অখ্যাত গ্রামের জগতশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিকের জীবন বৃত্তান্ত ইতিকথা || প্রথম পর্ব
সিপাহী বিদ্রোহ সবে শেষ হয়েছে। সারা ভারতবর্ষ আলোড়িত। বাদ যায়নি বাংলাদেশের বিক্রমপুরের রাড়িখাল গ্রামও। এমতাবস্থায় বাংলার ঘর আলো করে জন্ম নিলেন একজন গর্বিত বঙ্গসন্তান। যার হাত ধরে বিজ্ঞান জগতে ঘটেছিল আমূল পরিবর্তন। আজকে আমরা যে বেতারে গান শুনি বা বিভিন্ন জায়গা থেকে যে তথ্য পাই তিনি না থাকলে আমরা এতোটা উন্নত হতে পারতাম না। তিনি হলেন মহান বৈজ্ঞানিক আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু।
আমরা প্রায় আটটি পর্বে আলোচনা করবো বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুকে নিয়ে। এই পর্বে আমরা তুলে ধরছি তাঁর জন্ম ও বাল্যকাল।
জন্মঃ-
অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের রাড়িখাল গ্রামে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০ শে নভেম্বর জন্ম নিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। বিক্রমপুর ছিল এককালে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রাচীন সংস্কৃতিকেন্দ্র। এই গ্রামের বিখ্যাত বসু পরিবারের সন্তান শ্রী ভগবানচন্দ্র বসুর সন্তান ছিলেন তিনি। ভগবানচন্দ্র বসু ও বামাসুন্দরী দেবীর কোল আলো করে জন্ম নিলো এক ফুটফুটে শিশু। পিতা ভগবানচন্দ্র বসু ছিলেন একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তখনকার দিনে শিক্ষিত বাঙালিদের কাছে এটাই ছিল বড় চাকরী। সরকারী চাকরী করলেও ভগবানচন্দ্র বসু দেশকে দারুণ ভালোবাসতেন। কেমন করে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পে দেশের লোক উন্নত হবে তাদের কল্যাণ চিন্তায় তাঁর মন সর্বদা সজাগ থাকত। সেদিন বাংলার এক অখ্যাত গ্রামের বসু পরিবারে যে শিশুটি জন্মেছিল, কালক্রমে তিনি যে একজন পৃথিবী খ্যাত বৈজ্ঞানিক হয়ে জগৎসভায় ভারতের গৌরব বৃদ্ধি করবেন, লাভ করবেন লক্ষ্মীর বরমাল্য, একথা কি কেউ ভাবতে পেরেছিল?
এই মহান বিশ্ববিজয়ী বৈজ্ঞানিকের জীবনী বাঙালি তথা ভারতবাসীর চিরদিনের গৌরব ও গর্বের বিষয় হয়ে থাকবে। বাবা ভগবানচন্দ্র বসু যেমন উদার প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, তেমনই তাঁর মায়ের প্রকৃতিও ছিল সেই রকম। তাদের পরিবার মানতেন না কোন জাতবিচার। ছোটো-বড় পার্থক্য তাদের ছিলনা। বাবা-মার সৎ আদর্শ জগদীশচন্দ্রকে প্রকৃত মনুষ্যত্বের শিক্ষা দান করেছিল৷ তাঁর জন্মের কিছুদিন হতে না হতেই ভগবানচন্দ্র বদলি হয়ে গেলেন ফরিদপুরে। জগদীশচন্দ্রের শৈশবকাল কেটেছিল এই ফরিদপুরেই। ঢাকা আর ফরিদপুর দুটো স্থানকে বলা চলে খাল-বিল আর নদীর দেশ। নৌকো করেই সেখানকার লোকেরা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করতো। এখানকার মানুষদের প্রধান জীবিকা ছিল মৎস্য শিকার। ফরিদপুরে সেকেলে কোনো স্কুলও ছিলনা। ফলে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করতে বেশ অসুবিধে হত।
ফরিদপুরের মানুষের অনুরোধে তিনি গ্রামের জন্য একটি বাংলা মাধ্যমের স্কুল গড়ে দিলেন৷ বহু ছেলেমেয়ে সুযোগ পেল সঠিকভাবে পড়াশোনা করার৷ এমনকি এই স্কুলে জগদীশচন্দ্রকেও ভর্তি করে দেওয়া হলো৷ বাবা ভগবানচন্দ্র ফরিদপুরের চাষীদের উন্নয়নে বিশেষ দায়িত্ব পালন করলেন৷ চাষীদের সুবিধার্থে গড়ে তুললেন ফরিদপুর লোন অফিস। কৃষি ও শিল্পের উন্নতির জন্য ফরিদপুর মেলার প্রতিষ্ঠা করলেন।
বাল্যকালঃ-
জগদীশচন্দ্র বসুর দেখাশোনা করত ফরিদপুরের দুর্ধর্ষ ডাকাত। যাকে সবাই দীনু ডাকাত নামেই চিনত। একবার ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল দীনু ডাকাত। হাকিম ভগবানচন্দ্রের এজলাসে তাকে আনা হয়েছিল বিচারের জন্য। যে বিচারে তার তিন বছরের জেল হয়েছিল৷ জেল থেকে বেরিয়ে সে সোজা হাজির হয়েছিল স্বয়ং ভগবানচন্দ্রের কাছে। সে ঠিক করে জীবনে আর কোনোদিন ডাকাতি করবে না। ভগবানচন্দ্র তাকে রেখে দিলেন নিজের ছেলে জগদীশচন্দ্রকে দেখভাল করার জন্য। দীনু ডাকাত ঋণী হয়ে উঠলো ভগবানচন্দ্রের কাছে। সে জগদীশচন্দ্রকে ভীষণ ভালোবাসতো৷ দীনু ডাকাত জগদীশকে কাঁধে করে স্কুলে দিয়ে আসতো আবার নিয়েও আসতো। প্রতিদিন দীনু ডাকাত তাকে ডাকাতির অনেক গল্প শোনাতো। ছোট্ট জগদীশ একদিন চারটে গুবরে পোকা নিয়ে এলো৷ পোকাগুলোর গায়ে বেঁধে দিল সুতো৷ তারপর সেই সুতো জুড়ে দিল একটা দেশলাই বাক্সের সঙ্গে। পোকারা হাঁটলেই দেশলাই বাক্সটাও চলতে শুরু করে। আর এই দৃশ্য সে আপন মনে উপভোগ করতো। বাড়ির পাশে একটি নদী ছিল৷ যে নদীর দিকে তাকিয়ে বেলার পর বেলা সে অতিক্রম করতো৷ সন্ধ্যে হলেই সে এসে বসত নদীর তীরে। নদীর অবিশ্রান্ত জলস্রোত আকর্ষণ করত তাকে।
নিজ হাতে বিভিন্ন জিনিস বানাতে ভালোবাসত ছোট্ট ছেলেটি৷ খুব ছোটোবেলা থেকেই সে তার বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়ে পাখি ধরে আনত। তারপর বাড়িতে বসে সেই পাখির জন্য নিজের হাতে খাঁচা বানাতো৷ আবারো বদলি হতে হলো তার বাবাকে। ভগবানচন্দ্র উঠে এলেন সূদুর ফরিদপুর থেকে বর্ধমানে৷ হঠাৎ বর্ধমানে দেখা দিল ম্যালেরিয়ার প্রকোপ। যা প্রচন্ড ভয়াবহ মহামারীর আকার ধারণ করেছিল৷ শয়ে শয়ে লোক মারা যেতে লাগলো। এমৎ পরিস্থিতিতে ভগবানচন্দ্র অনাথ ছেলেদের জন্য গড়ে দিলেন একটি শিল্পশিক্ষা কেন্দ্র। কিশোর বয়সে ছেলেটি ঐ শিল্পশিক্ষা কেন্দ্রে যেতেন। সেই কেন্দ্রে ছোটো ছেলেটি মায়ের কাছে কিছু ভাঙা পেতল সংগ্রহ করে তা দিয়ে কামান বানিয়ে নিয়ে গেলেন।
পাঁচ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি করা হলো তাকে। তখনকার দিনেও আভিজাত পরিবারের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানো হতো। কিন্তু ভগবানচন্দ্র বসু জগদীশকে বাংলা মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করালেন৷ বাংলা মাধ্যম স্কুলে শিক্ষালাভের প্রসঙ্গে জগদীশচন্দ্র বলেছিলেন- "কেন বাবা আমাকে বাংলা মাধ্যমের স্কুলে ভর্তি করেছিলেন, পরে বুঝতে পেরেছি। আমি আমার নিজস্ব মাতৃভাষা শিখতে পেরেছিলাম। আমার নিজস্ব চিন্তা, আমার দেশের জাতীয় সংস্কৃতি, সমস্তই বাংলা সাহিত্যের মাধ্যমে জানতে পেরেছিলাম।"
বাংলা স্কুলে চাষীর ছেলে, বাগ্দীর ছেলে, মুসলমান চাপরাসী আর জেলেদের পাশাপাশি বসেই লেখাপড়া শিখতে লাগলো ছোট্ট জগদীশচন্দ্র৷ তারাই ছিল তার খেলার সঙ্গী। জেলের ছেলেদের কাছে মাছ ধরার গল্প শুনতো। দীনু ডাকাতকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে সে তার মনের মধ্যে সুপ্ত থাকা প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেতো৷ স্কুল ছুটি হলে সে তার বন্ধুদের তার বাড়িতে নিয়ে আসতো। তার মা বামাসুন্দরী দেবী তার বন্ধুদের একসাথে বসিয়ে খাবার দিতেন। দীনু ডাকাতের কাঁধে কিছুদিন যাতায়াত করার পর তার বাবা তাকে একটি টাট্টু ঘোড়া কিনে দিলেন। সেই টাট্টু ঘোড়ার পিঠে চেপেই সে যাতায়াত করতে হতো।
গাছগাছালির সাথে তার একটা সখ্য জন্মেছিল। সে ক্রমেই প্রকৃতিপ্রেমী হয়ে উঠলো। ছোট্ট জগদীশ প্রকৃতির সাথে মিশে পোকামাকড় ও গাছপালার স্বভাব লক্ষ্য করার মত একটা মানসিকতা গড়ে তুলেছিল।
ঋণ- জগদীশচন্দ্র বসু (শান্তা শ্রীমানী), বৈজ্ঞানিক শ্রী জগদীশ চন্দ্র বসু (নান্টু গঙ্গোপাধ্যায়)
Post a Comment