Header Ads

বাংলা ভাষাতে তেমন বিজ্ঞানচর্চা হয়না, যা এক ভ্রান্ত ধারণা


অনেকেই আজকাল আক্ষেপ করে থাকেন যে “বাংলায় আর তেমন বিজ্ঞানচর্চা হয় না।” আমার মনে হয় যে,এই ব্যাপারটি পুরোপুরি ঠিক নয়। অর্থাৎ, তাঁদের এই হাহুতাশকে অভ্রান্ত বলে অনেকাংশেই বিবেচিত করতে পারা যায় না। বরং হলফ করে বলাই যায় যে, বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা হচ্ছে বরং যথেষ্ট পরিমাণেই হচ্ছে। তাতে, অনেকের মনে হবে যে এতই যখন হচ্ছে তখন অসুবিধেটা ঠিক কোথায়? অর্থাৎ, কেন বারে বারে মনে হয় যে বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা তেমন হচ্ছে না। এক্ষেত্রে, অসুবিধা বা সমস্যা হল প্রচারের ক্ষেত্রে। 



বাংলায় এতো উদ্ভাবনী, বিজ্ঞান, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, সংস্কৃতি সহ ইত্যাদির চর্চা যে হয় তার কয়টা ফলাওভাবে উৎসাহে প্রচার করা হয়? বিষয়ের গভীরে গেলে দেখতে পাব যে,মিডিয়া অনেক সময় এসব বিষয়ে বিশেষত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিষয় যেটা খুবই সাধারণ স্তরে, সাধারণ মানুষের জন্য সংঘটিত হয়ে থাকে বা রূপায়ণ করা হয়ে থাকে সেই ব্যাপারে প্রচার করার ক্ষেত্রে উদাসীন। এটা তাদের দোষ নয়। আসলে, বাংলার সমাজকে আমরা অপ্রাসঙ্গিক বা অতিরঞ্জিত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় আলোচনায় ভরিয়ে রেখেছি। এসব বিষয় অবশ্যই আলোচনা দরকার কিন্তু তার একটা গণ্ডি থাকা প্রয়োজন যাতে অন্যান্য বিষয়ের মনস্তাত্ত্বিক আলোচনাও তার প্রাসঙ্গিকতা লাভ করে। বাংলায় বিজ্ঞানের কোথায় কি ঘটছে সেই ব্যাপারে মিডিয়ার অবদান অবশ্যই প্রশংসনীয়-কোনো সন্দেহ নেই। এই প্রচারের ফলে, অন্যান্য আগ্রহী অথচ মনোবল তেমন নেই সেইসব মানুষদেরকেও কাছে টানা যাবে, তাদেরও উৎসাহিত করে এই কাজে লাগানো যাবে বলে আমার ধারণা। আজ হয়তো “মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, কিন্তু মস্তিষ্ক ঢেকে যায় কি বিজ্ঞানে?” এই প্রশ্নটা বড়োই গুরুত্বপূর্ণ।

জনৈক একজন ব্যক্তির একটি নামকরা বাংলা দৈনিকে বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা নিয়ে আক্ষেপের সুর হয়তো এই অজ্ঞতারই পরিচয় বহন করে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি যে, বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে রাজ্য, কেন্দ্র উভয়ই সরকার এমনকি বেশ কিছু বেসরকারি সংস্থার অবদানও নিঃসন্দেহে ভোলার নয়। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও বাংলাদেশে বহু বিজ্ঞানের পত্রপত্রিকা এবং অনলাইন পত্রিকা বেশ রমরমিয়ে চলছে। কিছু উল্লেখযোগ্য পত্রিকার নাম করতে পারি যেমন আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রতিষ্ঠিত ‘বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ’ থেকে প্রকাশিত নামকরা ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ পত্রিকা, ত্রিপুরার সুপ্রসিদ্ধ ‘জ্ঞান বিচিত্রা’ প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত ‘জ্ঞান বিচিত্রা’ পত্রিকা, কলকাতার ‘বিজ্ঞান মনস্ক’-র সমীক্ষণ পত্রিকা, কাঁচরাপাড়া থেকে প্রকাশিত ‘বিজ্ঞান অন্বেষক’ পত্রিকা সহ ইত্যাদি। এছাড়াও বিভিন্ন পত্রপত্রিকা যেমন শুকতারা, আনন্দমেলা, উদ্বোধন, সমাজশিক্ষা অন্যান্য রচনার পাশাপাশি বিজ্ঞানের লেখাও প্রকাশ করে থাকে। আজকাল এই ওয়েবজিনের সময়েও, বিজ্ঞানের বিভিন্ন নামকরা ওয়েবজিনের নাম করতে পারি যেমন ‘বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানী’, ‘bigyan.org.’, ‘বিজ্ঞানের পত্রিকা’ ইত্যাদি। এছাড়াও, ফেসবুকে অসংখ্য বিজ্ঞানের পেজ ও গ্রুপ রয়েছে যেমন ‘বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানী’, ‘জ্যোতির্বিদ্যা ও সৃষ্টিতত্ত্ব’, ‘কৃষ্ণেন্দু মন্ডল’, ‘বিজ্ঞান কথা’,’জয় মা কালী কেমিক্যাল কোম্পানি’, ‘বিজ্ঞানঃ জানা ও অজানা’, ‘অন্বেষণ বিজ্ঞান সংস্থা’ ইত্যাদি।

বাংলায় বিজ্ঞান বই প্রকাশের দুনিয়ায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী তো বটেই এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, সাহিত্য সংসদ, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ, দে’জ, আনন্দ পাবলিশার্স, জ্ঞান বিচিত্রা,দিল্লীর ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, বাংলাদেশের প্রথম আলো, অন্বেষা প্রকাশন, অনুপম প্রকাশন সহ এপার-ওপার বাংলার অসংখ্য প্রকাশনা সংস্থার অবদান অনস্বীকার্য। কিছু বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ ছোটদের জন্যে সংকলন এবং কোষ হল দে’জ-এর ‘ছোটদের সেরা বিজ্ঞান রচনা সংকলন’, আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত ড.পার্থসারথি চক্রবর্তীর ‘ছোটদের বিজ্ঞানকোষ’, সাহিত্য সংসদ থেকে প্রকাশিত বিষ্ণুপদ চক্রবর্তীর ‘ছোটদের বিজ্ঞানকোষ’ ইত্যাদি। 

বর্তমানকালের বাঙালি বিজ্ঞান লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু জনের নাম নিতে পারি যেমন- অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, ড.পার্থসারথি চক্রবর্তী, রণতোষ চক্রবর্তী, কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী, প্রয়াত রমাতোষ সরকার, ড.নারায়ণ সান্যাল, পথিক গুহ, আবীর গুপ্ত, সুধাংশু পাত্র, বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী, প্রয়াত শংকর চক্রবর্তী, ড. মণি ভৌমিক, বিকাশ সিংহ, ড.দীপক ঘোষ, ড. গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থ মজুমদার, মুহম্মদ জাফর ইকবাল তাঁদের লেখনীর দ্বারা রচিত করে চলেছেন বা করে গেছেন বাংলা বিজ্ঞানচর্চার জয়যাত্রা। আগেও যাঁরা বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা করে গেছেন তাঁদের কাজও ভাস্বর হয়ে আছে ও থাকবে।আজও অগুনতি বাংলায় বিজ্ঞানের সভা ও বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হয় যেখানে অত্যন্ত সহজ ভাষায় বাংলায় বিজ্ঞানের দুরহ বিষয়গুলিকে সহজ, সরলভাবে বোঝানো হয়।

তাই,একজন বিজ্ঞান লেখক হিসেবে নিঃসন্দেহে বলতেই পারি যে, বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা রমরমিয়ে চলছে। উপযুক্ত বিজ্ঞানের বই রচনা করা হচ্ছে, নানান বাংলা বিজ্ঞানের ওয়েবসাইট ও ওয়েবজিন নির্মিত হয়েছে, ফেসবুকে বাংলায় অসংখ্য বিজ্ঞানের পেজ ও গ্রুপ রয়েছে,গোটা বাংলা জুড়েই বিজ্ঞানের নানান পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়ে চলেছে। তাই বলাই যায়, বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার প্রবাহ ছিল, আছে এবং আগামীদিনেও থাকবে। পাঠকরা বাংলায় বিজ্ঞানের লেখা খুব ভালোভাবেই উপভোগ করছে। বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার পরিসর উত্তরোত্তর বৃদ্ধিলাভই করছে। শেষে শুধু বলতে চাই যে, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, প্রাণের ভাষা, আমরা বাঙালি, তাই ইংরেজি মিডিয়াম বা বাংলা মিডিয়াম সহ যে-কোনো মিডিয়ামে পড়লেও মাতৃভাষা বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা সহ সমস্ত বিষয়ের চর্চা করার অঙ্গীকার আমাদের সবারই রয়েছে।



No comments