Header Ads

এক বীর বিপ্লবীর আত্মকথা


কখনো কী খড়্গপুর আইআইটিতে ঘুরতে গেছেন। যদি না গিয়ে থাকেন তাহলে বলবো একবার ঘুরে আসুন। আইআইটির চত্বরে পায়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যান হিজলি ডিটেনশন ক্যাম্পে। তার সামনে দেখতে পাবেন দুটো স্মৃতিসৌধ বানানো হচ্ছে। আপনারা কী জানেন ঐ দুটো স্মৃতিসৌধ কাদের শ্রদ্ধা জানিয়ে বানানো হয়েছে? ঐ দুটো স্মৃতিসৌধ বানানো হয়েছে বিপ্লবী তারকেশ্বর সেনগুপ্ত ও সন্তোষ মিত্রকে শ্রদ্ধা জানিয়ে। একটু লক্ষ্য করে দেখবেন মর্মর পাথরে খোদিত এপিটাফে লেখা আছে "হিজলি বন্দিশিবিরে ইংরেজ শাসকের গুলিবর্ষণে দেশের মুক্তিযজ্ঞে তোমাদের শৌর্যময় আত্মাহুতি  শ্রদ্ধানত অন্তরে স্মরণ করি।"


হিজলি ডিটেনশন ক্যাম্পের সেই ঐতিহাসিক ঘটনা৷ ১৯৩০ খ্রীস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার নির্মাণ করেছিল হিজলি ডিটেনশন ক্যাম্প। এই ক্যাম্পে পুরুষ ও নারীদের  জন্য দুটো আলাদা আলাদা শেল ছিল। নারীদের শেলে বন্দী ছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা, সুহাসিনী গঙ্গোপাধ্যায়, সরোজ আভা নাগ, বনলতা দাশগুপ্ত ও ইন্দুমতি ঘোষের মতো বীরাঙ্গনা নারীরা। পুরুষদের   শেলে বন্দী ছিলেন ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তী, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়, প্রফুল্ল সেনের মতো বিপ্লবীরা। অসহযোগ আন্দোলন ও লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সাথে যুক্ত বিপ্লবী তারকেশ্বর সেনগুপ্ত ও তাঁর সঙ্গী সন্তোষ কুমার মিত্রকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের জন্য বিনা বিচারে গ্রেপ্তার করে হিজলি ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী করা হয়। ১৯৩১ খ্রীস্টাব্দের ১৬ ই সেপ্টেম্বর রাত্রি আটটার সময় ব্রিটিশ পুলিশ 'পাগলা ঘন্টা' বাজিয়ে নিরস্ত্র বন্দিদের ওপর গুলি চালিয়েছিল। সেদিন ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন তারকেশ্বর সেনগুপ্ত ও সন্তোষ কুমার মিত্র। এই গুলি চালানোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বিশিষ্ট দেশনায়কেরা। তাঁদের মৃতদেহ নিতে এসেছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। ঐ বছরের ২৬ শে সেপ্টেম্বর কলকাতার শহিদ মিনারের নীচে প্রতিবাদ সভা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অতঃপর বন্ধ করে দেওয়া হয় হিজলি ডিটেনশন ক্যাম্পকে।হাওড়া থেকে শোকমিছিল করে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে শেষকৃত্য করা হয় এই দুই বিপ্লবীকে। তারকেশ্বর সেনগুপ্তের চিতাভস্ম তাঁর জন্মভূমি গৈলা গ্রামে নিয়ে যাওয়া যায়। তাঁর চিতাভস্ম প্রোথিত করে তার ওপর একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়। যার শিলান্যাস করেন সুভাষচন্দ্র বসু ৷ 

আজ সেই মহান বিপ্লবী তারকেশ্বর সেনগুপ্তের ১১৫ তম জন্মবার্ষিকী। অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত বরিশালের গৈলা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এই গৈলা গ্রামের উল্লেখ আছে বিজয় গুপ্তের 'মনসামঙ্গল' কাব্যে। এ গ্রামের সম্পর্কে তিনি লিখেছেন "পশ্চিমে ঘাঘর নদী, পূর্বে খণ্ডেশ্বর, মধ্যখানে ফুল্লশ্রী, পণ্ডিতনগর, স্থানগুণে যেই জন্মে সেই গুণময় হেন নিবাসে জন্মে- শ্রীবিজয়।" ড. সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, মৈত্রেয়ী দেবী, মণীন্দ্র গুপ্ত ও ত্রিলোচন দাশের মতো মহান ব্যক্তিত্বরা জন্ম নিয়েছিলেন এই গ্রামে।  পরিবারের আদর্শে তিনি দেশপ্রেমের ধারণায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তিনি ১৯২৪ খ্রীস্টাব্দে গৈলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন৷ এরপর ১৯২৬ খ্রীস্টাব্দে ব্রজমোহন কলেজ থেকে আই.এ পরীক্ষা দেন কিন্তু অকৃতকার্য হন। 

পঁচিশ বছর বয়সে বিপ্লবী তারকেশ্বর সেনগুপ্ত গৈলা গ্রামে তাঁর সতীর্থদের নিয়ে গড়ে তোলেন 'গৈলা সোবাশ্রম'। যার উদ্দেশ্য ছিল বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার জন্য রাজনৈতিক চেতনা গড়ে তোলা। তিনি 'গৈলা সেবাশ্রমে'র মাধ্যমে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতেন। এছাড়াও নৈশ বিদ্যালয়, পাঠাগারসহ নানা কৃষ্টিমূলক কাজকর্মও পরিচালনা করতেন৷ তাঁকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন সেই গ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরাও। তাদের আন্দোলন গৈলা থেকে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে৷ এমনকি বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে সূদুর পশ্চিমবঙ্গেও উপচে পড়ে তাদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের ঢেউ। 

তিনি পরবর্তীকালে অসহযোগ আন্দোলন ও লবণ সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ করেন। অনেকে বাঙালিই হয়তো তাঁর নাম জানেন না। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তাঁর যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। বরিশালের মানুষদের বিপ্লবীর আদর্শে তিনি অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তিনি বাংলা ও বাঙালির গর্ব। তাঁর জন্মদিনে রইল শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন।


No comments