Header Ads

সবুজ মাঠকে বিদায় জানিয়ে অমৃতলোকে যাত্রা করলেন চুনী গোস্বামী


ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাস বললেই ভেসে আসে একগুচ্ছ বাঙালি ফুটবলারের নাম। যারা ফুটবল তারকা হয়ে ক্রীড়া জগতে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। গোষ্ট পাল, কৃষাণু দে, শৈলেন মান্না, পি.কে.ব্যানার্জি, চুনী গোস্বামী এনাদের অবদানকে কখনোই অস্বীকার করা যায়না। এনাদের হাত ধরেই ভারতের ফুটবল আন্তর্জাতিক তকমা পেয়েছিল। আজ সেইসব দিন হারিয়ে গেছে। ফুটবলে ভারতীয় ফুটবল টিম হারাতে বসেছে আন্তর্জাতিক তকমা। বর্তমানে ফুটবলে ভারতের ফিফা রেঙ্কিং ১০৮। যা এককথায় ভীষণ লজ্জার। তবে এই লজ্জার মান বাঁচিয়েছিলেন বঙ্গ-সন্তানেরা। বাংলার গর্ব দুই ফুটবল ক্লাব মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল ক্লাব যা দিয়েছে ভারতীয় ফুটবলকে তা কেউ হেসে উড়িয়ে দিতে পারবে না। 



বাংলার ফুটবলের সোনালী দিন হারিয়ে গেছে। আজ শুধুই ফাঁকা ময়দান। কৃষাণু, শৈলেন, পি.কে আর এবার চুনী সকলেই একে একে মাঠ শূন্য করে ময়দানকে বিদায় জানিয়েছেন। কেবল পড়ে রইল তাদের স্মৃতি। যে স্মৃতি হয়তো বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে যুগের পর যুগ। গতকাল পরলোকে গমন করলেন চুনী গোস্বামী। কয়েকমাস আগে পি.কে ব্যানার্জী মারা গেলেন৷ তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত হতে পারেন নি তিনি৷ পি.কে ব্যানার্জীর মৃত্যুতে তিনি ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। বন্ধু পি.কে ব্যানার্জীর মৃত্যুর রেশ কাটতে না কাটতেই আবারো নক্ষত্রপতন। চলে গেলেন চুনী গোস্বামী। আগামীদিনে আর কী আমরা পাবো চুনীবাবুদের মতো ফুটবল তারকা? এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। 

চুনী গোস্বামীর আসল নাম ছিল সুবিমল গোস্বামী। জন্ম তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত কিশোরগঞ্জে। যা বর্তমান বাংলাদেশে অবস্থিত। চিনা অলম্পিকে দেশের হয়ে জাতীয় দলে তাঁর অভিষেক ঘটেছিল। এপার বাংলাতে কিছু মানুষের একটা ধারণা রয়েছে যে ইস্টবেঙ্গল মানেই সেখানে পূ্র্ববঙ্গ থেকে আসা উদবাস্তুরা খেলে। যা একদমই ভ্রান্ত। সেই স্পর্ধা নিয়েই ইস্টবেঙ্গল শতবর্ষে পদার্পণ করেছে। সেকেলে ইস্টবেঙ্গলে ওপার বাংলার মানুষই বেশি খেলতো এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তিনি জন্মসূত্রে বাংলাদেশের হলেও খেলাধূলা সূত্রে এপারে আসা। ক্রীড়াজগতে সফল কেরিয়ার তৈরি করা। ফুটবলকে ভালোবেসে তিনি এপারে খেলতে আজীবন এই দেশের নাগরিক হয়েই জীবন কাটালেন। সেকেলে এপার-ওপার দুই বাংলাই ভারতের অংশ ছিল। কাজেই তিনি ভারতীয় তো বটেই তবে তাঁর পরিচয় ছিল তিনি বাঙালি। কথায় আছে খেলাধূলোর কোনো দেশ হয়না। তাই চুনী গোস্বামীর দেশ ছিল এই পৃথিবীর ঘাসে ঢাকা সবুজ মাঠ।         
    
চুনী গোস্বামী মোহনবাগান দলে ফুটবলে নিজের নাম লিখিয়েছিলেন। তাই অনেকে প্রশ্ন তুলতো যে চুনী গোস্বামী তো পূর্ববঙ্গের লোক। তাই ইস্টবেঙ্গলকে গোল দেয়না। এমনই হাজারো অপমানের জাল গায়ে জড়িয়েছিল তাঁর। তবুও তিনি মচকে যাননি৷ নিজেকে গাছের শিকড়ের মতো মাটির সাথে আঁকড়ে ধরেছিলেন৷ ১৯৪৬ খ্রীস্টব্দে মোহনবাগান দলে তিনি ক্লাব ফুটবলে নাম লিখিয়েছিলেন৷ বলাইচাঁদ চট্টোপাধ্যায় ও বাঘা সোমের মতো বিখ্যাত ভারতীয় ফুটবলারদের তিনি কোচ হিসেবে পেয়েছিলেন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি মোহনবাগান দলের হয়ে অধিনায়কত্ব করেছিলেন৷ তাঁর নেতৃত্বে মোহনবাগান ডুরান্ড কাপে যথেষ্ট ভালো ফলাফল করেছিল। ১৯৬২ খ্রীস্টাব্দে জাকার্তায় এশিয়ান গেমসে তাঁর নেতৃত্বে সোনাজয় ভারতীয় ফুটবলের সম্মান বৃদ্ধি করেছিল। ফাইনাল ম্যাচে দুই-এক গোলে সাউথ কোরিয়াকে হারিয়ে সোনা এসেছিল। এই ম্যাচে দুটো গোল করেছিলেন পি.কে ব্যানার্জী ও জার্নেল সিং৷ এরপর তেল আভিডে এশিয়া কাপে রৌপ্য পদক জয়লাভ হয়েছিল ভারতের তাঁরই নেতৃত্বে৷   

তিনি ফুটবল জীবনে অবসর নিয়ে রনজি ট্রফিতে ক্রিকেট খেলা শুরু করেন। রনজিতে ৪৬ টি ম্যাচে তিনি ১৫৯২ রান করেছেন। তিনি ছিলন অলরাউন্ডার। বোলার হিসেবে তিনি ছিলেন ডান কবজি ফাস্ট বোলার৷ ব্যাটিং হিসেবে তিনি ছিলেন ডানহাতি। তিনি প্রায় ২৯১৭ টি বল করে ৪৭ টি উইকেট পেয়েছিলেন৷ তাঁর সর্বোচ্চ রান ছিল ১০৩। ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমির তিনি পরিচালক ছিলেন। ১৯৯১ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত ভারতীয় ফুটবল দলের তিনি কোচ ছিলেন। ক্রিকেট ও ফুটবল দুই খেলাতে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখা এমন প্রতিভা ভারতে খুবই বিরল। এমনই শক্তিশালী ছিলেন তিনি৷ সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ থেকে বাইশ গজ তিনি দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। ক্রীড়াজগতে তাঁকে সম্মান জানানোর জন্য ১৯৬৩ সালে প্রদান করা হয়েছিল অর্জুন পুরস্কার। ১৯৮৩ খ্রীস্টাব্দে তাঁকে প্রদান করা হয়েছিল পদ্মশ্রী এবং ২০০৫ সালে তিনি অর্জন করেন মোহনবাগান রত্ন। 

গত ৩০ শে এপ্রিল বিরাশি বছর বয়সে প্রয়াত হলেন চুনী গোস্বামী। কয়েকদিন ধরে সুগার, প্রসট্রেট ও স্নায়ু সমস্যাতে তিনি ভুগছিলেন। গতকাল কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া ক্রীড়াজগতে। ফুটবলের ইতিহাসে তিনি থেকে যাবেন অমর হয়ে।


No comments