Header Ads

অন্য আরেক রবির ব্রতকথা


"যে সঙ্গীত আমি শিখেছি এবং নিজে করছি, এটা প্রভুকে উপাসনা করার মতো। আমার কাছে একটা বাদ্যযন্ত্র দেবতার মতো সম্মান পায়। আমি আমার রচনা করা সঙ্গীতকে আধ্যাত্মিক গুণ দেয়ার চেষ্টা করি, যাতে করে আপনি বুঝে ওঠার আগেই যাতে সঙ্গীত আপনার আত্মার সাথে গভীর আত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এটাই সঙ্গীতের মূল দায়িত্ব।" এমনই যত্নবান সংগীতজ্ঞ ছিলেন তিনি। যার সঙ্গীতের সাথে ছিল নাড়ির যোগাযোগ। কেবল সঙ্গীতই নয়, সেতারেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। সঙ্গীতের সাথে যুক্ত এমন কোনো মানুষ নেই যারা তাঁর নাম শোনেননি। তিনি হলেন প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী পন্ডিত রবিশঙ্কর। 


গত ৭ ই এপ্রিল নিঃশব্দে পেরিয়ে গেল তাঁর জন্মশতবার্ষিকী৷ তাঁকে নিয়ে দেখা গেলোনা কোনো উন্মাদনা। অথচ এই মানুষটিই একদিন ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে গানের মাধ্যমে বিশ্বসভায় তুলে ধরেন। আজকের এই নিবন্ধে আমরা তুলে ধরবো তাঁর জীবনের নানান গল্প। 

১৯২০ খ্রীস্টাব্দের ৭ ই এপ্রিল ব্রিটিশ ভারতের উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে জন্মগ্রহণ করেন পন্ডিত রবিশঙ্কর। তাঁদের আদি পৈত্রিক নিবাস ছিল বাংলাদেশের নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলাতে। পিতা শ্যাম শঙ্কর চৌধুরী ও মাতা হেমাঙ্গিনী দেবীর কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন তিনি। শ্যাম শঙ্কর চৌধুরী ছিলেন একজন প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী, আইনজ্ঞ ও রাজনীতিবিদ। তাঁর বড়ভাই উদয়শঙ্কর ছিলেন একজন প্রখ্যাত শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পী। তিনি বসবাস করতেন প্যারিসে। রবিশঙ্কর মাতা হেমাঙ্গিনী দেবীর সাথে ১৯৩০ খ্রীস্টাব্দে প্যারিসে উদয় শঙ্করের কাছে যান। সেখানেই আট বছর স্কুলে পড়াশুনো করেছিলেন তিনি৷  

১৯৩৪ খ্রীস্টাব্দের ডিসেম্বরে কলকাতার মাইহার রাজদরবারে প্রধান সঙ্গীত শিল্পী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের গান শুনে তাঁর দাদা উদয় শঙ্কর মুগ্ধ হন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন ভাই রবি শঙ্করকে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের কাছে মাইহারে পাঠাবেন। প্রাথমিকভাবে রবিশঙ্করকে ইউরোপ সফরের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা দেন। আলাউদ্দিন খান রবি শঙ্করকে সেতার শেখানোর জন্য বিশেষ শর্ত দেন। যে শর্তে বলা হয় পুরো শিক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে এই শিক্ষায় একনিষ্ঠ হতে হবে৷ যে শর্তের ভিত্তিতে রবিশঙ্কর দাদার নাট্যদল ত্যাগ করে পাড়ি দিলেন মাইহারে। 

মাত্র আঠারো বছর বয়সে রবিশঙ্করের পরিচয় ঘটে সেতারের সাথে কলকাতার এক উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের কনসার্টে। যেখানে উপস্থিত ছিলেন সে সময়ের অন্যতম সেতার বাদক অমিয় কান্তি ভট্টাচার্য। যার সেতার শুনে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি ঠিক করেন এনার গুরুর কাছে সেতার শিখতে হবে। এরপর অমিয় কান্তি ভট্টাচার্যের গুরু এনায়েত খানের কাছে সেতারে তাঁর হাতেখড়ি হয়। যদিও এনায়েত খানের কাছে কিছুদিন শেখার পর তিনি আবারও আলাউদ্দিন খাঁর কাছেই ফিরে আসেন। তিনি তাঁর গুরু আলাউদ্দিন খাঁকে শ্রদ্ধা করে 'বাবা' বলে সম্বোধন করতেন। আলাউদ্দিন খাঁর কাছে দীক্ষা গ্রহণকালে তিনি আচার্যের পুত্র সরোদের অমর শিল্পী ওস্তাদ আলী আকবর খানের সংস্পর্শে আসেন। গুরুগৃহে দীর্ঘ সাত বছর সেতারে সঙ্গীত শিক্ষা গ্রহণ করেন। আচার্য আলাউদ্দিন খাঁর শিক্ষার আলোতে কয়েক বছরের মধ্যেই রবিশঙ্কর হয়ে উঠলেন দূর্দান্ত সেতার বাদক। ধীরে ধীরে ক্রমশ দেশ-বিদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে তাঁর খ্যাতি।  

১৯৩৯ খ্রীস্টাব্দে তিনি সর্বপ্রথম সাধারণের জন্য উন্মুক্ত একক সেতার অনুষ্ঠানে সেতার পরিবেশনের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একজন মেধাবী দূত হিসেবে। তিনি যে কেবল শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়েই যে শুধু কাজ করেছেন এমনটাও কিন্তু নয়। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বাইরে বেরিয়েও সঙ্গীত চর্চা করেছেন৷ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি তিনি ব্যালের জন্য সঙ্গীত রচনা ও সুর আবিষ্কার করেন। সেই সময়ের দুটো হিন্দি ছবি ধরতী কি লাল ও নীচা নগরের জন্য গান রচনা করেছিলেন। তিনি জনপ্রিয় উর্দু গান সারে জাঁহাসে আচ্ছাতে সুর দিয়েছিলেন। এরপর ১৯৪৯ খ্রীস্টাব্দে তিনি দিল্লিতে অল ইন্ডিয়া রেডিওর সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে যোগ দেন৷ ১৯৫০ থেকে ১৯৫৫ এই পাঁচটি বছর হয়ে ওঠে তাঁর জনপ্রিয়তার মাইলস্টোন। বিশ্ব বিখ্যাত চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের অপু ট্রিলোজি মানে পথের পাঁচালী, অপরাজিত ও অপুর সংসার ছবিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করেন।  পরবর্তীকালে ১৯৬৬ খ্রীস্টাব্দে  চাপাকোয়া, ১৯৬৮ খ্রীস্টাব্দে চার্লি এবং ১৯৮২ খ্রীস্টাব্দে তিনি গান্ধী ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন৷ 

সঙ্গীতের পাশাপাশি সামাজিক কাজও তিনি করেছেন। ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধে  বাংলাদেশের মানুষের যুদ্ধোত্তর অবস্থায় কষ্ট ও জীবনযাপন তাঁকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি জর্জ হ্যারিসনকে বলেন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কিছু করতে হবে। তাই জর্জ হ্যারিসনের উদ্যোগে নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে আয়োজিত 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' নামের একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়৷ দেশের সহায়তায় বৃহৎ পরিসরে দাতব্য কনসার্ট ছিল এটি৷ এই কনসার্টে একই মঞ্চে রবিশঙ্করের সাথে সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন জর্জ হ্যারিসন ও বব ডিলান। 

পাশ্চাত্য সঙ্গীতের বিখ্যাত বেহালাবাদক ইহুদি মেনুহিন রবিশঙ্করের প্রসঙ্গে বলেন "রবিশঙ্কর আমার জন্য সঙ্গীতের এক অনন্য অমূল্য উপহার নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর মাধ্যমেই আমি আমার সঙ্গীত অভিজ্ঞতায় নতুন মাত্রা যুক্ত করতে পেরেছি৷ আমার কাছে তাঁর সঙ্গীত প্রজ্ঞা এবং মানবিকতাকে একমাত্র মোজার্টের সাথে তুলনীয় মনে হয়।"

সঙ্গীতে বিশ্বমুখী অবদানের জন্য তিনি অর্জন করেছেন ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত পদ্মবিভূষণ, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত দেশিকোত্তম, চৌদ্দটি সম্মানসূচক ডক্টরেট, ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ভারতরত্ন, সুইডেন কর্তৃক প্রদত্ত পোলার মিউজিক প্রাইজ, রাণী এলিজাবেথ কর্তৃক প্রদত্ত নাইটহুড, পাঁচটি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডস, ভারতের সর্বোচ্চ সুশীল সমাজ পুরস্কার  পদ্মভূষণ, ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান লিজিয়ন অব অনার, ফিলিপাইন ও ম্যালিনা কর্তৃক প্রদত্ত ম্যাগাসাসে অ্যাওয়ার্ড, ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামের গ্লোবাল এম্বাসেডর উপাধি ও আরো অসংখ্য দেশি-বিদেশি পুরস্কার। একজন গর্বিত বাঙালি হিসেবে তিনি সারা বিশ্বের কাছে বাংলার নাম বৃদ্ধি করেছে। তিনি বাংলা ও বাঙালির গর্ব।

ঋণ- উইকিপিডিয়া, অনুশীলন, রোর বাংলা

No comments