Header Ads

বাঙালি জীব বিশেষজ্ঞ রামব্রহ্ম সান্যাল প্রথম ভারতীয় হিসেবে যোগ দেন আন্তর্জাতিক জীববিজ্ঞানী সম্মেলনে


আলিপুর চিড়িয়াখানা কলকাতা শহরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। দেশ-বিদেশের নানা প্রজাতির পশু-পাখির সম্ভার এবং তাদের প্রত্যেকের থাকা, খাওয়া,বেড়ে-ওঠা ও প্রজননের জন্যে বিভিন্ন রকমের বাসস্থান বা খাঁচা সত্যিই আমাদের তাদের সম্পর্কে উৎসাহী করিয়ে তোলে। আর সেই খাঁচার মধ্যে তাদের হরেক রকম আচার-আচরণ  সত্যিই আমাদের বিস্ময় জোগায় বৈকি। আচ্ছা, আমরা ক’জন জানি যে এই চিড়িয়াখানা নির্মাণের পেছনে এক বাঙালিরও অবদান রয়েছে। হ্যাঁ,মানছি চিড়িয়াখানা সাহেব-সুবোদের হাতে গড়া, তবে তাঁদের সাথে ছিলেন যে বাঙালি তাঁকে আমরা কজন জানি? তাঁর নাম 'রামব্রহ্ম সান্যাল'-যিনি পরিচিত ছিলেন 'আর.বি. সান্যাল' নামে। আমরা আজ এই বিস্মৃতপ্রায়  বাঙালি রামব্রহ্ম সান্যালকে নিয়ে আলোচনা করব। 


রামব্রহ্ম সান্যাল ১৪ই জানুয়ারি,১৮৫০ সালে (আবার অনেকে লেখেন ১৮৫৮ সালে) বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার মহুলা গ্রামের লালগোলায় তাঁর মামার-বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম বৈদ্যনাথ সান্যাল ও মাতার নাম ভবসুন্দরী দেবী। রামব্রহ্মের পৈতৃক বাড়ি ছিল মুর্শিদাবাদ জেলার মহুলা গ্রামে। তাঁর বাল্যকাল ও বিদ্যালয় জীবন কাটে বহরমপুরে। বহরমপুর কলেজ থেকে  প্রবেশিকা বা এন্ট্রান্স পাশ করে উচ্চশিক্ষার জন্যে তিনি কলকাতায় আসেন এবং সম্ভবত ১৮৭০ সালে  কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিন বছর ডাক্তারি পড়ার পর তাঁকে আর্থিক কারণে লেখাপড়া ছেদ করতে হয়। আবার কেউ কেউ বলেন যে চোখের সমস্যা হওয়ায় তিনি চিকিৎসকদের পরামর্শে ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। যাই হোক, তাঁর প্রথাগত লেখাপড়া না এগোলেও ডাক্তারি ছাত্রাবস্থায় উদ্ভিদবিদ্যা ও প্রাণিবিদ্যা সম্পর্কে তাঁর পড়াশোনা তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনের পথ সুনিশ্চিত বা নির্ধারিত করে রেখেছিল। এই দুই বিষয়ের জ্ঞান তাঁর পরবর্তীকালে খুবই কাজে লেগেছিল, কেননা এই দুই বিষয়ের জ্ঞানই তাঁকে সাহায্য করেছিল কলকাতার চিড়িয়াখানার নির্মাণের কাজে। 

এবার আসি এশিয়াটিক সোসাইটির কথায়। বলাবাহুল্য, ইংরেজ সরকারের হাতে গড়া এই সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান থেকেই জন্ম নিয়েছিল একাধিক সমৃদ্ধশালী প্রতিষ্ঠান যার মধ্যে অন্যতম কলকাতার চিড়িয়াখানা। ১৮৬৭ সালের জানুয়ারি মাসে এশিয়াটিক সোসাইটির একটি সভায় তৎকালীন এশিয়াটিক সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ডাঃ জে ফেরে (Dr.Joseph Fayrer) (১৮২৪ থেকে ১৯০৭) একটি প্রস্তাব পেশ করেন যার বর্ণনা এশিয়াটিক সোসাইটি পুরনো ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যাবে। তা, সেই প্রস্তাবটি সামান্য অংশ এখানে তুলে ধরা হল, “I have the gratification of recording the initiation of a movement among several members of the society and others,for establishing the most useful and instructive of all places of public recreation, a zoological garden.” ― এই উক্ত প্রস্তাবটির  থেকেই বোঝা যায় যে ডাঃ ফেরে একটি পশুশালা বা চিড়িয়াখানায় প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। ড. ফেরের সেই প্রস্তাবটি কার্যকর করার জন্যে এশিয়াটিক সোসাইটির এক সক্রিয় জার্মান সদস্য কার্ল লুইস স্যুয়েন্ডলার (Carl Louis Schwendler) (১৮৩৮ থেকে ১৮৮২)-কে চিড়িয়াখানা স্থাপন করার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট স্কিম পেশ করার অনুরোধ করা হয়। সেই স্কিম অবশেষে ১৮৭৩  সালের ফেব্রুয়ারী মাসে চিড়িয়াখানা স্থাপন করার সাব-কমিটির হাতে আসলে চিড়িয়াখানা তৈরির কাজ শুরু হয়।এখানে উল্লেখ্য যে, ১৮৬৭ সালে জোসেফ ফেরের দেওয়া চিড়িয়াখানা তৈরির প্রস্তাবটি ১৮৭৩ সালে স্যুয়েন্ডলার আবার উত্থাপন করেছিলেন।

কার্ল লুইস স্যুয়েন্ডলার ছিলেন একজন সম্মানিত গভর্নর যিনি চিড়িয়াখানার মূল ভিত গঠনের জন্য তাঁর নিজের সংগ্রহ থেকে প্রাণী দান করেছিলেন। কার্ল লুইস,শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের তত্ত্বাবধায়ক ডঃ জর্জ কিং(George King)(১৮৪০ থেকে ১৯০৯), এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার মি.এ এফ ওয়াটসন ইত্যাদি বিশিষ্ট ইংরেজ পশুপাখি প্রেমী  ও বিশেষজ্ঞদের সাথে যে বাঙালি যুবক চিড়িয়াখানা তৈরির একেবারে শুরু থেকে বা বলা যায় আদি লগ্ন থেকে কাজ করছিলেন তাঁর নামই হল রামব্রহ্ম সান্যাল। আসলে এই চিড়িয়াখানা তৈরির  কাজটি চিড়িয়াখানা উদ্বোধনের বেশ কিছু বছর আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। রামব্রহ্ম সান্যাল সেই সময় থেকেই নানা কাজকর্মের তদারকি করতেন যেমন কোন প্রাণীর বাসস্থান বা খাঁচা বা থাকার ঘর কেমন হবে এইসব নানান গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়েও তিনি ভাবতেন। আশ্চর্যের বা বিস্ময় করার বিষয় হল এই যে রামব্রহ্ম সান্যাল জীবনে কোনোদিন কোনো  চিড়িয়াখানা না দেখেই মাত্র ২৪ থেকে ২৫ বছর বয়সেই এই তদারকি করার কাজটি নিখুঁতভাবে করতে পারতেন। আসলে পশু পাখিদের জীবন তাঁর অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে উঠেছিল যে! 

প্রত্যেকের জীবনে কারুর না কারুর প্রভাব থাকে। রামব্রহ্ম সান্যালেরও ছিল। তাঁর জীবনে যাঁদের প্রভাব ছিল তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন শিবপুর রয়েল বোটানিক গার্ডেন (বর্তমান আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ভারতীয় উদ্ভিদ উদ্যান)-এর  সুপারিন্টেন্ডেন্ট বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ ডঃ জর্জ কিং। যিনি আবার কলকাতা মেডিকেল কলেজের অনুষদ ছিলেন। ১৮৭৫ থেকে ১৮৭৬ সালের শীতকালে, সম্ভবত জর্জ কিং-এর সুপারিশে রামব্রহ্ম একজন অনিয়মিত কর্মী হিসাবে আলিপুর চিড়িয়াখানায় যোগদান করেছিলেন। বলা যায় যে, বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ কিং জর্জের অধীনে তিনি সেখানে কর্মরত ছিলেন। জর্জ কিং চিড়িয়াখানার ম্যানেজিং কমিটির একজন সাম্মানিক সদস্য ছিলেন। প্রথম ক’মাসে রামব্রহ্ম পশুদের যত্ন ও চিড়িয়াখানায় দর্শনার্থীদের প্রয়োজন দেখাশোনা এই উভয় কাজই করতেন। তিনি জীববিজ্ঞানী হিসাবে চিড়িয়াখানায় প্রথম প্রশিক্ষিত রক্ষকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তাঁর এই কঠোর পরিশ্রমের ফলস্বরূপ ১৮৭৬ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে তাঁকে "প্রধান বাবু" (প্রধান সহকারী) বা সুপারিনটেনডেন্ট করা হয়। ওই সময় ওই পদের মাইনে ছিল মাসিক চল্লিশ টাকা যা সেই সময় বেশ ভালো মাইনে হিসেবেই গণ্য হয়। তাই বলা যায়, ১৮৭৫ সালে চিড়িয়াখানার দ্বার  সর্বসাধারণের জন্য উন্মোচন করা হয় আর ওই সমতের কিছু পর থেকেই রামব্রহ্ম সান্যাল চিড়িয়াখানার  তত্ত্বাবধায়ক বা সুপারিনটেনডেন্ট পদে আসীন বা নিযুক্ত ছিলেন। 

বলাই যায় যে, তাঁর খ্যাতির সঙ্গে সঙ্গে পদোন্নতিও ঘটে। বলাবাহুল্য, রামব্রহ্মই  ছিলেন চিড়িয়াখানার প্রথম তত্ত্বাবধায়ক (সুপারিন্টেন্ডেন্ট) বা অধীক্ষক যিনি কিনা ভারতীয়। পরাধীন ভারতে যা ভারতীয়দের ক্ষেত্রে সত্যিই বিরল। তাই, কতখানি যোগ্যতা ও জ্ঞান থাকলে তখনকার দিনে ওরকম পদে আসীন হতে পারা যায় তা ভাবলে সত্যিই বিস্মিত হতে হয়। যদিও, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সব পদেই  ইউরোপীয়রা বা অভারতীয়রা আসীন ছিলেন। যেমন ১৮৭৫ সালেই চিড়িয়াখানার  ম্যানেজিং কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন লর্ড ব্রাউন আর সি ই বাকল্যান্ড ছিলেন সেক্রেটারি।১৮৯০ সালে কলকাতা চিড়িয়াখানার নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হয়। 

১৮৭৭ সালের জানুয়ারীতে চিড়িয়াখানার ব্যবস্থাপনা কমিটি সেখানে একটি লগ বই চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। প্রাণীদের প্রতিদিনকার অভ্যাস এবং আচরণ লক্ষ্য করে সেই লগ বইতে দৈনিক লিপিবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এই কাজে কার্ল লুই স্যুয়েন্ডলার-সহ তিনজন ইউরোপীয়কে সহায়তা করার জন্য রামব্রহ্ম সান্যালকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। সান্যাল প্রচুর তথ্য ও নোট সংগ্রহ করেছিলেন সে সময়ের নানা বইপত্র থেকে যার মধ্যে টি. সি. জেরডনের 'এনিমেলস অব ইন্ডিয়া ও বার্ডস অব ইন্ডিয়া' উল্লেখযোগ্য। ওই সময়ে একজন অতিরিক্ত মালী নিয়োগ করা হলে সান্যালের দায়িত্ব কিছুটা হালকা হয়েছিল। 

তবে, রামব্রহ্ম সান্যাল স্মরণীয় হয়ে আছেন পশু-পাখির আচার আচরণ নিয়ে গবেষণার জন্য। পশু-পাখির জীবন, তাদের আচার আচরণ,বাসস্থান, বৈচিত্র ইত্যাদি ছিল তাঁর অনুসন্ধানের বিষয়। আর এই অন্বেষণের কাজ, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও সমস্ত অর্জিত বিদ্যাই তাঁকে চিড়িয়াখানা গঠনের কাজে খুবই সাহায্য করেছিল। তাঁর গবেষণার কাজের জন্য তিনি বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ স্যার জর্জ বেনেটের সাথে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিগুলি এতটাই উন্নত ছিল যে তাঁর গবেষণার ফলেই ১৮৮৯ সালে একটি জীবিত সুমাত্রান গণ্ডারের জন্ম হয়েছিল। এটি তখন একটি বিরল ঘটনা তো বটেই কেননা ২০০১ সাল পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে আবদ্ধ পশুদের মধ্যে এই ঘটনা দেখা যায়নি। তাঁর  গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার কাজ তাঁকে বিশ্বের জীববিজ্ঞানী মহলে পরিচিতি লাভ করায়। ১৮৯৮ সালে ইউরোপে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক জীববিজ্ঞানী সম্মেলনে তিনি ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। খুব সম্ভবত তিনিই প্রথম ভারতীয় জীব বিশেষজ্ঞ হয়ে বিদেশে যান। 

তিনি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে পশুর প্রজননে একজন অগ্রদূত ছিলেন আর এই নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ পশুর প্রজনন সম্পর্কিত একটি পুস্তক লিখেছিলেন-‘এ হ্যান্ডবুক অব দ্য ম্যানেজমেন্ট অব অ্যানিম্যালস ইন ক্যাপটিভিটি ইন লোয়ার বেঙ্গল(A Handbook of Management of Wild Animals in Captivity in Lower Bengal(১৮৯২)’। এই বইটি আজও ন্যু-ম্যানেজমেন্ট বিষয়ক সারা বিশ্বে এক উল্লেখযোগ্য বই। ৪ঠা আগস্ট,১৮৯২ নেচার জার্নালে এই বইটির পর্যালোচনা করা হয়েছিল।১৯৬৪ সালে ‘লি ক্র্যান্ডল’ ‘দ্য ম্যানেজমেন্ট অব ওয়াইল্ড ম্যামালস ইন ক্যাপটিভিটি’ প্রকাশিত হওয়ার আগে পর্যন্ত এই বইটি ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চিড়িয়াখানা রক্ষকদের জন্য স্ট্যান্ডার্ড হ্যান্ডবুক বা মানক পুস্তিকা হিসেবে ছিল।   

সাধারণের জন্যে লেখা শিবপুর উদ্ভিদ উদ্যান, আলিপুর চিড়িয়াখানা, পশুকক্ষ, ভারতীয় জাদুঘর-ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য স্থানসহ বাংলার প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীবজগৎ বিষয়ক একখানি তথ্যসমৃদ্ধশালী বই হল-‘Hours with Nature(১৮৯৬)’। এছাড়াও, বাংলার প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীবজগৎ সম্পর্কিত তাঁর অনেক লেখা রয়েছে। তিনি শিশুদের জন্য অতি সহজ, সরল ভাষায় বিজ্ঞানের একটি পাঠ্যপুস্তকও  রচনা করেছিলেন যার নাম ‛বিজ্ঞান পাঠ’। তাঁর  কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি লন্ডনের জুয়োলজিক্যাল সোসাইটি থেকে সাম্মানিক সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন এবং পরিণত বয়সে ইংরেজ সরকার তাকে 'রায় বাহাদুর' উপাধিতে সম্মানিত করেছিল। ১৩ই অক্টোবর,১৯০৮ সালে এই মহান জীববিজ্ঞানী পরলোকগমন করেন। এবছর নিঃশব্দে পার হয়ে গেল এই মহান জীববিজ্ঞানীর ১৭০তম জন্মবার্ষিকী। তাই,এবার আলিপুর চিড়িয়াখানায় গেলে আমরা যেন অন্তত স্মরণ করি এর অন্যতম নির্মাতা ও প্রথম তত্ত্বাবধায়ক বিস্মৃতপ্রায় বাঙালি রামব্রহ্ম সান্যাল ও তাঁর কর্মকে। 



তথ্যসূত্রঃ- (১)বিস্মৃতপ্রায় বাঙালি বিজ্ঞানী(প্রথম খণ্ড)-রণতোষ চক্রবর্তী, জ্ঞান বিচিত্রা প্রকাশনী।
(২) সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, সাহিত্য সংসদ।
(৩) উইকিপিডিয়া ওয়েবসাইট (বাংলা ও ইংরেজি)।
(৪) বাংলাপিডিয়া ওয়েবসাইট।

No comments