অ্যামাজন, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়ার জঙ্গলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর এবার শুশুনিয়াতে অগ্নিকাণ্ড
বাঁকুড়া জেলার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পাহাড় হলো শুশুনিয়া। যার উচ্চতা ১৪৭০ ফুট। সারা বছর রাজ্য ও রাজ্যের বাইরের বহু মানুষ এখানে আসেন ভ্রমণের জন্য। শীতের সময় বহু মানুষ এখানে পিকনিক করতে আসেন। শুশুনিয়া পাহাড়ের অপার সৌন্দর্য যে-কোনো মানুষকে মুগ্ধ করতে পারে। এই পাহাড় তার নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য বিখ্যাত। বাঁকুড়ার ছাতনা শহরের দশ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে বাঁকুড়া-পুরুলিয়া রোডের ধারে অবস্থিত শুশুনিয়া।
শুশুনিয়া পাহাড়ে চড়ার একটা আলাদা মজা রয়েছে। যারা সাধারণত ব্যস্ত মানুষ তাদের ক্ষেত্রে একদিনের ছোট্ট ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত স্থান হলো শুশুনিয়া। এখানকার পাথর খোদাই শিল্প বেশ উন্নত। পাহাড়ের নীচে রয়েছে বিভিন্ন ছোটো ছোটো দোকান যেখানে পাথরের তৈরি নানা আসবাবপত্র পাওয়া যায়। একদম অল্প দামে বিক্রি হয় পাথরের আসবাবপত্রগুলি। শুশুনিয়া পাহাড় হলো একটি পরিচিত পুরাতাত্ত্বিক ও জীবাশ্ম ক্ষেত্র। এখানে সিংহ, হায়না, জিরাফ ও অন্যান্য জীবজন্তুর জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের আদিতম শিলালিপিটি রয়েছে এই পাহাড়েই। এখানে ঝর্ণার মুখে একটি প্রাচীন পাথরের নরসিংহ মূর্তি দেখা যায়। প্রাচীনকালে রাজতান্ত্রিক যুগে রাজা চন্দ্রবর্মণ এখানে একটি দূর্গ নির্মাণ করেছিলেন। শুশুনিয়া থেকে প্রাপ্ত খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর শিলালিপি থেকে জানা যায় চন্দ্রবর্মণের রাজধানী ছিল পুষ্করণা শহর, যেটি বর্তমানে পোখরনা নামে পরিচিত।
এই শুশুনিয়া পাহাড় গত মঙ্গলবার রাতে জ্বলে উঠলো দাউদাউ করে আগুনে। সম্ভবত দাবানলের ফলেই ঘটেছে এ অগ্নিকাণ্ড। তবে অনেকেই মনে করছেন এটা মনুষ্য সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডও হতে পারে। যে অভিযোগ একদমই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না৷ কারণ এর আগে সারা পৃথিবী জুড়ে যে অগ্নিকাণ্ডগুলো হয়েছে তাতে অনেকেই আঙুল তুলেছেন মানুষের ওপরই। পৃথিবীর ফুসফুস ব্রাজিলের অ্যামাজন রেন ফরেস্টে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা, পৃথিবীর দ্বিতীয় ফুসফুস আফ্রিকার কঙ্গো বেসিনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, অস্ট্রেলিয়ার বিস্তীর্ন অরণ্যাঞ্চলে ঘটা ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড কিংবা সুন্দরবনে গত চৌদ্দ বছরে চব্বিশটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা থেকে এটাই স্পষ্ট যে প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডই মনুষ্য সৃষ্ট। যদিও সঠিক প্রমাণ এখনও মেলেনি। তবে প্রশ্ন হলো এক বছরে এতোগুলো বড় বড় অরণ্য কীভাবে জ্বলে উঠলো? প্রকৃতি কখনো এতোটাই নিষ্ঠুর নয় যে এক বছরে দাবানালে পুড়িয়ে ফেলবে পৃথিবীর সব গুরুত্বপূর্ণ অরণ্যগুলিকে।
ব্রাজিলের কথায় যদি বলা হয় সেখানকার সরকার বহুদিন ধরে চেষ্টা চালাচ্ছে অ্যামাজনের বুকে অনেকগুলো জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও শহর গড়ে তোলার। গত কয়েক বছর ধরে অ্যামাজন রেন ফরেস্টের উপজাতিদের জীবন নিয়ে নির্মিত বিভিন্ন ডকুমেন্টরিতে চোখ রাখলে দেখা যায় ব্রাজিলের সরকার উপজাতিদের ধ্বংসের এক বিশাল চক্রান্ত চালাচ্ছে। অ্যামাজন রেন ফরেস্টের বেশ কিছু অংশ ধ্বংস করে ও উপজাতিদের উচ্ছেদ করে শিল্প গড়তে চাইছে ব্রাজিল সরকার। এ ঘটনাগুলো থেকে সহজেই আন্দাজ করা যায় যে অ্যামাজনে অগ্নিকাণ্ডের পিছনে হাত থাকতে পারে ব্রাজিল সরকারের। এবার আসি কঙ্গো বেসিনের অগ্নিকাণ্ডের কথায়। ভারতের ব্যাঙ্গালোরে ভারত, নেপাল, মরিশাস, আফ্রিকা, নাইজিরিয়া ও বাংলাদেশের ছেলেদের মধ্যে বিভিন্ন দেশ নিয়ে একটা ছোট্ট চায়ের আড্ডা চলছিল এক কলেজের ক্যান্টিনে গত ডিসেম্বরে। যে আড্ডাতে আমিও উপস্থিত ছিলাম। আমার দুই আফ্রিকান বন্ধু নিসেরিয়া আসিডু ওবেং ও ইউসুফ মহম্মদের সাথে কথা বলে জানতে পারি যে আফ্রিকার সরকারের দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গল কেটে শিল্প গড়ে তোলার বৃহৎ চেষ্টা রয়েছে। আর এ জঙ্গলে আগুন লাগার সবচেয়ে বড়ো কারণ হলো ভ্রান্ত কৃষি পদ্ধতি।
সুন্দরবন অঞ্চলে বারবার আগুন লাগানোর পিছনে মাছশিকারী চক্রকে দায়ী করেছে বাংলাদেশ সরকার। যারা অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়েছিল তাদের বাংলাদেশ বনপুলিশ গ্রেপ্তার করে বহুদিন আগে। এবার আসা যাক অস্ট্রেলিয়ার কথায় এখানের ব্যাপারটা যদিও আলাদা। নাসার বিজ্ঞানীদের মতে এখানে অতিরিক্ত ইউক্যালিপটাস গাছ থাকার জন্য এ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এই গাছে এক ধরণের তেল থাকে যা আগুনকে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে সাহায্য করে। এই গাছ থেকে অরণ্যে প্রবল দাবানল সৃষ্টির সম্ভাবনা থেকেই থাকে। সময়ের সাথে সাথে এইসব গাছপালা শুষ্ক ও খরা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। এসব জায়গাতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়মিত। আর এবার পশ্চিমবঙ্গের শুশুনিয়া পাহাড়ে দাবানলের ঘটনা নতুন করে প্রশ্ন তুলতে পারে মানুষের দিকে। তবে জঙ্গলমহলে বসন্তকালে শালগাছের পাতা ঝরে যায়। যার ফলে জঙ্গলের পাদদেশে প্রচুর পাতা জমে যায়। সেই পাতার কারণে মানুষের অনিচ্ছাকৃত কারণেও অনেক সময় জঙ্গলে আগুন লেগে থাকে। এমন ঘটনা জঙ্গলমহলে বহুবার ঘটেছে। যা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায়না।
এখন অবধি পাওয়া খবর অনুযায়ী, গত মঙ্গলবার দুপুরের দিক পাহাড়ে ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। বিকেলের দিকে নাকি জঙ্গলের শুকনো পাতায় ঘষা লেগে পাহাড়ে আগুন লাগে। দমকলের নিয়ন্ত্রণে আনা হয় সেই আগুন। সন্ধ্যে ছটার পর বাতাসে উড়ে বেড়ানো ছাই থেকে আবারো জ্বলে ওঠে পুরো পাহাড়। প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত জ্বলেছে আগুন। শুশুনিয়া পাহাড়ের অগ্নিকাণ্ড ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। গ্রামবাসীদের আশঙ্কা পাহাড়ে জ্বলে ওঠা আগুনের ফুলকি বাতাসের মাধ্যমে উপচে পড়তে পারে গ্রামের মানুষদের ঘরবাড়ির ওপরে। জ্বলন্ত অগ্নিকাণ্ডে শুশুনিয়া পাহাড় যেন হয়ে ওঠে জ্বলন্ত জ্বালামুখ। শুশুনিয়া পাহাড়ের অগ্নিকাণ্ড দেখতে ভিড় জমিয়েছিল সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা৷ পাহাড় থেকে বন্য জীবজন্তু যেমন শেয়াল, বুনো শুয়োর, বন্য খরগোশ ও হায়েনার উচ্চস্বরে চিৎকার শোনা গেছে। স্থানীয়দের মতে প্রচুর পশুপাখির মারা যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। শুশুনিয়া পাহাড়ে অগ্নিকাণ্ডের পিছনের সঠিক কারণ এখনও জানা যায়নি। তবে আশা করাই যায় কিছুদিনের মধ্যেই জানা যাবে অগ্নিকাণ্ডের আসল রহস্য।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment