্তমানে গর্ব করার মতো সেরকম কোনো বাঙালি নেই, যে কথা নিছকই বেঠিক। এখনও বহু সংখ্যক গর্ব করার মতো বাঙালি মানুষ রয়েছেন। আমরা আজকাল সেসব চর্চা থেকে বিরত বলেই জানতে পারছি না তাদের। নবীন প্রবীণ সকল মহান বাঙালিদের নিয়ে প্রবল চর্চার প্রয়োজন রয়েছে। যারা প্রবীণদের শ্রদ্ধা করতে জানেন না, তারা কখনোই নবীনদের শ্রদ্ধা করতে পারেননা। কেন এতো কথা বলছি কারণ আজ একজন প্রবীণ  গর্বিত বাঙালিকে নিয়ে আলোচনা করতে চলেছি। তাকে অনেক বাঙালিই ভুলতে বসেছেন। যার অবদান যুগের পর যুগ বাংলা ভাষার প্রসারের জন্য কাজে লাগবে৷ তিনি হলেন বাংলার 'এনসাক্লোপিডিয়া', প্রখ্যাত ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়।


সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন অত্যধিক মেধাসম্পন্ন বাঙালি, সমগ্র বাঙালির অহংকার। বাংলা ভাষার ব্যুৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে তিনটি খণ্ডে দি 'অরিজিন এন্ড ডেভেলপমেন্ট  অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ' নামে একটি গ্রন্থ লিখেন। যে বইটি বিদ্যাবত্তার পরিচয় প্রদান করে থাকে আমাদের। এই বইটি প্রকাশের পর দেশে-বিদেশে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর এমন অসাধারণ পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে 'ভাষাচার্য' উপাধিতে ভূষিত করেন। তাঁকে দেখে সহজে বলা চলে যে বাঙালি মেধা নিয়েই জন্মায়। জীবনে যা সে গ্রহণ করে তা কেবল নিজেকে পরিপুষ্ট করে তোলার বিদ্যা। 

হাওড়ার শিবপুরে ১৯৮০ সালের ২৬ শে নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। পিতা হরিদাস চট্টোপাধ্যায় ও মাতা কাত্যায়নী দেবী। হরিদাস চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ব্রিটিশদের সওদাগরি অফিসের কেরানি। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ছেলেবেলা কেটেছিল নিদারুণ  কষ্টের মধ্যে। ১৯০৭ সালে মতিলাল শীল ফ্রী স্কুল থেকে তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ষষ্ঠস্থান অধিকার করে মাসিক বিশ টাকা বৃত্তি পান। ১৯০৯ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে এফ.এ পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। ১৯১১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি.এ এবং ১৯১৩ সালে ইংরেজি অনার্স নিয়ে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর ১৯১৪ সালে  এম.এ পাস করার পর কলকাতায় বিদ্যাসাগর কলেজে ইংরেজি ভাষার অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। এই একই বছরেই কমলাদেবীর সঙ্গে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন৷ বিয়ের পর ১৯১৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শ্রেণীর ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯১৯ সাল পর্যন্ত প্রায় চার বছর তিনি এই দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আর এসবের মাঝে ১৯১৮ সালে সংস্কৃত মধ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি ও জুবিলি গবেষণা পুরস্কার অর্জন করেন৷ তারপর ১৯১৯ সালে ধ্বনিতত্ব সম্পর্কে ভারত সরকারের বৃত্তি পেয়ে ইউরোপে যান৷ সেখানে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ফোনেটিক্সে ডিপ্লোমা পান এবং ডি.লিট উপাধি অর্জন করেন। 

লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল 'ইন্দো-আরিয়ান ফিললজি'। ব্রিটেনে থাকাকালীন তিনি ধ্বনিতত্ত্ব ও ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষাতত্ত্ব ছাড়াও প্রাকৃত ভাষা, ফরাসি ভাষা, প্রাচীন আইরিশ ভাষা, প্রাচীন ইংরেজি ও গোথিক ভাষাতে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন৷ অতঃপর তিনি ব্রিটেন থেকে প্যারিসে যাত্রা করেন। এখানকার নামকরা প্রতিষ্ঠান প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে স্লাভ ও ইন্দো-ইয়োরোপীয়ান ভাষাতত্ত্ব, প্রাচীন সগডিয়ান ও প্রাচীন খোতানি ভাষা, ল্যাটিন ভাষার ইতিহাস এবং অস্ট্রো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়াটিক ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। ইউরোপে গবেষণার কাজ সেরে ১৯২২ সালে দেশে   ফিরে আসেন তিনি। দেশে ফিরে আসার পর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কর্তৃক ভাষাতত্ত্বের 'খয়রা' অধ্যাপক হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় কর্মজীবন শুরু করেন। সুদীর্ঘ তিরিশ বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার পর ১৯৫২ সালে এমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে পুনরায় নিযুক্ত হন।  

ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে মালয়, সুমাত্রা, জাভা, বালি ও শ্যামদেশ ভ্রমণ করেন এবং এসব স্থানে ভারতীয় শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কে বক্তৃতা প্রদান করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তিনি বিশেষ ভাবে শ্রদ্ধা করতেন। তাঁকে বাংলা ভাষার চর্চা ও প্রসার ঘটানোর কাজে তিনি অনুসরণ করেছেন।  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধ্বনি আলোচনা পর্যালোচনার প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন- "বাংলার উচ্চারণ সম্বন্ধে কতকগুলি অতি সাধারণ কথা- এত সাধারণ কথা যে সেগুলি আমরা আগে লক্ষ্যই করিনি। রবীন্দ্রনাথ আমাদের চোখের সামনে প্রথম ধরা দেন। বাংলার ধ্বনি সমষ্টির ইতিহাসের সবচেয়ে বিশিষ্ট কতকগুলি সূত্র বোধহয় রবীন্দ্রনাথই সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন।" 

রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম স্বরসঙ্গতি র সূত্রগুলি আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি অবশ্য প্রক্রিয়াগুলোকে শৃঙ্খলভাবে সাজাননি৷ পরবর্তীকালে স্বরসঙ্গতি, সমীভবন প্রভৃতি নামে বা প্রগত, পরাগত, পারস্পরিক প্রভৃতি বিভাগে এই পরিবর্তন-প্রক্রিয়াকে সাজিয়ে পড়ার যে শৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে তা রবীন্দ্রনাথের নেই। কিন্তু প্রক্রিয়াগুলো ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পূর্ণরূপে বর্ণনা করেছিলেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ঐতিহাসিক দিক থেকে এ পরিবর্তন-প্রক্রিয়াগুলো সূত্রবদ্ধ করেন। 

তিনি বাংলা ভাষাসাহিত্যের উন্নতির জন্য অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। যা বাংলা ভাষার এক জীবন্ত দলিল। বাংলা ভাষার রূপদর্শন ও ভাষার ঐতিহাসিক নিদর্শনের কথা এই বইগুলো থেকে বিশেষ ভাবে জানা যায়। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো বেঙ্গলি ফোনেটিক রিডার, কিরাত জনকৃতি, ভারত-সংস্কৃতি, বাংলা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা, পশ্চিমের যাত্রী, ইউরোপ ভ্রমণ, জাতি সংস্কৃতি সাহিত্য, ভারতের ভাষা ও ভাষা সমস্যা, সংস্কৃতি কী, দ্বীপময় ভারত, রবীন্দ্র সঙ্গমে, শ্যামদেশ প্রভৃতি। 

১৯৩৫ সালে তিনি রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালে হিন্দি ভাষাতে বিশেষ অবদানের জন্য সাহিত্য বাচস্পতি উপাধি লাভ করেন। ১৯৫০ সালে লন্ডনের সোসাইটি অব আর্টস এন্ড সায়েন্সের সদস্য পদ লাভ করেন। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত বিধান পরিষদের অধ্যক্ষ পদে বহাল ছিলেন। ১৯৫৫ সালে অসলোর নরওয়েজিয়ান অ্যাকাডেমির সদস্য পদ লাভ করেন। ১৯৬৩ সালে ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মবিভূষণ উপাধিতে ভূষিত হন৷ ১৯৬৬ সালে ভারতের জাতীয় অধ্যাপকের মর্যাদা লাভ করেন এবং ১৯৬৯ সালে সাহিত্য অ্যাকাডেমির সভাপতি নির্বাচিত হন৷ 



No comments