Header Ads

চিত্রশিল্পের এক স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান তিনি, যার ভাবনার আকাশে ভেসে উঠতো রঙের প্রতিচ্ছবি


"আমরা গরীব দেশের মানুষ, এত পয়সা খরচ করে ওদের দেশে যাব কেন? ওদের অনেক পয়সা, ওরা এসে আমাদেরটা দেখে যাক।" এমনই একটি উন্নতমানের চিন্তাধারার অধিকারী ছিলেন তিনি। বিদেশি ভাবধারাতে চিত্র অঙ্কন শুরু করলেও তিনি ধীরে ধীরে গ্রাম্য সমাজের চিত্র অঙ্কনে মনোনিবেশ করেন। বাঙালি সংস্কৃতি-কৃষ্টি ও ঐতিহ্য নিয়ে তিনি গর্ববোধ করতেন। চিত্রশিল্পে অবদানের জন্য তিনি বহুবার বিদেশ থেকে আমন্ত্রণ পেয়েছেন তবুও কখনো বিদেশ যাননি। এমনই ছিলেন তিনি। পটচিত্রকার বললে প্রথমেই ভেসে ওঠে তাঁর নাম। তিনি হলেন চিত্রশিল্পী যামিনী রায়। বলা চলে তিনি একজন চিত্রশিল্পে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান।


চিত্রশিল্পী যামিনী রায় তাঁর চিত্রচর্চা শুরু করেন ব্রিটিশ অ্যাকাডেমিক স্বাভাবিকতাবাদী রীতি অনুসরণ করে। ফরাসি ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের মতো চিত্রচর্চা করেন কিছুদিন। তারপর লোকশিল্পের অনন্যতায় তিনি পটচিত্রে আকৃষ্ট হন এবং এ বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি মেদিনীপুর, বেলিয়াতোড়, কালীঘাট প্রভৃতি অঞ্চল থেকে পটসংগ্রহ শুরু করেন। তিনি দীর্ঘ অনুশীলন করে চিত্রভাষা অর্জন করে সমতল রং ব্যবহার করে চিত্রিত করেন মানুষজন, পশুপাখির পূর্ণ অবস্থান। স্বচ্ছন্দ লীলায়িত হয়ে ওঠে তাদের শরীরের বহিরেখা। সমতল পটভূমিকায় সেজে ওঠে তাঁর ছোট-বড় অলংকরণ। তাঁর ছবি আঁকার বিষয় ছিল রামায়ণ, মহাভারত, যিশুখ্রিস্ট, গ্রাম্য সমাজ, আদিবাসী ও শহুরে মানুষের সমাজ চিত্র। তিনি বাংলার জনপ্রিয় লোকচিত্র কালীঘাট পটচিত্র শিল্পকে বিশ্বনন্দিত করে তোলেন।  

১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের ১১ ই এপ্রিল বাঁকুড়া জেলার আদিবাসী অধ্যুষিত বেলিয়াতোড় গ্রামের এক মধ্যবিত্ত জমিদার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই চিত্রশিল্পের প্রতি ছিল তাঁর গভীর টান। গ্রাম্যজীবনের স্বাদ ও আদিবাসীদের জীবনযাত্রার ছবি জীবনের প্রথম দিন থেকেই আস্বাদন করেছেন বলেই তাঁর প্রতিভাবান তুলির টানে তিনি সৃষ্টি করতে পেরেছেন অসংখ্য বৈচিত্র্যময় পটচিত্র। শৈশব থেকেই নিজের মনে বাড়ির দেওয়াল ও উঠোন জুড়ে এমনকি বাড়িতে পড়ে থাকা ভগ্ন আসবাবপত্র কিংবা বাড়ির টেবিলে পড়ে থাকা কাগজের ওপর নিজের খেয়ালে মানুষ, পুতুল, বাড়িঘর ও গাছপালার ছবি আঁকতেন। কখনো গ্রামে প্রতিমা গড়ার কাজ হলে তা তিনি একমনে উপলব্ধি করে আসতেন। একজন মৃৎশিল্পী কীভাবে নিজের কাঁচাহাতে একটি প্রতিমাতে খড়ের কাঠামো বানিয়ে তার ওপর এঁটেল মাটি লাগাচ্ছে। সেই মাটি শুকিয়ে যাওয়ার পর তার ওপর কীভাবে পলিমাটি লাগানো হয়। তারপর কীভাবে প্রতিমার ওপর রং করা হয় ও সবশেষে কীভাবে অলংকরণ করা হয়, এগুলো সব তিনি লক্ষ্য করতেন। এক আধবার তাঁকে মৃৎশিল্পীদের সাথে গ্রামে কাজ করতেও দেখা গেছে। তিনি কখনো নিজের প্রতিভাকে দমিয়ে রাখতেন না। মাত্র ষোলো বছর বয়সে তিনি কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে ভর্তি হন৷ এই স্কুল থেকেই তিনি ফাইন আর্টে ডিপ্লোমা করেন। 

উনিশ শতকের ইউরোপীয় চিত্রের অনুকরণে প্রাকৃতিক দৃশ্য, শহরের ইতিবৃত্ত, অলিগলির গল্প, বাড়ির দৃশ্য, আকাশের সৌন্দর্য ও নদীর বুকে নৌকার বিচরণ প্রতিটি  অঙ্কনশৈলীই ছিল পাশ্চাত্য ক্রিয়াভাবের মতো। তিনি ১৯২১ থেকে ১৯২৪ এর মধ্যবর্তী সময়ে নতুন এক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বেছে নেন আদিবাসী নৃত্যকে৷ তাঁর আঁকার পদ্ধতি ছিল বেঙ্গল স্কুল ও প্রচলিত পাশ্চাত্য ধারার বিরুদ্ধে এক নতুন প্রতিক্রিয়া। 

কবি বুদ্ধদেব বসু যামিনী রায়ের সম্বন্ধে কবিতায় লিখেছেন "আমরা সবাই প্রতিভারে করি পণ্য/ ভাবালু আত্মকরুণায় আছি মগ্ন/ আমাদের পাপের নিজের জীবনে জীর্ণ/ করলে, যামিনী রায়/ পুঁথি ফেলে তুমি তাকালে আপন গোপন মর্মতলে/ ফিরে গেলে তুমি মাটিতে, আকাশে, জলে।/ স্বপ্ন লালসে অলস আমরা তোমার পুণ্যবলে/ ধন্য যামিনী রায়।" 

চিত্রশিল্পী যামিনী রায় স্বতন্ত্র শিল্পরীতি অনুসরণ করে চলাচল করতেন৷ তিনি মানুষকে সহজ উপায়ে একটি চিত্রের অর্থ বোঝানোর জন্য ফুল-লতার রস, খড়িমাটি ও ভূষোকালি থেকে প্রাকৃতিক উপায়ে রং ব্যবহার করতেন৷ প্রকৃতি আমাদের মহান শিক্ষক এ কথাটা তিনি স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতেন পটশিল্পে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে রঙের আশ্চর্য ব্যবহারে। ১৯৫৫ সালে তাঁকে চিত্রশিল্পে অনস্বীকার্য অবদানের জন্য 'পদ্মভূষণ' উপাধিতে ভূষিত করা হয় ভারত সরকার থেকে।  

বাংলার আধুনিক চিত্রকলার ইতিহাসে তাঁর অবদান আজীবন অমর হয়ে থাকবে। তিনি সর্বদা চাইতেন দেশ-বিদেশের মানুষ বাংলার ঐতিহ্য ও কৃষ্টিকে সর্বাধিক পরিমাণে গ্রহণ করুক। তিনি এ কাজে বিশেষ ভাবে সফল হয়েছেন। পট চিত্রশিল্পের মাধ্যমে তিনি বাঙালি জাতিসত্বাকে বিশ্বসভায় তুলে ধরেছিলেন। 


ঋণ- রোর বাংলা, খবর অনলাইন, দৈনিক আজাদী

No comments