Header Ads

ভ্রমণ ও ভক্তি কথায় কামারপুকুর || প্রথম পর্ব


জীবনের ষাটটা বছর পার করে দিলাম। ধর্ম-কর্ম কিছুই বুঝি করা হল না। আমার স্ত্রীর তাই আমার উপর খুব রাগ, বলেন, তুমি একটা আস্ত নাস্তিক ! 

আমি মিটিমিটি হাসি। তাতে স্ত্রী আমার ওপর আরও রেগে যান। বলেন ও তোমার কেমন হাসি ? তুমি দেখছি আস্ত একটা ভিলেন ! 

না আর হাসা যাবে না। এই হয়েছে আমার মুশকিল। প্রতিবাদ করলে বাকবিতণ্ডার উৎপত্তি হবে আবার চুপ করে ঘাড় নিচু করে থাকলে স্ত্রীর কথা সম্পূর্ণ মেনে নেওয়া হবে। তাই আমি মধ্যপন্থা অবলম্বন করি, মিটিমিটি মিচকি মিচকি হাসতে থাকি।  


এরই মধ্যে স্ত্রী প্রস্তাব করে বসলেন, কামারপুকুর ! 

আমি আকাশ থেকে পড়ার ভান করলাম, পুকুরের নাম কামার ? সেটা আবার কোথায় ? 

স্ত্রী এবার ঝাঁজ ও ভাব মিশ্রিত গলায় বলে উঠলেন--নাস্তিক, কিছু মনে থাকে না। আরে কামারপুকুর রামকৃষ্ণ দেবের জন্মস্থান, সেটাও তুমি ভুলে গেলে ?  

জায়গাটা অপরিচিত নয়, স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললাম, ও মনে পড়েছে। আসলে মনে ভক্তি না থাকলে এমনটাই হয়। স্ত্রী আমার মাত্রা ছাড়া ভক্তিমতী। তিনি বললেন, চলনা গো একটু কামারপুকুর ঘুরে আসি। ভদ্রমহিলা এবার যেন গলে যাচ্ছেন, একটু আগের সেই গরম মুখি স্ত্রী কি ভাবে যে নিমেষে পাল্টে গলনমুখী হয়ে গেলেন, তা এই চল্লিশ বছরের বিবাহিত জীবনেও বোধগম্য হল না ! যাক এ সব অবান্তর কথা। যেতে হবে কামারপুকুর। আবার তল্পিতল্পা নিয়ে গাড়িতে চাপা, গাড়িতে চাপার পর মাথায় হু হু করে টেনশন চলতে থাকে। এই প্রথম বার যাচ্ছি সেখানে--কোথায় থাকবো ? আশ্রমের জায়গা না পাবারই কথা। সেখানে মাস দুয়েক আগে থেকেই নাকি পান্থনিবাস ভক্ত নিবাস সব বুক হয়ে থাকে। না পেলে অগত্যা কোন হোটেলে গিয়ে মাথা খুঁজতে হবে। রামকৃষ্ণদেবের স্মরণে এই কিছু দিন আগে আমরা স্বামী স্ত্রী দীক্ষা নিয়েছি। দীক্ষা নেবার উপযুক্ততা প্রমাণের জন্যে  রামকৃষ্ণ সারদা মায়ের ওপর লেখা দুচারটে বই পড়তে হয়েছিল। মনে পড়ে যাচ্ছিল কামারপুকুরের কিছু কিছু কথা। 
ট্রেনে জবলপুর থেকে বর্ধমান এসে নামলাম। সেখানে থেকে মাইল দুই আড়াই পার হয়ে গিয়ে পৌঁছালাম বাসস্ট্যান্ড। কামারপুকুরের অনেক বাস আছে, তার  একটায়  চড়ে বসলাম। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক মত লাগলো। আরামবাগ পার করে কামারপুকুর বাসস্ট্যান্ডে এসে পৌঁছলাম। স্ত্রীর বায়না আগে থেকেই ছিল, এবার নাছোড়বান্দা হলেন, আমরা আগে জয়রামবাটি যাবো, প্রথমে মা’র থানে গিয়ে উঠব তারপর কামারপুকুর আসবো। 

এখান থেকে জয়রামবাটির বাস আছে বটে কিন্তু সঙ্গে লটবহর তো কম নেই--স্ত্রীর ঢাউস ট্রলি ব্যাগ আর হ্যান্ড ব্যাগ ছাড়াও আমার কাছে আছে ছোট্ট ট্রলিব্যাগ আর একটা হ্যান্ড ব্যাগ। ট্রলি চাকায় চলে বটে, কিন্তু তার জন্যে মসৃণ রাস্তা না হলে উল্টে বিপদ। অগত্যা টোটোর স্মরণাপন্ন হলাম। বাসে যাওয়া গেল না, কারণ এই অল্প সময়ের মধ্যে এত মালপত্র তোলা নামানো বড় হ্যাপার ব্যাপার। অগত্যা এক শ’টাকার টোটো দেড় শ’টাকায় ঠিক করে চললাম জয়রামবাটির দিকে। যাই হোক বর্তমান বিষয় যেহেতু কামারপুকুর তাই জয়রামবাটির কথা না হয় পরে হবে।

জয়রামবাটিতে দিন তিনেক থেকে এসে পড়লাম কামারপুকুর। স্ত্রীর আমার পাকা কথা, এখানেও তিন দিন থাকতে হবে।

আশ্রমের দ্বারে হাজির হলাম, যদি কোন ঘর পাওয়া যায়। আশ্রমের অফিস ঘরে তখন একজন মাত্র স্বামীজি বসেছিলেন, তাঁকে বেশ গম্ভীর বলে মনে হল, তাঁর টেবিলের সামনের চেয়ারটাকে টেনে নিয়ে বসে পড়লাম। কিছুটা অনুনয়ের সুরে বললাম, আমরা কিছু ডোনেশন দেবো আশ্রমের কোন ঘর পাওয়া যাবে থাকার জন্য ? স্বামীজী আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে নিয়ে বলে উঠলেন, না, ঘর নেই--

আমার মনে হল, আমি ভুল করে ফেলেছি। ডোনেশনের কথাটা আগেভাগে না বলাটাই বুঝি উচিত ছিল। অগত্যা বিফল মনোরথে উঠে দাঁড়ালাম। দেখলাম স্ত্রী যেন মুখিয়ে আছেন, আমায় কিছু বলার জন্য। তাঁর কাছে যেতেই বললেন, কিছুটা চাপা গলাতেই মনে হল, না তোমার জ্ঞানগম্য কিছু হবে না ? আগেই হুট করে তুমি ডোনেশনের কথা বলে দিলে ! মহারাজ আমাদের কি ভাবলেন বল তো ? ভাবলেন আমাদের পয়সার গরম বেশি !

স্ত্রীর কথাটা কিছুটা মনোপুত মনে হল। কি করি, জয়রামবাটিতে ঘর পাওয়ার এমনিই তো পলিসি ছিল--

স্ত্রী বললেন, তোমার দোষ ছিল, স্বামীজীর সঙ্গে আমাকে কথা বলতে দিতে, দেখতে ঠিক ঘর পেয়ে যেতাম। 

কথা সত্য। কিন্তু আমার তো মাঝে মাঝে কর্তব্যর কোটা থাকে। তাতে বাধা পড়লে কার ভালো লাগে বলুন ? তবে মাথা নিচু করাটা কেমন যেন অপমান অপমান বলে মনে হয়। মনে মনে তাই নিজের সন্তুষ্টির জন্যে জনান্তিকে বলে নিলাম, এই স্ত্রী জাতির কথা বেশি শুনতে নেই, ওরা মনে করেন সর্বত্রই তাহাদের জয় হইবে। সুন্দর মুখের জয় বুঝি সর্বত্র ! ধুস শালা, দিনের শুরুটাই কেমন খারাপ হয়ে শুরু হল ! অগত্যা হোটেল দেখতে হয়, বেশি দূরে যেতে হল না। শ’-দেড়’শ পা এগিয়ে একটা হোটেল পেয়ে গেলাম। দর কষাকষির পর এক হাজার টাকা রাত্রি হিসাবে তিন দিনের থাকার এডভান্স দিয়ে দিলাম।

কামারপুকুর হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলী জেলার আরামবাগ মহকুমার অন্তর্গত একটি গ্রাম। কামারপুকুরে গোঘাট সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকের সদর দফতর অবস্থিত। এই গ্রামে ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসের পৈত্রিক বাড়ি ও জন্মস্থান। রামকৃষ্ণ পরমহংসের স্ত্রী সারদা দেবীর জন্মস্থান  জয়রামবাটী গ্রাম বাঁকুড়া জেলার অন্তর্গত কামারপুকুর গ্রামের কাছে অবস্থিত। রামকৃষ্ণ পরমহংসের জন্মস্থান ও পৈতৃক বাড়ি এখনকার ‘রামকৃষ্ণ মঠ, কামারপুকুর’ নামে  রামকৃষ্ণ মঠ ও  মিশনের শাখাকেন্দ্র রুপে স্থাপিত। তার পরিবারের রঘুবীর মন্দির, যুগী শিবমন্দির ও অন্যান্য দ্রষ্টব্য স্থানগুলি এখন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে তীর্থস্থানের মর্যাদা পায়।

কামারপুকুর গ্রামের আদি নাম সুখলালগঞ্জ। গ্রামের আদি জমিদার সুখলাল গোস্বামীর নামেই এই নাম। সুখলালগঞ্জ,  শ্রীপুর,  মুকুন্দপুর, মধুবাটী ও কামারপুর--এই পাঁচখানি ছোটো ছোট গ্রাম পরস্পরের খুব কাছাকাছি ছিল বলে বহুদিন ধরে সকলের কাছে শুধুমাত্র কামার পুকুর গ্রাম নামেই পরিচিত হয়ে আসছে। 

কামারপুকুরে অবস্থিত কামারদের পুষ্করিনী 
অনেকের মতে, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের ভিক্ষামাতা ধনী কামারিনীর পিতৃকুলের কোন এক ব্যক্তিকে দিয়ে স্থানীয় শাসনকর্তা মানিকরাজা যে পুকুরটি খনন করিয়ে ছিলেন, তাকে কামারদের পুষ্করিনী নামে অভিহিত করা হত। এই নামটি থেকেই কামারপুকুর নামটির উদ্ভব ঘটে। বর্তমানে সে পুকুর এখনও এখানে দৃশ্যমান—

No comments