Header Ads

রক্তাক্ত বরাক, ইতিহাসের শিরোনামে বরাকের ভাষা আন্দোলন


"সে যে বলে গেল জান দেব তবু জবান কখনো দেবো না। ভাত বেড়ে রেখো, ফিরে এসে খাবো। না এলেও মাগো ভেবো না।" ছোট্ট মেয়েটি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো বাংলা ভাষার অধিকারের দাবীতে। ঘরে ফেরা আর হলো না মেয়েটার। আসাম পুলিশের গুলিতে শহীদ হলো ছোট্ট মেয়েটি যার নাম কমলা ভট্টাচার্য। তিনি হলেন প্রথম নারী ভাষা শহীদ। আজকের প্রজন্ম হয়তো এ নামটার সাথে পরিচিত নন কিন্তু প্রতিটি বাঙালির জানা উচিৎ তাঁর নাম। কেবল কমলা ভট্টাচার্যই নয়, জানতে হবে বরাক উপত্যকা বা ঈশান বাংলার ভাষা আন্দোলনের কথা। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ এপারের বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনও। পৃথিবীর একমাত্র জাতি হলো বাঙালি যাদের ভাষার জন্য সবচেয়ে বেশি লড়াই করতে হয়েছে। 


আজকে এপারে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের আক্রমণে বাংলা ভাষার মেরুদণ্ড ক্রমশ ভেঙ্গে পড়ছে। বাঙালি ভুলে যাচ্ছে শিরদাঁড়া সোজা রাখতে। নিজের ভাষার প্রতি টান দিন দিন কমে যাচ্ছে বাঙালির মধ্যে। তবে এই অবস্থারও পরিবর্তন খুব তাড়াতাড়িই বাংলাতে হবে৷ ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালিদের সকল মহান কাজকর্মগুলো পাঠ্যবই তে বেশি করে স্কুল-কলেজে পড়াতে হবে৷ বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে ক্লাবে, খেলার মাঠে, বাসে বা ট্রেনে অত্যধিক পরিমাণে বাঙালি নিয়ে বেশিরভাগ বাঙালিকে চর্চা করতে হবে৷ অন্যের ভাষাতে গোলাম হয়ে থাকা কখনোই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। নিজস্ব ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা হলো সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। পৃথিবীর শক্তিধর দেশগুলো তাদের মাতৃভাষাকে কাজে লাগিয়েই উন্নত হয়েছে। আমাদেরও উচিৎ মাতৃভাষা নিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে কাজকর্ম করা। 

১৯৬০ সালের দিকে সরকারি ভাবে এক ফরমান জারি হয়। যে ফরমানে বলা হয় আসামের দাপ্তরিক ভাষা হবে অসমিয়া। অথচ আসামের একটা বৃহৎ অংশ বাংলা ভাষাতে কথা বলেন। সেখানকার কোনো বাঙালি এটা মেনে নিতে পারেন নি। সকল বাঙালি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আন্দোলনে সামিল হন। সকলের একটাই লক্ষ্য 'জান দেবো তবু জবান দেবো না।' ১৯৫০ সালে আসামে বাঙ্গাল খেদাও আন্দোলনের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট সূচিত হয়। ১৯৬০ সালে সরকারের অসমিয়া ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা করবার ভুল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বাঙালি সমাজ সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আন্দোলনে আছড়ে পড়তে থাকে।   

১৯৬১ সালের ১৯ শে মে শিলচরে প্রবল বিক্ষোভ ও পিকেটিং এ সামিল হন বরাক উপত্যকার বাঙালি সমাজ। শুরু হয় তুমুল আন্দোলন।প্রায় ত্রিশ হাজারেরও বেশি সত্যাগ্রহী শিলচরে সংগ্রামী পরিষদ গড়ে তোলেন। শিলচরের তারাপুর ষ্টেশনে অভূতপূর্ব জনস্রোত তৈরি হয়। উত্তেজিত বাঙালি আন্দোলনকারীদের ওপর এলোপাথাড়ি গুলি বর্ষণ করতে থাকে আরপিএফ পুলিশেরা। ঘটনাস্থলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন নয় জন ভাষা সৈনিক৷ সেদিন বাংলা ভাষার জন্য আসামে প্রাণ দিতে হয়েছিল কমলা ভট্টাচার্য, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, কানাইলাল নিয়োগী, চন্ডীচরণ সূত্রধর, হীতেশ বিশ্বাস, সুকোমল পুরকায়স্থ, সুনীল সরকার, কুমুদ রঞ্জন পাল এবং তরণী দেবনাথ। এ ঘটনার দুই দিন পর ২১ শে মে শহীদ হন সতেন্দ্র দেব এবং বীরেন্দ্র সূত্রধর। ১৯ শে মে এবং ২১ শে মে মিলিয়ে প্রায় এগারো জন ভাষাসৈনিক শহীদ হয়েছিলেন। 

উনিশে মে সত্যাগ্রহীদের গ্রেপ্তার করার বদলে সশস্ত্র বাহিনীর একদল লোক সহসা মহিলা ও বালিকাসহ সত্যাগ্রহীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে৷ এমনকি তাদের রেললাইন থেকে টেনে হিঁচড়ে রেললাইন থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা ব্যর্থ করে। কিছুক্ষণ পরেই ৬ টা ২০ মিনিট নাগাদ ছোটো মেয়ে, মধ্যবয়স্কা মহিলা ও অন্যান্য সত্যাগ্রহীর ওপর বেত্রাঘাত করা হয়। যদিও বেত্রাঘাতে আহত হওয়া সত্বেও সত্যাগ্রহীদের সরাতে অক্ষম হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যে কাঁদুনে গ্যাস ফাটানো হয়।তৎসত্ত্বেও বহু সত্যাগ্রহী শান্তিপূর্ণ ভাবে বসে থাকেন৷ যারা কাঁদুনে গ্যাসের যন্ত্রণায় ঐ স্থান ত্যাগ করেছিলেন তাদের জায়গায় আসেন নতুন আরেক দল সত্যাগ্রহী। কিন্তু ঐ সদর রাস্তার শান্তিপূর্ণ ভাবে দণ্ডায়মান একদল সত্যাগ্রহীর ওপর পুলিশ হঠাৎ বেপোরোয়া লাঠিচালনা শুরু করে৷ ফলে আক্রমণ এতোটাই অতর্কিত হয়ে ওঠে যে সকলে এদিক ওদিক দৌড়াতে থাকে। এরপর পুলিশ গুলি বর্ষণ করে হত্যা করে নয়জন ভাষাসৈনিককে। একুশে ফেব্রুয়ারির মতো সমান প্রাসঙ্গিক বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন। বাঙালি শহীদের আত্মত্যাগের ফলপ্রসূত ঈশান বাংলার প্রধান ভাষার মর্যাদা লাভ করে বাংলা ভাষা। অতএব আজকের দিনটিকে সকল বাঙালির কর্তব্য স্মরণ করা।

No comments