Header Ads

চট্টোপাধ্যায়বাবুর নাট্যচেতনার বৈশিষ্ট্য ও অন্য মোহিত


সামাজিক অবক্ষয়, দলীয় রাজনৈতিক মেরুকরণ, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে নাট্যমন্ত্রে যুবসমাজকে তিনি করেছিলেন দীক্ষিত। একজন নির্ভীক নাট্যপথিক তিনি। যার শিরার প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে জমে থাকতো নাটকের রক্ত-ঘাম। বাংলা নাট্যজগতে বিপ্লব নিয়ে আসতে তিনি প্রাণপণে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তিনি হলেন প্রখ্যাত নাট্যকার মোহিত চট্টোপাধ্যায়। যাকে উদ্ভট নাট্যরচনার বিশেষজ্ঞও বলা চলে। আজও নাট্যমঞ্চে নাটকের কথা ভেসে এলে চোখ বন্ধ করে সকলে মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের কথায় মনে করেন৷ বাংলার প্রথম সারির যে-কজন নাট্যকর আছেন তাদের মধ্যে এক উজ্জ্বল নাট্যতারকা হলেন তিনি৷ নাট্যকার উৎপল দত্ত, মনোজ মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, মন্মথ রায়, অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্রের সাথে সমানভাবে উচ্চারিত হয় তাঁর নামও।


জীবনের উৎস সন্ধানে নাট্যরস নিঙড়ে একটু সুখে বাঁচাটাই ছিল তাঁর জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। নাটক প্রসঙ্গে তিনি একবার বলেছিলেন "আসলে কি জানো, আমি ঠিক কিছু হতে চাই বলে লেখার মধ্য দিয়ে যাইনি। বোধোহয় জীবনের কোনো কাজই কিছু হতে চাই বলে করিনি, শুধু আরম্ভ করেছি। আর এই লেখা, নাটক বা কবিতা বলো সবকিছুই আমার কাছে ওয়ে অফ লাইফ বলে মনে হয়েছে।" 

মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের উদ্ভট নাটকের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত নাটক হিসাবে 'মৃত্যুসংবাদ' নাটকটির নাম করা যেতে পারে। যে নাটকে তুলে ধরা হয়েছে নির্মম বাস্তবতা যাকে আমরা গ্লোবালাইজেশন বলে থাকি। যে বাস্তবতার করাল গ্রাসে আমরা বিপন্নতার দিকে এগিয়ে চলেছি। এই বিপন্ন সময়ের গল্পই বলা হয়েছে এই নাটকে। বাস্তবের প্রেক্ষাপটে রূপকধর্মী আখ্যান হলো এই নাটক। একটি নারী চরিত্র ও দুই পুরুষ চরিত্র উঠে আসে এ নাটকে৷ প্রথম পুরুষ যে দাবী করে সে তার বাবাকে খুন করে এসেছেন। সে তার বাবার মৃত্যুকে উৎসব হিসেবে উদযাপন করছেন। দ্বিতীয় পুরুষ যে প্রচন্ড ভয় পান। এই দুটো পুরুষের মধ্যেকার মৃত্যুর খবরকে ঘিরে দর্শকদের উদ্দেশ্যে তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন৷ যে প্রশ্নটা হলো সমাজের মানুষ গল্পটাকে কোন চোখে বিচার করবেন। সত্যিই মহান তাঁর নাট্যভাবনা। নাট্যজগতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এক স্বতন্ত্র নাট্য অধিপতি হিসেবে হৃদয় জয় করেছেন নাট্যপ্রেমী মানুষদের। 

'মৃত্যুসংবাদ' ছাড়াও 'নীলরঙের ঘোড়া', 'চন্দ্রলোকে অগ্নিকাণ্ড', 'গুহাচিত্র', 'বাইরের দরজায়', 'আকরিক', 'মৃচ্ছকটিক', 'তোতারাম', 'তখন বিকেল', 'বর্ণ বিপর্যয়', 'চরিতমানস', 'বিপন্ন বিস্ময়ে'র মতো প্রায় শতাধিক নাটকের জন্ম দেন তিনি। প্রথম জীবনে তিনি কবি হিসেবে নিজের সৃজনশীলতা প্রদর্শন করলেও পরবর্তীকালে নাটকই হয়ে ওঠে তাঁর সাধনা। নাটক ও কবিতার যুগ্ম মেলবন্ধনে তিনি  নাট্যজগতে পরিবর্তনের হাওয়া নিয়ে এসেছিলেন। তিনি 'রাজরক্ত' নাটক লেখার পর নিজের ভাবনাকে পরিবর্তন করেন। তাঁর মন থেকে প্রতিবাদী ভাবমূর্তি, বামপন্থী মতবাদ, উগ্রতা, উষ্ণতা হঠাৎই উবে যায়। মনে জাগে মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। জীবনকে নতুন করে দেখতে থাকেন, চলে নতুন নতুন জীবনরসের সন্ধান। নানান বৈচিত্র্যে ভরা সৃষ্টিসম্ভারে লেখক অনেক প্রশ্নও রেখেছেন পাঠকমহলে। তবে লেখকের রচনার মধ্যে তখন রাজনৈতিক বিভেদের অনেক জিজ্ঞাসা থেকে গিয়েছে। 

তিনি 'জন্মদিন' নাটকে হেলেন কেলারের জীবনীকে যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার সাথে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। 'আকরিক' নাটকে কলকারখানাতে কর্মরত এক পরিবারের দ্বন্দ-কলহের মাঝে স্নেহ ভালোবাসার গল্পকে তুলে ধরেন। 'গুহাচিত্র' নাটকে কিছু মানুষের মধ্যে সঞ্চিত পাপপ্রবৃত্তিকে তুলে ধরেন। তিনি উদ্ভট রচনার আঙ্গিক গ্রহণ করলেও জীবনের শেষ পরিণতি সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। উদ্ভট নাটকের লক্ষ্মণগুলির মধ্যে ঘটনার অসংগতি, পারম্পর্যহীনতা, স্থান-কালের সীমা সম্পর্কে ভ্রূক্ষেপহীনতা, অবসাদ, ক্লান্তি, মৃত্যুকামনা সমস্তই নিখুঁতভাবে উপস্থাপিত করেছেন। তিনি এতো বড় একজন নাট্যতারকা থাকাসত্ত্বেও ভাবতে অবাক লাগে তাঁর জীবনী নিয়ে ইউটিউবে কোনো জীবনীমূলক ভিডিও ও কোনো ডকুমেন্টরি নির্মিত হয়নি৷ বড় কোনো সংবাদপত্রে ঘটা করে লেখা হয়নি তাঁর জীবন কাহিনী। তবে যাইহোক বাংলার নাট্য ইতিহাসে একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে তিনি আজীবন অমর হয়ে থাকবেন।

No comments