Header Ads

বাণিজ্যে দেশীয় বণিকদের টেক্কা দিয়ে বাংলার মুখ উজ্জ্বল করলেন দানবীর মতিলাল শীল


'বাঙালি ব্যবসা পারে না' এই কথা বাঙালিকে বারবার শুনতে হয়। সত্যিই কী বাঙালি ব্যবসা পারেনা? এ কথা কী আদৌ ঠিক? না, একদমই এটা ঠিক নয়। বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস অন্য কথা বলে৷ বাঙালির ব্যবসা নিয়ে দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। আজ এমন একজন স্বনামধন্য বাঙালি ব্যবসায়ী নিয়ে আলোকপাত করবো যার নাম হয়তো অনেকেই জানেন না। আপনারা সকলেই মতিলাল শীল ঘাটের কথা জানেন৷ কিন্তু কখনো কী জানতে চেয়েছেন মতিলাল শীল কে ছিলেন? যদি না জেনে থাকেন তাহলে এই লেখাটি একটু মন দিয়ে পড়ুন। 



সুবর্ণ বণিক সম্প্রদায়ের এক নিম্নবিত্ত পরিবারে ১৭৯২ খ্রীস্টাব্দে কলকাতার কলুটোলাতে জন্মগ্রহণ করেন মতিলাল শীল। তাঁর বাবা চৈতন্যচরণ শীল ছিলেন একজন নামকরা কাপড় ব্যবসায়ী। যার চীনাবাজারে রমরমিয়ে কাপড়ের ব্যবসা চলতো। কিন্তু মতিলাল শীলের এমনই দূর্ভাগ্য যে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি তাঁর বাবাকে হারান। তাঁর বাবার মৃত্যুর পর তিনি এক আত্মীয়ের পরিবারে বাস করতে লাগলেন। যার ফলে পড়াশোনা করার খুব একটা সুযোগ পেলেন না। যদিও সেকেলে পড়াশোনা করার সুযোগও কম থাকতো। তবুও তিনি পড়াশোনা মোটামুটি ভাবে বেশ কিছু বছর চালিয়ে গেছেন। পাঠশালাতে তিনি বাংলা ভাষা ও শুভঙ্করের গণিত প্রণালী তিনি মন দিয়ে আয়ত্ত করেন। কিছুকাল তিনি মার্টিন বোওল ইংরেজি ও পরে নিত্যানন্দ সেনের বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করেন। ব্রিটিশ আমলে সকলের কাছে একটা প্রচলিত ধারণা ছিল যে ইংরেজি জানলে বড়ো সরকারি কেরানী হওয়া যায়। মতিলাল শীলের তেমন কোনো ডিগ্রি না থাকলেও নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি এক ব্রিটিশ কোম্পানির আপিসে কেরানীর কাজ পান। তবে কেরানীর কাজ খুব বেশিদিন ভালো লাগলো না তাঁর। কাজেই কেরানীবিদ্যার মোহ ত্যাগ করে তিনি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ভাবে ব্যবসা শুরু করলেন৷

এক বিদেশি মদের কোম্পানিতে সামান্য বোতল এবং কর্ক ছিপি সরবরাহকারী হিসাবে তিনি ব্যবসায়িক জীবন শুরু করেন। সময়ের সাথে সাথেই তিনি একজন বড়ো রপ্তানিকারী হয়ে ওঠেন৷ তিনি প্রায় তেরোটি বাষ্পচালিত জাহাজ কেনেন। পূর্ব ভারতে আভ্যন্তরীণ জলপথের ব্যবসা তিনিই প্রথম শুরু করেন৷ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার একজন পত্তনকারী হিসাবে তাঁর নাম শোনা যায়। অর্থের দিক থেকে তৎকালীন সময়ে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সমান প্রতিপত্তি ছিল তাঁর। তিনি সর্বদা আত্মমর্যাদা রক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন। ইংরেজদের দেওয়া রায়বাহাদুর, স্যার ইত্যাদি খেতাব তিনি বর্জন করেছেন।

মতিলাল শীল ব্রিটিশ আমলেও বাংলা থেকে রেশম, নীল, চিনি, সোরা ও চাল ইউরোপের বাজারে রপ্তানি করতেন। ইউরোপ থেকে আমদানি করতেন বস্ত্র ও লৌহজাত সামগ্রী। তাঁর হাতে বাংলার বাণিজ্য শিল্পে ক্রমশ জোয়ার উঠতে শুরু করে। বাংলার বাণিজ্য শিল্পে আশার আলো সঞ্চার করলেন তিনি। তিনি প্রায় তেরোটি জাহাজের মালিক ছিলেন। দেশীয় পণ্য বহন করে পৃথিবীর নানান দেশের বন্দরে পাড়ি জমিয়েছিল তাঁর জাহাজগুলো। দেশীয় পণ্য আমদানি ও রপ্তানিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল তাঁর জাহাজগুলো। শোনা যায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরও তখন গার্ডেনরিচে জাহাজ তৈরি করেছেন।  

জাহাজ ব্যবসায় অন্যান্য দেশীয় বণিকদের সাথে প্রতিযোগিতায় তিনি গা ভাসিয়ে দেন। বেশিরভাগ দেশীয় বণিকদের বাণিজ্যে টেক্কা দিতে তিনি বানিয়ে ফেললেন বাষ্পীয় জাহাজ। যা ভারতের প্রথম বাষ্পীয় জাহাজ। সেকারণে তাঁকে ভারতের বাষ্পীয় জাহাজের পথিকৃৎ বলা হয়। তবুও তাদের সময়ে বাংলার বাণিজ্যের যে একটা সুদিন ছিল তা একটু একটু করে খর্ব হতে লাগলো। দেশীয় বণিক ও বিদেশি বণিকদের মধ্যে বিরোধের জেরে বহু বণিক ব্যবসা গোটাতে শুরু করে দেন৷ তিনিও ব্যবসা গোটাতে বাধ্য হন৷ তাই ব্যবসা গুটিয়ে তিনি মঙ্গলঘাট, বাগনান ও মহিষাদলে জমিদারি কিনলেন। এর পাশাপাশি কলকাতাতেও বহু বাড়িঘর তিনি কিনতে লাগলেন৷ জ্যাকসন সাহেবের কাছ থেকে ধর্মতলা বাজারও তিনি ক্রয় করলেন। 

কেবল বাণিজ্যই নয়, তিনি ছিলেন একজন সমাজসেবী ও দানবীর। দু'হাত ভরে একদিকে যেমন তিনি মোটা অর্থ রোজগার করেছেন অন্যদিকে সেই অর্থ দু'হাত ভরে বিলিয়েও দিয়েছেন৷ তিনি নিজেকে অসংখ্য সমাজকল্যাণমূলক কাজের সাথে জড়াতে লাগলেন৷ হিসেবহীন পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি সাজিয়েছেন কলকাতাকে৷ ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে বেলঘরিয়াতে তৈরি করেছিলেন আর্তপীড়িতদের জন্য আশ্রম। ১৮৪২ সালে পথচলা শুরু হয় মতিলাল শীল ফ্রী কলেজের। পরবর্তীকালে এই কলেজের সাথে যুক্ত হয় স্কুলও৷ মিশনারী বিমুখ ছাত্রদের যাতে ব্রিটিশদের সাথে প্রতিযোগিতায় না হেরে যায় তার জন্য তিনি এ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের পঠন-পাঠন ও কার্যক্রম ছিল অত্যন্ত আধুনিক মানের৷ সেন্ট জের্ভিয়াস কলেজ পরিচালনা করতো এই প্রতিষ্ঠানের পঠন-পাঠন। তিনি ঘোষণা করেন যে ধর্মের ভিত্তিতে কোনো ছাত্রকে আলাদা করা যাবে না। তিনি দেখলেন এ কথা বলার পরও পাদ্রীরা এ নিয়ম মানছেন না। তাই তিনি এ কলেজের দায়িত্ব দেন রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জিকে। তখনকার দিনে কলেজের বার্ষিক ব্যয় ছিল বারো হাজার টাকা। যা আসতো মতিলাল শীলের ট্রাস্ট থেকে। তিনি হিন্দু কলেজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে তিনি আর্থিক ভাবে সাহায্য করতে লাগলেন। তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের জন্য জমিদান করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বিধবা বিবাহ প্রচলনের জন্য তিনি আর্থিক ভাবে সাহায্য করেছিলেন। রাজা রামমোহন রায়কে তিনি সমাজ সংস্কারমূলক কাজে অর্থ দিয়ে সহায়তা করতেন। 

তাঁর ব্যবসায়ীক অবদান ও সমাজকল্যাণকর কাজের জন্য তাঁকে বলা হতো 'রথসচাইল্ড অফ ক্যালকাটা'। স্বয়ং শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর নিখাদ প্রশংসা করে তিনি বলেছেন যে তাঁর মতো সৎ ও বিনয়ী বাঙালি উদ্যোগপতি ছিলেন খুবই বিরল৷ কোনোদিন অসৎ পথে বা কাউকে না ঠকিয়ে নিঃস্বার্থ ভাবে তিনি বাণিজ্য করেছেন। 

No comments