বেঙ্গল কেমিক্যাল এণ্ড ফার্মাসিউটিক্যালস ওয়ার্কস লিমিটেড ইতিবৃত্ত || প্রথম পর্ব
আগামী ১২ই এপ্রিল বাংলার তথা ভারতের গর্ব, কিংবদন্তি বাঙালি রসায়নবিদ ও শিল্পপতি আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠিত ‘বেঙ্গল কেমিক্যালস এণ্ড ফার্মাসিউটিক্যালস ওয়ার্কস লিমিটেড’ নামক শিল্প-সংস্থাটি ১২০তম বর্ষে পদার্পন করবে। সেই উপলক্ষে এই প্রবন্ধটি রচনা করা হল। ভারতী পত্রিকায় শ্রাবণ, ১৩৩৩(ইংরেজি ১৯২৬) সংখ্যায় প্রকাশিত আচার্যদেবের “বেঙ্গল কেমিক্যালস” লেখাটির প্রতিফলন অনেকটাই ঘটেছে এই প্রবন্ধটিতে। মজার কথা হল যে, বর্তমান সময় যখন উক্ত প্রতিষ্ঠানটির বেশ কিছু দুর্দশার কথা বেশিরভাগ শোনা যায় তখন আচার্যদেবের আধুনিক ধ্যান-ধারণার সাথে অসীম দূরদর্শিতা ও পারদর্শিতার সাথে পরিচয়লাভ করতে পারলে বিস্মিত হয়ে যেতে হবে। পাঠকগণ আসুন আমরা জেনে নিই, বেঙ্গল কেমিক্যালস এণ্ড ফার্মাসিউটিক্যালস ওয়ার্কস লিমিটেড নামক সুপ্রসিদ্ধ রাসায়নিক শিল্প-প্রতিষ্ঠানটি আচার্যদেবের আমলে কেমন ছিল সে সম্পর্কে কিছু কথা।
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ১৮৯২ সালে কলকাতার ৯১ আপার সার্কুলার রোডে মাত্র ৭০০ টাকা মূলধন নিয়ে ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল ওয়ার্কস’ স্থাপন করেছিলেন। শুরুতেই বলে রাখা ভালো যে, আচার্যদেব এই রাসায়নিক শিল্প-প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাঙালি জাতিকে স্বাবলম্বন করার উদ্দেশ্যে। বাঙালি কেবল চাকরি করবে, ব্যবসা করবে না- এই ব্যাপারটিতে আচার্যদেব বেশ ব্যথিত হয়েছিলেন। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, আচার্যদেব বুঝেছিলেন যে পরাধীন জাতিকে শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ও স্বদেশী দ্রব্য উৎপাদনের মারফতেই স্বাবলম্বী করানো যাবে। আচার্যদেব সর্বদা চাইতেন বাঙালি তরুণদের মধ্যে উদ্যোগী মনোভাবকে জাগাতে। তিনি তাঁর অসাধারণ রসায়নবিদ্যা পড়ানোর মাধ্যমে বিদ্যার্থীদের মধ্যে উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও দেশভক্তি জাগিয়ে তুলতেন। ব্যবসা করার ক্ষেত্রে তিনি বলতেন, “অন্ন সমস্যার সমাধান করতে পারলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তাই ব্যবসা বাণিজ্য ছাড়া আমার কিছু বলার নেই।”
শ্রমকে তিনি ভীষণই প্রাধান্য দিতেন ও শ্রমজীবী মানুষদের খুবই ভালোবাসতেন আর সেই প্রসঙ্গেই তিনি বলেছিলেন, “যারা শ্রম করে, দেশের লোক ছোটলোক বলে তাদের। এটি অসত্য ও নিন্দনীয়। যারা কুলিগিরি করবে বলে, আমি তাদের বাহবা দিই ধন্যবাদ জানাই। বাঙালি শ্রমবিমুখ ও চাকুরিপ্রিয় এই ব্যাপারটিতে আচার্যদেব খুবই ব্যথিত ছিলেন। অলস, অন্যের কাঁধে ভর করে জীবন-যাপন করবে এই ব্যাপারটিকে তিনি একেবারেই অপছন্দ করতেন আর তাই তিনি বলতেন, “বসে বসে খাব, বা কারও কাঁধে ভর করে খাব— এ বড় জঘন্য কথা। যে অলস সে পরজীবী। তার বেঁচে থাকার অর্থ হয় না।” তাই তিনি নিজে অধ্যাপনার পাশাপাশি এই কারখানাটিও প্রতিষ্ঠা করেন। এই রাসায়নিক কারখানাটি রসায়নবিদ্যার শিক্ষার্থীদের কাছে এক তীর্থস্থান হয়ে গিয়েছিল। তারা বেঙ্গল কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠানের ল্যাবরেটরি ব্যবহার করত প্রাকটিক্যাল কাজের জন্যে। সেখানে তারা নানান রাসায়নিক সামগ্রী তৈরি করত। আচার্যদেব তাদের কাজ খুব খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতেন এবং তাদের কাজের দক্ষতা অনুযায়ী তিনি তাদের বেঙ্গল কেমিক্যাল ওয়ার্কস-এর কাজে নিযুক্ত করতেন। এই যেমনটা করেছিলেন বিখ্যাত রসায়নবিদ সতীশচন্দ্র দাশগুপ্তের ক্ষেত্রে।
সতীশচন্দ্র দাশগুপ্তকে তিনি সদ্য প্রতিষ্ঠিত এই কারখানার ম্যানেজারের আসনে নিয়োজিত করেছিলেন। পরবর্তীকালে সতীশচন্দ্রের নানান আবিষ্কার ও রসায়নে অবদানের জন্যে আমরা বলতেই পারি যে ‘জহুরী জহর চিনেছিলেন’। আর সদ্য প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিক্যালসের সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন আর এক রসায়নবিদ ও কিংবদন্তি সাহিত্যিক রাজশেখর বসু, যাঁকে আমরা ‘পরশুরাম’ হিসেবে চিনি। তাই, আচার্যদেবের দূরদর্শিতা ও খাঁটি মানুষ চেনার পারদর্শিতার প্রশংসা করতেই হয় কেননা এই দুই উল্লেখিত রসায়নবিদের নিরলস পরিশ্রমের ফলে এই স্বদেশী প্রতিষ্ঠানটি এক অগ্রগণ্য রাসায়নিক কারখানায় পরিণত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই এই কোম্পানিটি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। ওই সময়, আচার্যদেব কোম্পানির আরও উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ২ লক্ষ টাকা অতিরিক্ত মূলধন কোম্পানির কাছে যুক্ত করেন এবং সংস্থাটি একটি লিমিটেড কোম্পানি রূপে প্রতিষ্ঠালাভ করে। যার ফলে, ১৯০১ সালের ১২ই এপ্রিল কোম্পানিটির নতুন নামকরণ হয় ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল এণ্ড ফার্মাসিউটিক্যালস ওয়ার্কস লিমিটেড’। নাম পাল্টালেও ঠিকানা অপরিবর্তিত থেকেই যায়। মনে রাখতে হবে যে, এই কোম্পানি হল ভারত উপমহাদেশের প্রথম ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি।
Post a Comment