ডায়াবেটিস, ক্যানসার, ওবেসিটি ও কার্ডিও ভাসকুলার ডিজিজ নিয়ন্ত্রণে মেনে চলতে পারেন 'ভেগান ডায়েট'
'সাত্ত্বিক আহার' - নামটা শুনেই নাক কোঁচকাচ্ছেন কি? তাহলে জেনে নিন প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা এই 'সাত্ত্বিক আহার'-ই কিন্তু বর্তমানের অতি জনপ্রিয় ভেগান ডায়েট।
কি এই ভেগান ডায়েট?
যে ডায়েট প্ল্যানে শুধুমাত্র উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে প্রাপ্ত খাবার থাকে ( যেমন সব্জী, ফল, জল ও বাদাম জাতীয় খাদ্য)। এমনকী প্রাণীজ উৎস থেকে প্রাপ্ত দুধ বা দুধ জাতীয় খাবারও থাকেনা, তাকেই ভেগান ডায়েট বলে।
১৯৪৪ সালে ডোনাল্ড ওয়াটসন প্রথম 'ভেগান সোসাইটি' তৈরী করেন। তিনি 'ভেজিটেরিয়ান' কথাটি থেকে শুধুমাত্র ভেগান অংশটুকু নিয়ে বুঝিয়ে দেন এই দুই শব্দের পার্থক্যও। তারপর থেকে ১লা নভেম্বর 'ওয়ার্ল্ড ভেগান ডে' হিসাবে গণ্য করা হয়।
কেন মানবো ভেগান ডায়েট?
বর্তমানে ভেগান ডায়েট খেলাধূলা ও বিনোদন জগতে সর্বাপেক্ষা প্রচলিত। কিন্তু কেন?
➡ ওবেসিটি ও কার্ডিও ভাসকুলার ডিজিজ নিয়ন্ত্রণ:- ভেগান ডায়েটে আর্টিফিশিয়াল ও কেমিক্যাল ফুড অ্যাডিটিভস-এর ব্যবহার প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে ওজন থাকে নিয়ন্ত্রণে। এছাড়া ফল, সব্জী, হার্বস ও নাটস রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। তাই ভেগান ডায়েটের সাথে নিয়মিত ব্যায়াম মেটাবলিজম বাড়ায়, চর্বি নিয়ন্ত্রণ করে এবং হার্টের সমস্যা প্রায় ২২% কমিয়ে দেয়।
➡ ডায়াবেটিস:- সঠিক ভেগান ডায়েট রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং কিডনির কার্যক্ষমতা বজায় রাখে সঠিকভাবে।
➡ ক্যানসার:- ভেগান ডায়েটে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট এর পরিমাণ প্রচুর থাকায় ক্যানসারের সমস্যা প্রায় ১৯% কম হয়।
খেলাধূলার জগতে ভেগান ডায়েট :- এতদিন খেলাধূলার জগতে রেড মিটের প্রচলন খুব বেশি ছিল কারণ এতে ফ্যাট ও ক্যালোরির পরিমাণ খুব বেশি। কিন্তু বর্তমানে সে জায়গা নিয়েছে ভেগান ডায়েট, তা সে ক্রিকেটার হোক বা অলিম্পিক পদকজয়ী যে-কোনো খেলোয়াড়। ভেগান ডায়েট কিন্তু সবার পছন্দের কিন্তু কেন?
➡ প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও মিনারেলের উপস্থিতির জন্য মাংসপেশী সুদৃঢ় হয় এবং 'মাসল ক্র্যাম্পিং' এর সম্ভবনা কমে যায়।
➡ ভেগান ডায়েট এক্সারসাইজের সময় শরীরে অ্যালক্যালিনিটি বাড়িয়ে দেয় যা শরীরে অ্যাসিড প্রোডাকশনকে নিয়ন্ত্রণ করে।
➡ অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট:- অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমিয়ে শরীরে ইনফ্ল্যাসেশন এবং চোট আঘাতের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।
সর্বোপরি তাদের পারফরম্যান্সের ফলে উন্নতি হয় এবং মানসিক ও শারীরিক উত্তেজনা নিয়ন্ত্রিত হয়।
ভেগান ডায়েটে অন্তর্ভুক্ত খাদ্যসমূহ :-
ফল:- আপেল, তরমুজ, কলা, লেবু জাতীয় ফল, পেয়ারা, বেরীস, আঙুর, ড্রাই ফ্রুটস, বাদাম ইত্যাদি।
ভেজিটেবলস:- শশা, সেলেরি, গাজর ও অন্যান্য সকল সবুজ ও লাল শাকসব্জী, ব্রোকলি, অ্যাসপারাসাস ইত্যাদি।
হার্বস:- রসুন, অরগ্যানো, চাইভস, কিসমিস, হলুদ, কাঁচালঙ্কা ইত্যাদি।
লেগুমেস:- লেনটিলস, পি, গ্রীন বীনস্, সয়াবিন ইত্যাদি।
দৈনিক মেনুতালিকাঃ-
➡ সকালে ঘুম থেকে উঠে:- ডি টক্স ওয়াটার (মেথিগুড়ো, জিরাগুড়ো, লেবুর রস ও মধু)
➡ ব্রেকফাস্ট:-
স্প্রাউটস:- ভিটামিন সি, প্রোটিন ও অ্যান্টঅক্সিড্যান্ট।
আমন্ড:- হেলদি ফ্যাট, ফাইবার, প্রোটিন, ম্যাগনেসিয়াম ও ভিটামিন সি।
পামকিন সিড:- ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, আইরন, জিঙ্ক, কপার, ডব্লু থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড ও অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট।
কলা ও আপেল:- ক্যালোরি ও মাল্টি মিনারেল।
➡ দুপুরের খাবার :- অল্প ভাত, ডাল ও সব্জী।
➡ সন্ধ্যাবেলা (ওয়ার্কআউটের আগে) :-
ডালিয়া :- ফাইবার
ওয়ালনাট :- ডব্লু থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড ও অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট
কিসমিস :- আয়রন ও বোরণ
আমন্ড বা সয়া মিল্ক :- প্রোটিন।
ওয়ার্কআউটের পরে :- তরমুজ, কলা, ভিজিয়ে রাখা তরমুজের বীজ ও সিয়া/ চিয়া বীজ- মাল্টিভিটামিন, মাল্টিমিনারেল, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ডব্লু সিক্স ফ্যাটি অ্যাসিড।
➡ রাতের খাবার :-
মাসরুম- কপার।
টোফু- প্রোটিন এবং অল্প পরিমাণে আলু।
তাহলে অসুবিধা কোথায় ভেগান ডায়েট মানতে?
সম্পূর্ণভাবে ভেগান ডায়েট মেনে চলার ক্ষেত্রে বেশ কিছু অসুবিধা দেখা যায়। যেমন-
➡ ভেগান ডায়েটের মাধ্যমে ওজন কমানোর ক্ষেত্রে কিছু সময় তা বুমেরাং হয়ে যায়। কারণ এই ডায়েটে প্রতিবেশী রেসট্রিকশন থাকে যা কিছুদিন মানার পরেই ব্যক্তিটি প্রচুর পরিমাণে ফ্যাট ও চিনি জাতীয় খাবার খেতে শুরু করে।
➡ ছোটো থেকে যে আমিষ জাতীয় খাবার খেতে অভ্যস্ত সে হঠাৎ করে ভেগান ডায়েটে পরিবর্তিত হলে সমগ্র শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলো পাল্টে যায়, যা শরীরের পক্ষে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে।
➡ প্রাণীজ প্রোটিনে থাকা 'হিম' আয়রন অনেক দ্রুত ও ভালোভাবে দেহে শোষিত হয়, যা ভেগান ডায়েটে অনুপস্থিত।
➡ ক্যালসিয়াম, ডব্লু থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, বি টুয়েলভ ও ফোলিক অ্যাসিড এগুলি প্রাণীজ প্রোটিনে সর্বাধিক পাওয়া যায়। তাই ভেগান ডায়েটে বি টুয়েলভের কম উপস্থিতির জন্য সিএনএসের কার্যক্ষমতা হ্রাস পায় এবং 'স্ট্রোক' হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
➡ ডাল জাতীয় খাদ্যে এসেন্সিয়াল অ্যামিনো অ্যাসিডগুলি সম্পূর্ণভাবে উপস্থিত থাকে না।
➡ একটি অতি প্রয়োজনীয় উপাদান 'কোলিন' যা কোষের ফসফোলিপিড তৈরীতে অপরিহার্য। এর প্রধান উৎস হলো প্রাণীজ প্রোটিন, ফলে ভেগান ডায়েটে কোলিনের পরিমাণ অপর্যাপ্ত।
সর্বোপরি ভেগান ডায়েট মানবো নাকি মানবো না?
সবকিছুরই ভালো এবং খারাপ দিক আছে তাই ব্যক্তি বিশেষে তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে। ডাক্তার এবং ডায়েটিশিয়ানের তত্ত্বাবধানে থেকেই 'ভেগান ডায়েটে' নিজের খাদ্যাভ্যাসকে পরিবর্তন করা উচিৎ। তবে সপ্তাহে পাঁচ থেকে ছয় দিন নর্মাল ডায়েট প্ল্যানে থেকে বাকি এক থেকে দুই দিন ভেগান ডায়েট প্ল্যান মেনে চলার ক্ষেত্রে শরীরে ভারসাম্য বজায় থাকে।
ভেগান ডায়েটের ক্ষেত্রে যেগুলি খেয়াল রাখতে হবে---
➡ প্রচুর পরিমাণে ফল ও সব্জী ব্যবহার করে খাদ্যকে কালারফুল করে তুলতে হবে।
➡ 'হোল গ্রেনস' যেন 'বেস মিল' হয়।
➡ গরুর দুধের বিকল্প হিসাবে সয়া মিল্ক ও আমন্ড মিল্ক থাকবে।
➡ ডাল ও সয়াবীন প্রধানত প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করবে৷
➡ সারাদিন প্রচুর পরিমাণ জল পান করতে হবে।
Post a Comment