Header Ads

সাহিত্যে লেখনী ও কোয়ান্টাম তত্ত্ব একসূত্রে আবদ্ধ হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের সাক্ষাৎকারে


আমরা সকলেই জানি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন শুধু সাহিত্যেই পরিপূর্ণ ছিলনা। তিনি ছিলেন যথেষ্ট বিজ্ঞানমনস্ক। রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের প্রথম আলাপের কথোপকথন আজও স্মরণীয় হয়ে রয়েছে গোটা বিশ্বে। একজন সাহিত্যিকের সাথে একজন বিজ্ঞানীর ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ সাহিত্য ও বিজ্ঞানের মেলবন্ধন ঘটিয়েছিল। দুজন মানুষের ভাবনাচিন্তা, মনন ও দর্শনের মধ্যে বিশেষ বৈসাদৃশ্য ছিলনা। ১৯৩০ খ্রীস্টাব্দের ১৪ ই জুলাই আইনস্টাইন তাঁর বার্লিনের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কবিগুরুকে। সেদিন মানব ইতিহাসের গভীর ও কঠিন বিষয়, সত্য, সুন্দর ও চেতনা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল দুজনের মধ্যে। 


১৯৩০ খ্রীস্টাব্দের ১৪ ই সেপ্টেম্বর আইনস্টাইনের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে। ঐদিন সকালে কবিগুরুকে সম্মান জানানোর জন্য জার্মানির সাংস্কৃতিক মন্ত্রী বেকার একটি চা-চক্রের আয়োজন করেছিলেন। আমন্ত্রিত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে আইনস্টাইন ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন জার্মানির কয়েকজন বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক। ঐদিন বিকেলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জার্মানির কাপুথে অবস্থিত আইনস্টাইনের নিজস্ব বাসভবন 'আইনস্টাইন ভিলায়' যান। সেখানে তাঁর যে কথোপকথন হয়েছিল তার অংশবিশেষ ঐ সালের ১০ ই আগস্ট নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় 'আইনস্টাইন অ্যান্ড টেগোর প্লাম্ব দ্য ট্রুথ' শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল। যিনি সেই প্রতিবেদন লিখেছিলেন তিনি ছিলেন প্রখ্যাত জার্মান সাংবাদিক দিমিত্রি মারিয়ানফ।      

ব্রেইন পিকিন্স নামের একজন লেখক 'সায়েন্স অ্যান্ড দ্য ইন্ডিয়ান ট্রেডিশন - হোয়েন আইনস্টাইন মিট টেগোর' নামের একটি বই লিখেছিলেন। যে বইতে একদম নিখুঁত ভাবে রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের সাক্ষাতের অংশ বর্ণনা করা হয়েছে। সেই বইয়ের সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের সাক্ষাতে বলা কথা থেকে কয়েকটি বিষয় পর্যালোচনা করা যাক। আইনস্টাইনকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে আইনস্টাইন গণিত দিয়ে স্থান-কাল ব্যাখ্যা করতে ব্যস্ত থাকেন আর তিনি নিজে জার্মানিতে এসে বক্তব্য রাখছেন চিরন্তন ও বাস্তবতার জগত নিয়ে। আইনস্টাইন রবীন্দ্রনাথকে এই সাক্ষাতে যে প্রশ্নগুলো করেছিলেন যা রবীন্দ্রনাথের সংজ্ঞা বদলে দিয়েছিল। তিনিও যে যথেষ্ট বিজ্ঞাননির্ভর তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। 

দু-চারটে এমন কঠিন প্রশ্নের জবাব রবীন্দ্রনাথকে দিতে হয়েছিল যা থেকে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আমাদের ভাবনা পরিবর্তিত হতে পারে। এই সাক্ষাৎকারের শেষে আইনস্টাইন রবীন্দ্রনাথকে বিজ্ঞানী বলে সম্বোধন করেছিলেন। আইনস্টাইন রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন যে জার্মান ভাষায় প্রজাতি বলতে পুরো মানব জাতিকে বোঝায়। এমনকি বনমানুষ ও ব্যাঙকেও প্রজাতি বলে। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন 'বিজ্ঞানে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে সত্য এমন রূপে পৌঁছে গেছে যা আছে বিশ্ব মানবের মনে।"      
                            
দ্বিতীয় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যেটা হলো আপনি কী মনে করেন স্বর্গ পৃথিবী থেকে আলাদা কোনো বস্তু?  জবাবে রবীন্দ্রনাথ বললেন না, একদমই পৃথক নয়। মানুষের আচার-আচরণেই মহাবিশ্বের প্রকৃত রূপ ধরা পড়ে। এমন কিছু নেই যা মানুষ দিয়ে বোঝা যায়না। এ থেকে বোঝা যায় মানব সত্য মহাবিশ্বের সত্য এক। আমি এই ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করবার জন্য বিজ্ঞানের একটা নির্দিষ্ট দিক উদাহরণ হিসাবে নিয়েছি। বস্তু ইলেকট্রন-প্রোটন নিয়ে গঠিত। যদিও আপাতদৃষ্টিতে বস্তুকে কঠিন মনে হয়, এর ভেতরটা ফাঁকা। একইভাবে মানবতা এমন অনেক স্বতন্ত্র মানুষ নিয়ে গঠিত। কিন্তু তাদের মাঝে এক ধরণের ভেতরকার যোগসূত্র আছে, যা এই পৃথিবীকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলে। আমি কলা, সাহিত্য আর মানুষের ধর্মীয় বোধ নিয়ে চিন্তা করে এই ভাবনাটি পেয়েছি। 

সর্বশেষ যে প্রশ্নটা না বললেই নয়, তা হলো আমাদের অভিজ্ঞতা ও মনের বাইরের বাস্তবতা বলতে ঠিক কী বোঝায়? আইনস্টাইনের এই প্রশ্নের উত্তরটি এতোটাই যথাযথ ছিল যে রবীন্দ্রনাথকে বিজ্ঞানীও সহজে বলা যাবে। রবীন্দ্রনাথ বললেন বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে টেবিল যে একটি কঠিন বস্তু তা হলো একটি দৃশ্যমান অনুভূতি। তাই মানুষের মন বলে কিছুই না থাকলে টেবিলের বাস্তবতা বলে কিছু থাকতো না। এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের বস্তু জগত অসংখ্য বিচ্ছিন্ন ঘূর্ণায়মান তড়িৎ শক্তির কেন্দ্রের দ্বারা তৈরি। যদি এমন কোনো মন থেকে থাকে যার কাছে ঘটনাগুলো স্থানে ঘটে না, বরং সময়ে ঘটে অনেকটা সুরের নোটের মতো, এ ধরণের মনের কাছে পিথাগোরাসের জ্যামিতির কোনো মানে নেই। কাগজ ও সাহিত্যের বাস্তবতা সম্পূর্ণ পৃথক। মথের যে মন আছে, তা অনুযায়ী সে যখন কাগজ খায়, তার কাছে তখন সাহিত্যের কোনো মানে নেই। কিন্তু মানুষের কাছে কাগজের চেয়ে সাহিত্যের মূল্য অনেক বেশি। তাই এমন কোনো সত্য যদি থাকে যা মানুষের অনুভূতি ও যুক্তির বাইরে, তাহলে সে সত্যের কোনো মানে থাকবে না যতক্ষণ আমরা মানুষ থাকবো।'     

দর্শন ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনায় রবীন্দ্রনাথ বহু যুগের থেকে এগিয়ে। নোবেলবিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী এবং নোবেলবিজয়ী সাহিত্যিকের সেই অদ্ভূত কথোপকথনে মহাবিশ্বের কঠোর সত্যের উদ্ভাবন হয়েছিল। সাহিত্যের লেখনী ও কোয়ান্টাম তত্ত্ব একসূত্রে যেন আবদ্ধ হয়েছিল এই দুই ব্যক্তির সাক্ষাৎকারে।


No comments