Header Ads

বাঙালির ইতিহাসে এক কলঙ্কতম অধ্যায় হলো 'মরিচঝাঁপি হত্যাকাণ্ড'


খিদের জ্বালায় সেদিন অনেক মানুষকে মানুষ হয়েও ঘাস খেতে হয়েছিল৷ অনাহারে মারা গিয়েছিল চুরানব্বইটি শিশু। ১৭৭ জন মানুষকে চিকিৎসার অভাবে মারা যেতে হলো। কুড়ি থেকে ত্রিশটি শিশুর লাশ রাখা হয়েছিল এক জায়গায় লাট করে, তাদের সৎকার করা হয়নি৷ কত মানুষ আধপোড়া হয়ে পড়েছিল ঘরের মধ্যে। চব্বিশ জন মেয়েকে খাদ্য ও পাণীয় জলের জন্য ধর্ষণ করা হয়। পুলিশের গুলিতে প্রাণ যায় ত্রিশ থেকে চল্লিশ জন মানুষের। নিশ্চয় আপনাদের মনে পড়ছে ঘটনাটি৷ ১৯৭৯ সালের সেই বীভৎস ঘটনা। যার নাম 'মরিচঝাঁপি হত্যাকাণ্ড'। যা বাঙালির ইতিহাসের এক কলঙ্কতম অধ্যায়।  



নিঃশব্দে চলে গেল ৩১শে জানুয়ারি। ১৯৭৯ সালের ৩১শে জানুয়ারি সুন্দরবন অঞ্চলের মরিচঝাঁপি দ্বীপে তৎকালীন বাংলার কমিউনিস্ট সরকারের পুলিশ গুলি করে বহু মানুষকে হত্যা করেছিল৷ প্রায় তিনশোটি পরিবারের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷জ্যোতি বসুর আদেশে এমন ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। এ ঘটনাতে ঠিক কতজন মারা গিয়েছিল তা আজও সঠিক ভাবে জানা যায়নি। কমিউনিস্ট সরকারের গুলিতে দুজনের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবী করা হলেও, স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী ও ঘটনার শিকার ও বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে বলা হয় এই ঘটনাতে মৃতের সংখ্যা ছিল এক হাজারেরও বেশি। 

দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কবলে বহু উদ্বাস্তু হিন্দু বাঙালি ১৯৬৩ সালে পূর্ববঙ্গ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন৷ শোনা যায় উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হিন্দু বাঙালিরা কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করতে পারলেও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর নমঃশূদ্র হিন্দুদের পশ্চিমবঙ্গে জায়গা দেওয়া হয়নি৷ বলপূর্বক তাদের দণ্ডকারণ্যের নিরিবিলি অঞ্চলে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। 

১৯৭৭ সালে কমিউনিস্ট সরকার বাংলাতে ক্ষমতায় আসে। মার্ক্সিস্ট ফরওয়ার্ড ব্লকের তদানীন্তন রাজ্য মন্ত্রী রাম চ্যাটার্জী দণ্ডকারণ্যের ডিটেনশন ক্যাম্প পরিদর্শন করে উদ্বাস্তু নিম্নবিত্ত নমঃশূদ্র শ্রেণীর হিন্দু বাঙালিদের পশ্চিমবঙ্গে ফিরিয়ে আনার মিথ্যা প্রস্তাব দিয়েছিলেন৷ এমনকি তাদের রাজ্যের নাগরিকত্ব দেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছিলেন। এরপর সকলেই সরকারের কাছে ঋণী হয়ে দলে দলে ঘাঁটি গেড়ে বসলেন সুন্দরবন অঞ্চলের মরিচঝাঁপি দ্বীপে। তারা সকলে মিলে জঙ্গল পরিস্কার করে বন্যা থেকে বাঁচবার জন্য বাধ নির্মাণ, মৎস্য চাষ ও চাষাবাদের ব্যবস্থা করে মরিচঝাঁপিতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করতে থাকে। 

সরকারের দুই বছর গড়াতে না গড়াতেই মত পরিবর্তন করলো সরকার। শরণার্থীদের স্থায়ী বসবাস নাকচ করার উদ্দেশ্যে জ্যোতি বসু দ্বীপ উচ্ছেদ করার আদেশ দিলেন। ১৯৭৯ সালের ৩১ শে জানুয়ারি শরণার্থীদের হত্যা করার জন্য লঞ্চ করে ঝাঁক ঝাঁক পুলিশ পুরো দ্বীপকে চক্রব্যূহ আকারে ঘিরে ফেলে লাগাতার গুলি ছুঁড়তে থাকে। বহু মানুষ নৌকা নিয়ে পালাতে লাগলেন। কেউ কেউ নদীতে সাঁতার দিয়ে পালাতে লাগলো। তাদেরকেও ছাড়া হলোনা। তাদের ওপরও চললো অকথ্য অত্যাচার। পুলিশ অজস্র মানুষকে হত্যা করে তাদের লাশ নদীতে নিক্ষেপ করেছিল। 

এরকম একটি বীভৎস ভয়ংকর থেকে ভয়ংকরতম হত্যাকাণ্ড স্বাধীনতার পর বাংলাতে আর দুটে হয়েছে কিনা সন্দেহ রয়েছে। সেদিনের ঘটনার কথা আজও অনেকে ভুলতে পারেননি। এ ঘটনার শিকার হওয়া বহু পরিবার আজও সাক্ষী এ ঘটনার সাথে। সেদিন অনেক মায়ের কোল শূন্য হয়েছিল, অনেক মেয়েকে বিধবা হতে হয়েছিল, অনেক সন্তানকে পিতৃহীন ও মাতৃহীন হতে হয়েছিল৷ সেদিনের ঘটনার স্মৃতি রোমন্থন করতে গেলে আজও সেদিনের ঘটনা কাঁটা দেয় অনেক মানুষকে।

No comments