Header Ads

এ সময় আজও ঋতুহীন


সত্যজিৎ রায়ই আমাকে চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। আমি জানি না আমার সিনেমাগুলো তপন সিনহা কিংবা অজয় করের মতো মনে হয় কিনা। যদি হয়, তাহলে তা একেবারেই কাকতালীয়। তবে হ্যাঁ, আমি অজয় কর বা তরুণ মজুমদারের সিনেমা দেখতে ভালোবাসি। আমি করের সাত পাকে বাঁধার বেশ ভক্তও বলা যায়। তাঁর শিল্পভাণ্ডারের মধ্যে  এই সিনেমাটির আলাদা একটা আবেদন আছে। আপাতদৃষ্টিতে এই ছবিটির কিছুটা ছায়া পাওয়া যায় উনিশে এপ্রিলে। তবে উনিশে এপ্রিল মূলত সত্যজিৎ রায়ের জলসাঘর থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই তৈরি করেছি আমি৷ এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন এই মূল্যবান কথাগুলো। যার চলচ্চিত্রে ছিল বিশ্বমানের নির্মাণশৈলী। যার ছবিতে বারংবার উঠে এসেছিল রবীন্দ্র ভাবনা৷ যার সব চরিত্রই ছিল কাল্পনিক।  তিনি হলেন প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ।  


২০১৩ সালের ৩০ শে মে টিভির পর্দায় সকল বাঙালির চোখ। রিমোট নিয়ে ব্যস্ত চ্যানেল পাল্টাতে। হঠাৎ খবরের শিরোনামে ধরা দিয়েছিল এক শোকসংবাদ। ঋতুপর্ণ ঘোষের জীবনাবসান। যে খবরে সবার চোখ ভরে উঠলো অশ্রুধারাতে। বাংলা ছবির ইন্ডাস্ট্রি অনেক তাড়াতাড়ি হারিয়ে ফেললো একজন আলোকিত নক্ষত্রকে। যে নক্ষত্রের আলো নিভে যাওয়াটা ছিল অত্যন্ত দুঃখজনক। আজকে এতগুলো বছর কেটে যাওয়ার পরও টলিউডের কেউই আজও মেনে নিতে পারেননি যে তিনি আর নেই৷ অথচ তাঁর চলচ্চিত্রগুলো স্মৃতির পাতায় জাজ্বল্যমান। 

তাঁর পরিচালিত ছবির মধ্যে অন্যতম হীরের আংটি, চোখের বালি, নৌকাডুবি, উনিশে এপ্রিল, দহন, অসুখ, উৎসব, অন্তরমহল, খেলা, আবহমান, দোসর, সব চরিত্র কাল্পনিক, চিত্রাঙ্গদা, দ্য লাস্ট লিয়ার প্রভৃতি। চলচ্চিত্রের মুন্সিয়ানায় বাংলা ছবিকে তিনি পৌঁছে দিয়েছিলেন বিশ্বের দরবারে। সঙ্গীত পরিচালক রাজা নারায়ণ দেব ঋতুপর্ণ ঘোষের সাথে কাজ করার প্রসঙ্গে বলেন "ঋতুদার সাথে কাজ করা মানে গুরু-শিষ্যের মতো কাজ করা। ছবির সঙ্গে মিউজিকের মেলবন্ধন তিনিই শিখিয়েছেন। তিনি খুব ভালো ভাবে জানতেন যে কোন মিউজিকটা কোন ছবিতে ব্যবহার করতে হবে।" বাংলা চলচ্চিত্রকে তিনি এক নতুন পথের দিশা দেখিয়েছিলেন। 

দুই দশকের কর্মজীবনে ১৯ টি চলচ্চিত্রের মধ্যে তিনি ১২ টি ছবিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছেন। তিনি কেবল পরিচালকই ছিলেন না, একজন পরিণত অভিনেতা হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাঁর অভিনয়ের ধরণ ছিল একদম অন্য ঘরানার। কখনো সমকামী চরিত্রে, কখনো নারীচরিত্রে, কখনো একজন কালপুরুষের চরিত্রে তিনি অভিনয় করে মন জয় করেছেন চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের। তিনি চিত্রাঙ্গদা, আরেকটি প্রেমের গল্প, কথা দেইথিল্লি মা কু ও মেমরিজ ইন মার্চ ছবিতে অভিনয় করে অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। লেখক, পরিচালক ও অভিনেতা সবক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সফল বিতর্কিত নায়ক৷ বাংলা ছবির চেনা ছককে তিনি ভেঙ্গে দিয়ে বাংলা ছবিতে নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিলেন। যে-কোনো অভিনেতা ও অভিনেত্রীকে সহজ উপায়ে পরিণত করার সকল ক্ষমতা একমাত্র তাঁর মধ্যেই বিদ্যমান ছিল। 

বেশিরভাগ ছবিতেই রবীন্দ্রনাথ ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। প্রতিটি ছবিকে এক্সপেরিমেন্ট করে জীবন্ত করে তুলতেন তিনি৷ মানুষের সম্পর্ক নিয়ে ছবি বানাতে তিনি দারুণ পছন্দ করতেন। সব চরিত্র কাল্পনিক, চোখের বালি, বাড়িওয়ালি, নৌকাডুবি, রেনকোট, দোসর, আবহমান, তিতলি ও দ্য লাস্ট লিয়ার ছবির গল্প ছিল মানুষের সম্পর্ক নিয়ে। মানুষের সম্পর্ক থেকে বেরিয়েও তিনি অন্যান্য বিষয়েও ছবি বানিয়েছেন। যেমন হীরের আংটি, অন্তরমহল, দহন, অসুখ, উনিশে এপ্রিল, চিত্রঙ্গদা ও সত্যান্বেষী ছবির গল্প ছিল একটু আলাদা ধাঁচের। সাহিত্যনির্ভর ছবি নির্মাণেও তাঁর আলাদা গুরুত্ব ছিল। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা উপন্যাস চোখের বালি, নৌকাডুবি বা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস হীরের আংটি, দোসর কিংবা ও হেনরির ছোটোগল্প 'দ্য গিফট অফ দ্য ম্যাজাই' থেকে রেনকোট অথবা প্রখ্যাত বাংলা কণ্ঠশিল্পী তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় দ্বারা প্রতিমূর্তির একটি সংক্ষিপ্ত কাহিনী থেকে অন্তরমহল, শেক্সপিয়ারের নাটক থেকে দ্য লাস্ট লিয়ার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য কর্তৃক উৎস থেকে দহন এবং শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ব্যোমকেশ থেকে সত্যান্বেষী। তাঁর নির্মিত সকল ছবিতেই লুকিয়ে ছিল অন্যধারার জিয়নকাঠি। 

২০১৩ সালের গ্রীষ্মে আজকের দিনে বাংলা ছবির দর্শকদের কাঁদিয়ে এ বিশ্ব ছেড়ে বিদায় নিলেন তিনি৷ পড়ে রইলো তাঁর সৃষ্টিরা। বাংলা ছবির এক অভিভাবক হিসেবে দীর্ঘ কয়েক বছর সিংহাসনে রাজত্ব করার পর অকালমৃত্যু কেড়ে নেয় তাঁর জীবন। আজ সেই সিংহাসন থেকে আছে কিন্তু সেই সিংহাসন আজ রাজা শূন্য।

No comments