Header Ads

দুই বীরাঙ্গনা নারীর গল্প। যাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য ব্রিটিশ পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছিল।


সেনবংশের তো অনেক বিখ্যাত বা কুখ্যাত মানুষের নাম শুনেছেন, কিন্তু যদি বলি অনুভা সেন? শোনেননি তো! বেশ, যদি বলি ঊর্মিলা বাই...তাও শোনেননি !

     প্রতীকী চিত্র, ওনাদের কোন ছবি পাওয়া যায়নি।

দোষটা আপনার নয়, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচয়িতারা সযত্নে বাদ দিয়েছেন এরকম অনেক বিপ্লবীদের নাম।অথচ এইসব অনামী যোদ্ধাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি কাঙ্খিত স্বাধীনতা। তাঁদের কথা আজ ইতিহাসে লেখা নেই!

এনারা কেউ জাতীয় বীরের মর্যাদা পাননি। না আছে কোথাও এনাদের মূর্তি, না ধূমধাম করে পালন করা হয় জন্ম বা প্রয়াণ জয়ন্তী। আমরা তো জানিই না কবে কোথায় এনারা জন্মেছেন। কয়েকজন উৎসাহী গবেষকের প্রচেষ্টায় জানা গেছে অনুভা জন্মেছেন পূর্ববাংলার কোন এক নাম না জানা গ্রামে, আর ঊর্মিলা মহারাষ্ট্রের কোন ঊষর প্রান্তে। হাজার মাইলের ফারাক, কিন্তু দু'জনেই স্বপ্ন দেখেছিলেন দেশ মাতৃকা কে স্বাধীন করবার। মিল আরো এক জায়গায়.... ব্রিটিশ সেনার ফায়ারিং স্কোয়াডের গুলিতে একই দিনে ঝাঁঝরা হয়েছিল দুজনের দেহ ! 

বঙ্গললনা অনুভা নেভিতে যোগ দেন ১৯৪২ সালে আর ঊর্মিলা বাঈ যোগ দেন ১৯৪১ সালে। রাসবিহারী বসুর পরিকল্পনা মাফিক তখন সশস্ত্র বাহিনীতে বিদ্রোহের ক্ষেত্র তৈরি করা হচ্ছিল। সেই সন্ধিক্ষণে এনারা ব্রিটিশ নৌ বাহিনীতে নিযুক্ত হন। উদ্দেশ্য  সামরিক বাহিনীর গোপন খবর সংগ্রহ করা। এনারা ছিলেন WRIN অর্থাৎ উইমেন্স রয়াল ইন্ডিয়ান নেভি শাখার কর্মী। কাজ করতে হতো, আবার কখনো অফিসের কাজ কখনো বা নার্সিংয়ের। 

কিন্তু আসল কাজ ছিলো ছলে বলে কৌশলে বড় অফিসারদের থেকে গোপন খবর সংগ্রহ করা। দু-তিনবছর নিরাপদে এই দায়িত্ব পালন করেন দুজনে, কিন্তু কোনভাবে এই খবর ফাঁস হয়ে যায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে। ১৯৪৪ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারী অনুভা সেন ও ঊর্মিলা বাঈ গোপন কাগজপত্র সমেত সামরিক গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। তাদের কাছ থেকে যে কাগজপত্র পাওয়া যায় তা থেকে ব্রিটিশরা জানতে পারে যে বাহিনীতে নেওয়া হচ্ছে বিদ্রোহের প্রস্তুতি। 

বিদ্রোহের মাথাদের ধরতে অমানুষিক অত্যাচার চলে তাদের ওপর। সভ্য ব্রিটিশ জাতি দুই মহিলার ওপর বীভৎস যৌন নির্যাতন করতেও ছাড়েনি।

লাগাতার প্রায় দু'মাস পরেও তাদের খোলানো কোনোমতেই সম্ভব হলোনা। এরপর এলো সেই দিন। ৩১শে মার্চ ১৯৪৪..সকালবেলাই দুজনকে মুলুন্দ বন্দীশিবিরের খোলা মাঠে নিয়ে আসা হলো। দুই মহিলা তখন ঠিক করে দাঁড়াতে পারছিলেন না। দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল কি অকথ্য অত্যাচার না করা হয়েছে তাঁদের উপর।পরনের জামাকাপড় রক্তে ভেজা। জায়গায় জায়গায় চাপ রক্ত শুকিয়ে আছে। নিম্নাঙ্গ থেকে পা পর্যন্ত রক্ত তখনো গড়াচ্ছিল। মুখমণ্ডলের প্রায় সর্বত্র ছিল বীভৎস কামড়ের চিহ্ন। তবুও তাদের প্রখর দৃষ্টির মধ্যে হার না মানার চিহ্ন!

কোর্ট মার্শালের রায় কি হবে তাতো জানাই ছিলো। 

সশস্ত্র বাহিনীতে বিদ্রোহ ঘটিয়ে ব্রিটিশ সরকারকে উচ্ছেদ করার চেষ্টার অভিযোগে, মৃত্যুদণ্ড শোনালো তাদের সেনা আদালত। কালবৈশাখী আসার আগে প্রকৃতি যেমন অদ্ভুত শান্ত হয়ে যায়, তেমনি ভাবেই রায় শুনলো দুই সেনানী। মাথা উঁচু করে সমস্বরে শুধু একবার বলে উঠলেন, Long live our Revolution! তারপর.........

দুই বীরাঙ্গনার ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া শরীর দুটি ছিটকে পড়েছিল মুলন্দ বন্দীশিবিরের দেওয়ালে। শরীর থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত ভিজিয়ে তুললো দেশের মাটি। সেদিন তাঁরা বিদ্রোহের যে স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে ছিলেন, দু'বছর পর ১৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬ এ সেটাই দাবানল হয়ে জ্বলে উঠলো মুম্বাইয়ের মাজাগাঁও ডক ইয়ার্ডে। দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসনের ওপর নেমে এলো এক অন্তিম ও চূড়ান্ত আঘাত...শুরু হলো নৌবিদ্রোহ! 


তথ্যঋণ : শুভেন্দু মজুমদার
      ‌

No comments