Header Ads

পুরাণ ও বাস্তব একাকার হয়ে দীঘাতে গড়ে ওঠে চন্দনেশ্বর মন্দির


যেখানে যাও লোটা কম্বল' নিয়ে পুরুষরা বেরিয়ে যেতে পারে--মেয়েরা ? নৈব নৈব চ। এমন কথা শুনতে পেলে স্ত্রীরা স্বামীকে ছেড়ে কথা বলবেন না জানি। বাক-বিতণ্ডা শুরু হয়ে যাবে। এই আমার স্ত্রী বলে উঠবেন, যা তা বলো না তো--সঙ্গে তুমি থাকবে বলেই এত লেঠা পোহাতে হয়। পুরুষদের মতো নেড়া -ন্যাংটা হয়ে তো আর মেয়েরা চলতে পারে না ! 


ওসব বাক-বিতণ্ডা থাক এখন। গাড়ি এসে গেছে। আমার সাইড ব্যাগ আর ছোট ট্রলি ব্যাগ একটা। স্ত্রীর, মানে সময়ে-অসময়ে আমায় যেগুলি টানতে হবে তা হল ৩৬ ইঞ্চি হুইলওয়ালা ব্যাগ একটা, আর একটা সাইড ব্যাগ, তা  ভরলে পরে ২৫ কিলো তো হবেই। 

দীঘার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। জবলপুর থেকে হাওড়া, তারপর হাওড়া থেকে ট্রেনে দীঘা। রাস্তা লম্বা হলেও একবার মাত্র ট্রেন বদল। মাঝখানে দীঘা অনেকবার গিয়েছি। সমুদ্র দেখেছি। ঢেউয়ের মাঝে ডুব দিয়ে মজা নিয়েছি। যতবার যাই দেখি, সমুদ্রের রূপের মাঝে রূপান্তরের শেষ নেই ! এ যে অনন্ত, নিজেকে হারিয়ে ফেলার জায়গা, অস্তিত্বকে ভুলে একাত্ম হয়ে যাওয়ার ভাবনায় মিশে যাওয়া পারে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। 

স্ত্রী বললেন, কই গো আর কবি কবি ভাব এ বয়সে মানায় না তোমায়--চলো কোথাও--

--কোথায় ?

--ওই যে এত দোকানপাট বসেছে, কিছু কেনা যায় কিনা দেখি। 

--দাঁড়াও আরেকটু দেখে নাও সমুদ্রের রূপ। 

--ও আর কত দেখব ? এই তো প্রতিবারেই এসে দেখছি। 

স্ত্রীর কথার উত্তর দিতে গিয়ে চেপে থাকলাম। তবু মনের মধ্যে উত্তরগুলি নিয়ে নাড়াচাড়া করে নিলাম। অনেক সময় এমনি ভাবেই মনকে শান্তনা দিই, তোমার দোকানপাট দেখা তো শেষ হয় না কোথাও, রামেশ্বর যাও, সিমলা হিল স্টেশনে যাও, যেখানেই দোকানপাটের জটলা সেখানেই তো তুমি হুমড়ি খেয়ে  পড়ো ! কথাগুলো জনান্তিকে আওড়ে নিয়ে একটু মানসিক শান্তি পেলাম আর কি। 

দীঘা দেখার পর একটা দিন এখানে কেটে গেল। স্ত্রী বললেন, চলো চন্দনেশ্বর মন্দির ঘুরে আসি। স্ত্রী আমার পূজা আচ্ছা নিয়ে থাকেন। মন্দির দেখলেই তার পূজা দেওয়ার ইচ্ছে হয়। আর সেই সঙ্গে কোন মানত করে বসেন। স্বামী ছেলে-মেয়ে জামাই সবাইকে সুখে রাখার এমন পূজা পদ্ধতিতে আবার আমার বিশ্বাস নেই। কিন্তু স্ত্রীর বিশ্বাসের মর্যাদা না দিলে আমার মর্যাদা থাকবে কোথায় ? অগত্যা ঠিক হল নিউ দীঘার পাশেই চন্দনেশ্বর মন্দির আছে তা দেখে আসব। যেতে হবে যখন তখন গাড়ি ঠিক করতে হল। নিউ দিঘার সমুদ্র পার থেকে চন্দনেশ্বর মন্দির বেশি দূর না। এই তিন চার কিলোমিটার হবে। চন্দনেশ্বর মন্দিরের প্রাক ইতিহাস কথার আমি একটা পাতলা বই গত বারই কিনে নিয়ে ছিলাম। স্ত্রীর অনুরোধে আমায় তাঁকে সে ইতিহাস শুনাতেও হয়েছিল। এই মুহূর্তে তার কথা আমার মনে পড়তে লাগলো--

শুনো শুনো ভক্তগন শুনো দিয়া মন,

চন্দনেশ্বরের আবির্ভাবের কথন।--এভাবেই সমস্ত বইটা পাঁচালীর আকারে লেখা। আমি গদ‍্যাকারে লিখলাম--  

সুবর্ণরেখার পারে ছিল পিপলি বন্দর। এই বন্দর থেকে তিন ক্রোশ দূরে এক ঘন বিস্তৃত বন। বাংলার পশ্চিম সীমানায় ছিল সেটা, তার দক্ষিণে ছিল সমুদ্র তার চারদিকে বিস্তৃত বালুকা রাশি। এই বনের আশপাশের লোকেরা দেখতে পেত প্রতি রাতে বনের মাঝে অজস্র প্রদীপ জ্বলে থাকে। সবাই এটা ভূতের উপদ্রব বলে ভাবতো। তারা ভীষণ ভয় পেয়ে সে দিকে যেত না। এই জঙ্গলে না না হিংস্র জন্তু জানোয়ারের বাস। বনের মাঝে ছিল বড় এক ঝর্ণা।  তার জল গড়িয়ে যেত সমুদ্রে। এই জঙ্গলে অনেক চন্দন বৃক্ষ ছিল। এই ঝর্ণার জল চন্দনের গন্ধে পরিপূর্ণ ছিল। এ জন্য সবাই এই নাম দিয়ে ছিল, চন্দন ঝর্ণা। এই জঙ্গলে নাকি অনেক ভূতেদেরও বাস সে কারণে এ জঙ্গলের অপর নাম হয়েছিল ভূতবন। 

এই ঝর্ণার জলে ফুটতো পদ্ম ফুল। ঝর্ণার জল জমে তৈরি হয়েছিল এক জলাশয়। এই জলাশয় থেকে সদাই বুদবুদ উঠে আসত। এর জল ছিল দুধের মত, বর্ণ গন্ধ সব মিলিয়ে মনে হত যেন পঞ্চামৃত। এই সব জানত শুধু এখানকার বনবাসীজন। এই ঝর্ণার পারে হোগলা জঙ্গল ছিল। 

কিছুকাল পরে লোকের নজর এলো এক মালতি বৃক্ষ। সেটি ছিল বনের দক্ষিণ দিকে, গোচারণভূমির পাশে। এই বৃক্ষের নিচে এক সন্ন্যাসী বসে ধ্যান জপ করেন। মাঝে মাঝে সে সন্ন্যাসী বনের শেষ প্রান্তের মাঠে এসে দেবতাদের বন্দনা গান করেন। সে মধুর গান বনবাসীরা শুনতে পায়। যারা শুনতে পায় তাদের দুঃখ দূর হয়ে যায়।

এই সন্ন্যাসীর মাথায় ছিল জটা। সেই জমার মাঝে যেন অর্ধচন্দ্র বিরাজ করত। তার হাতে ছিল শিবের ত্রিশূল, পরিধানে ছিল ব্যাঘ্রচর্ম। বনের মধ্যে তার অস্তিত্ব বিরাজিত ছিল কিন্তু কেউ তার দর্শন পেত না। তিনি প্রায় অদৃশ্যই থাকতেন। এখানে প্রভাতে ও সন্ধ্যায় এক ষোড়শী তরুণী তাপসীর বেশ ধারণ করে আসত। রূপে ছিল সে সুন্দরী, কামিনী, একেবারে যেন সে ছিল গৌরী সতী! শিব স্তোত্র গেয়ে সে নারী ঘুরে ঘুরে গান করে বেড়াত। সেই গান শুনতে শত শত লোক এসে হাজির হত, বনের অনেক পশুপাখিরা গান শুনতে আসত।  তারপর এক সময় সে নারী তার গান থামিয়ে সবাইকে আশীর্বাদ দিয়ে বনের মধ্যে চলে যেত। সেই নারী ও সন্ন্যাসীকে বনের নির্জনতায় কেউ কেউ নাকি ঘুরে  ফিরতে দেখেছে।

তারপর একদিন বঙ্গ নবাবের নাতি সিরাজউদ্দৌলা এই বনের দক্ষিণে ছাউনি ফেলল। সাগর দর্শনে এসে ছিলেন তিনি। চন্দন বনের পাশে তার ছাউনি লেগেছিল। ঝর্ণার পাশে এক দিন সকালে সিরাজ দেখলেন, অপূর্ব এক নারী মাঠে ঘুরেফিরে গান গাইছিল। পশুপাখিরা তাকে ঘিরে ধরেছিল। সিরাজ সে নারীর প্রতি আকর্ষীত হলেন। তিনি স্থানীয় গ্রামের মোড়লকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে তাঁর অনুচর ও  লোকজন সঙ্গে নিয়ে বনে প্রবেশ করলেন। উদেশ্য ছিল সেই নারীকে পাবার। ঝর্ণার কাছে এসে সবাই দেখল, হাজার হাজার সাপ সবাইকে ঘিরে ধরেছে। কোন মতো সেবার সবাই প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরে এলো।
সিরাজ তবু হাল ছাড়লেন না। সেই তরুণীকে পাবার জন্যে তিনি ভাবলেন দরকার হলে তোপ দেগে জঙ্গল ধূলিসাৎ করে দেবেন। সাধুকে মেরে ওই তরুণীকে তিনি নিয়ে আসবেন। ঠিক এমনি সময়, মূল পাঁচালির কথা ছিল এই রকম-- 

“নবাব আলীবর্দীর অসুস্থ খবরে,
সিরাজ গেলেন মুর্শিদাবাদ নগরে। 
ধন্য বাবা ভোলানাথ মহিমা তোমার,
ছাড় এই নিশির জ্ঞান নাহি বর্নিবার।”

মাঝখানে আমার ধ্যান ভঙ্গ হল। হঠাৎ খেয়াল হল, স্ত্রী আমার গায়ে ধাক্কা দিয়ে বলছেন, এই বোবা কালা! কার চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছো শুনি? গাড়ি থেকে নামার ইচ্ছে আছে কি নেই ?

আরে সত্যি তো দেব মহিমা স্মরণ করতে করতে সব কিছু আমি গুলিয়ে ফেলেছি--আমরা চন্দনেশ্বর মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি ! তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে এলাম। পূজা দিতেই হবে। ফুল বেলপাতা পূজা সামগ্রী নিয়ে আমরা মন্দির চত্ত্বরে প্রবেশ করলাম। দেখা মন্দির, তবু এক বছর পরের চোখে আবার তাকালাম। বেশ বড় মন্দির। মন্দির সংলগ্ন ঘরে পূর্বের দেখা সাধুবাবার দেখা মিলল। বছর ষাটের ওপরে বয়স হবে তাঁর। এই মন্দির দেখাশোনার ভার তার উপরেই ন্যাস্ত। মন্দির দর্শন করে আমি এসে সাধুবাবার সামনে বসলাম। তাঁর মুখে মন্দিরের ইতিহাস আগেই জানতে পেরেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, এই মন্দির নিয়ে লেখা আমাদের একটা বই আছে, চাইলে কিনে নিয়ে পড়তে পারেন। আমি আবার একটু একটু লিখি, ছোটখাটো কিছু একটা লেখার প্রয়াসে বইটা পঁচিশ টাকায় কিনে নিয়ে ছিলাম। 

চন্দনেশ্বর আসলে শিবের রূপান্তরিত নাম। একই প্রধান শিব ঠাকুরের বিগ্রহ এখানে স্থাপিত। অবশ্য একটু বড় মন্দির হলে প্রধান দেবতার আশপাশ জবরদখল করে নেন অন্য দেবদেবীরা। আসলে এটা মনুষ্য ভক্তের কাজ, তার সঙ্গে স্বার্থ তো জড়িত থেকেই। ছোটখাটো একটা মূর্তি বসিয়ে ধূপ ধুনো জ্বালিয়ে বসে পড়লেই হল। আমার স্ত্রীর মত ভক্ত-অনুসরণকারীর দলের অভাব হয় না। সেই মত ভাবে এখানেও বেশ কিছু দেবদেবী বাসা বেঁধে নিয়েছেন।

এবারও আমি মন্দিরের অফিস ঘরে বসে আছি। সাধু বাবার সামনে ভিড় জমে আছে। চন্দনেশ্বরের আবির্ভাবের কথা আবার আমার মনে এলো--

ঘটনা এমনি ভাবে এগিয়ে যেতে লাগলো। আলীবর্দী খাঁর মৃত্যুর পর সিরাজ হলেন বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব। নবাব হয়েও কিন্তু  তিনি সেই চন্দন বন ও  সেই সুন্দরী নারীর কথা ভোলেননি। অর্ধ লক্ষ সৈন্য নিয়ে প্রথমে কলকাতা তারপর গিয়ে হাজির হলেন সেই চন্দনবনে। মনের কামনা লিপ্সা, সেই সুন্দরী নারীকে তার চাই। আবার তাঁবু ফেললেন তিনি। চন্দন বা ভুত বনের পাশে সে দিন সেই রমণী ও সাধু একবার বেরিয়ে এসে আবার বনে প্রবেশ করে গেলেন। নবাব আর অপেক্ষায় থাকতে পারলেন না। স্থানীয় লোকজন সঙ্গে নিয়ে সৈন্যদের ডাকিয়ে আদেশ করলেন, দেখো হে সৈন্যগণ ! এই জঙ্গল কেটে সাফ করে দাও আর ওই সাধু ও কন্যাকে আমার সামনে নিয়ে আসো। অন্যথায় তোমাদের কারও কাঁধের উপর মাথা থাকবে না জেনো। এর পর কুড়ি হাজার অশ্বারোহী, বাকী সৈন ও স্থানীয় লোকজন মিলে জঙ্গল ঘিরে ফেলল। নবাবের সৈন্যরা জঙ্গলের দিকে এগিয়ে চলল। খানিক পরেই বন্য পশুরা তাদের আক্রমণ করল। শত শত বিষাক্ত নাগ তাদের দংশন করতে লাগলো। তাতে অনেক সৈন্য মৃত্যু বরণ করল। সিরাজ আরও রেগে গেলেন, এবার তিনি আদেশ দিলেন, তোমরা জঙ্গল জ্বালিয়ে দাও-- 

আগুন লাগানো হল বনে। চারদিক থেকে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো। বনের পশুপাখি সাপ ভয়ে জঙ্গল ছেড়ে পালতে  লাগল। এদিকে আকাশে মেঘ দেখা দিল, ঝড় দুর্যোগ ও বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে গেল। তাতে নবাবের বহু সৈন্য সব মারা গেল। বনের আগুন নিভে গেলো। এক পরাজিত অসহায় নবাব এমনি এক অভাবনীয় দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত হলেন। মাথা নত করলেন তিনি। মন থেকে তার ভক্তিভাব উদিত হল। যবন হয়েও তিনি সেই জঙ্গলে হিন্দু দেবদেবীর স্থাপনা করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, সেই সাধু ও রমণী আসলে কোন দেব-দেবী হবে। তিনি স্থানীয় মোড়লকে ডেকে সেই জঙ্গলে জলের বুদবুদ স্থানে পূজার ব্যবস্থা করলেন। সিরাজ পুরীর এক ভিক্ষুক আচার্য ব্রাহ্মণকে নিষ্কর ভূমিতে থাকার ও ভরণপোষণের ব্যবস্থা লিখিত ভাবে করে দিয়ে গেলেন। দেব মহিমার পাঁচালি গানে তা এমনি ভাবে বর্ণিত হয়েছে-- 

“এই বলে এ ঘটনা তাম্রের ফলকে,
সিরাজ লিখিয়া দিয়া গেলেন বৃদ্ধরে। 
ইতিহাসের পাতায় ইহা নাহি মেলে,
নবাবের সুলিখিত তাঁর ফলক বলে। 
আর বলে সেকালের তালপাতা পুঁথি। 
বাবার আবির্ভাবের কিংবদন্তি সাথী।”      

সে পুরোহিত সেখানে নিয়মিত আমরণ পূজা করে গেলেন। তাঁর মৃত্যুর পর সন্ন্যাসী ও তরুনীর আর দেখা পাওয়া গেল না। ভক্তের অভাবে সবাই কোথায় যেন চলে গেল, কেউ তা জানে না। জঙ্গল ক্রমশ গভীর ও আরও বিস্তৃত হল। এসব ঘটনার অর্ধশতাব্দীর পর লছমীর জন্ম হল। 

হঠাৎ স্মৃতি স্বপ্ন ভাঙলো আমার। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম, না, আমার স্ত্রী এখনো পূজা দিয়ে ফেরেননি। পূজা দেওয়া অবধি এক সঙ্গেই তো ছিলাম? স্ত্রীর এত দেরী হবার কারণটা কি? ও বাবা এগিয়ে গিয়ে দেখি, তিনি মন্দিরের দেয়ালে মাথা খুঁটছেন। আমি  তড়িঘড়ি তার পাশে গিয়ে পৌছালাম। বললাম, কি করছো গো  তুমি? মাথা ফেটে যাবে যে! ভক্তি চোখেও দেখলাম তিনি চোখ পাকিয়ে আমায় বললেন, নাস্তিক! 

কি জানি বাবা, তা আমি জানি না। নারকেল একটা কিনে দিয়েছিলাম মাত্র, দেবস্থানে গিয়ে আমিও উল্টোপাল্টা কিছু বলে ফেলে ছিলাম বটে। স্ত্রীকে বলেছিলাম, এবার বাবার মাথায় নারকেল  ফাটাবো? স্ত্রী গটগট করে তাকালেন আমার দিকে, বললেন, তোমার না বোধগম্য আর হবে না! 

--কেন ? 

--বাবার মাথায় নারকেল ফোঁড়ে কেউ ? 

--না মানে পাথরের তৈরি তো-- 

--বোধগম্য শূন্য, নাস্তিক একটা তুমি-- 

পাশে দাঁড়ানো বউটা আমার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন হাসলো।সে মুহূর্তে আর কথা বলিনি, নিজেকে সত্যিই বোধগম্যহীন নাস্তিক বলে মনে হয়েছিল। এই দেখুন না, এই লেখাটা লিখবো বলে বসে ছিলাম, সেই শুরু থেকেই খেই হারিয়ে ফেলেছি। আজকের বিষয়বস্তু ছিল চন্দনেশ্বর যাত্রা। 

মনে পড়লো, এক পত্রিকা থেকে কল এসেছিল, এবার একটা ভ্রমণ কাহিনী দেবেন। না, বেশি বড় করবেন না যেন ! 

এই বড় না করাটা আমার অসুবিধা হয়ে পড়ে। লেখার মধ্যে সীমানা তুলে দেওয়া ভাল লাগে না। দেশ প্রদেশ, মহাদেশ পদ জনপদ ভাগ করতে করতে শেষে লেখার মধ্যেও সীমা টানতে হবে ? 

আমার এক পরিচিত সম্পাদক লেখা চাইলেই বলেন, দেখবেন বেশি বগবগাবেন না যেন-- বাবাঃ, অবাক হই আমি। এ ভাবে বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার বেড়ে উঠলে আমরা কোন ঘাটে গিয়ে উঠব ? 
মাঝে আর এক সম্পাদক তো বলেই ফেলেছিলেন, আপনি বড় টুকলিফাই করে লিখেন। 

আমি বলি আজকাল গুগুলে টোকা মারলে কি না জানা যায় বলুন ? আমি তথ্য নিই, নিজের লিখনে--  সম্পাদক বললেন,  ওই হল--রাগ করবেন না, লেখা পাঠান, যাই হোক আপনার লেখা পাঠকেরা খুব খায়। জানি না বাবা লেখা খায়, না পড়ে ! এমনটা বলার আগেই ঝম শব্দ করে সম্পাদক ফোনের রিসিভারটা  রেখে দিলেন। এবার প্রসঙ্গে আসি, চন্দনেশ্বর মন্দিরের বাকি অংশটুকু লিখে ফেলার চেষ্টা করি-- 

সেই ভক্তি ভূমির আর এক কাহিনী-- 

ভক্ত লছমীর ইতিকথা 

সেই ভূতজঙ্গলের কিছুটা দূরেই দেহলি নামে এক তেলেনী বাস করত। সে গাভির দুধ বেচে সংসার চালাত। তার একমাত্র কন্যার নাম ছিল লছমী। সে রূপে লক্ষ্মী, গুণে গৌরী ছিল। ওদের পাশের গ্রামে ছিল বাঁকুড়ার জমিদারের এক তহশিলদার। তিনি শ্রীহরি নামে খ্যাত ছিলেন। তাঁর ঘরে লছমী দুধ দিতে যেত। শ্রীহরি তার চলন-বলন ও শ্রীমুখ দেখে বুঝতে পেরে ছিলেন যে লছমী যে সে মেয়ে নয়। লছমীর হস্তরেখা দেখে তিনি বুঝতে পেরে ছিলেন যে লছমী খুবই ভাগ্যবতী নারী। শ্রীহরি  লছমীকে বিদ্যা দান করতে চাইলেন। 

লছমীর মা বলল, আমরা গরীব--

এ কথা শুনে শ্রী হরি বিনা পয়সায় লছমীর পড়া-লেখার ভার নিলেন। কিছু দিনের মধ্যেই সব পাঠ শেষ করে, পুরাণাদি পড়তে লাগলো লছমী। এ ভাবে লছমী শিবের বড় ভক্ত হয়ে উঠলো। শিবের নাম ধাম ধ্যান স্তুতি করতে লাগলো। অহরহ জপ করতে লাগল। শিক্ষা পূর্ণ করে সে ঘরে এলো। ঘরে এসেও সে  সারাদিন শিবের জব নিয়ে ব্যস্ত থাকল। ভূত বনের পশ্চিম দিকে এক পরিবারের বাস ছিল। সেখানে পুত্র কন্যা নিয়ে তার মা বাস করত। সেই ছেলে, লক্ষণের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল লছমীর।

শ্বশুরবাড়িতে, সংসারে মন  লাগে না লছমীর। সে শিবের আরাধনায় সদা ব্যস্ত থাকে। শাশুড়ি ও ননদ তার উপরে রাগ করে। তারা একদিন লক্ষণকে নালিশ জানাল, বলল, লছমী রাতদিন শিব পূজায় ব্যস্ত থাকে-- 

লক্ষণ তখন লছমীকে ডেকে বলল, শোন লছমী, তোমার ননদ ও শাশুড়ি ঘরের সব কাজ করে, দিন ভর গাভী চরায়। তোমার কি তাদের কাজে সাহায্য করা উচিত নয় ? গুরুজনের সহায়তা করা বউয়ের ধর্ম।

স্বামীর কথা শুনেও লছমী চুপচাপ থাকে। নিত্যদিনের শিব আরাধনা তার আরও বেড়ে যায়। শাশুড়ির আদেশ, ননদের গঞ্জনা, স্বামীর আদেশ সে মানে না। শেষে শাশুড়ি তাকে মারধর করতে শুরু করে। ছেলেকে ডেকে বলে, বউকে তার বাপের বাড়ি দিয়ে যায় !

এরপর লছমীকে সারাদিনের জন্যে গাভী চরাতে হত। সে আর শিবের নাম নিতে পারে না। তবু সে ভূত বনের ধারে এক বট গাছের নিচে বসে ধ্যান জপ করা শুরু করে। গাভীরা সে সময় দূরে কোথায় চলে যায়, আবার সন্ধ্যাতে তারা চলে আসে। তখন লছমী তাদের ঘরে নিয়ে আসে। কিন্তু এবার আর এক সমস্যা দেখা গেলো। গাভীদের দুধ দোয়াতে গেলে আর দুধ পাওয়া যায় না। এবার শাশুড়ি বউকে গাভীর দুধ কোথায় যায় ? প্রশ্ন করে।

তার উত্তর দেয় না লছমী। এমনি চলে সাতদিন। গাভীর দুধ নেই, রাগে ননদ-শাশুড়ি মিলে লাঠি দিয়ে পিটাতে থাকে লছমীকে। লছমী আর সহ্য করতে পারে না। সে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে থাকে আর বলতে থাকে, আমি চোর নই ! আমি চোর নই !

শাশুড়ি বলে, আমি জানি না ওসব। তুই দগ্ধ চোরকে ধরে আনতে পারলে তবেই জানবো তুই চোর নোস। আজ থেকে তোর খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হল, তুই ঘরের ভেতর কখনও ঢুকবি না।

না খেয়ে লছমীর শরীর আর চলে না। তবু তার মাঝেই সে শিব আরাধনা করে। এ ভাবে না খেয়ে এক দিন সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইল। যখন তার জ্ঞান ফিরল সে দেখলো তার গাভীরা ভুতজঙ্গলের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। সে উঠে ধীরে ধীরে গাভীদের অনুসরণ করতে লাগলো। দুর্গম সেই চন্দন বনেই ভেতর অনেক পথ হাঁটতে হাঁটতে লছমী খুব পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ল। কাটা গাছে তার শাড়ি ছিঁড়ে গেছে, শরীর ক্ষতবিক্ষত হল। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে এল। সাঁঝের  আঁধার নামল। 

সে বনে চন্দন বৃক্ষ আছে, আছে চম্পা, নাগেশ্বর আরও কত তরুবর। চন্দনার ঝর্ণার জলাশয়ের কুলে কুলে হুগলা জঙ্গল--জায়গাটা ফুলের গন্ধে ম ম করছে। এখানে এসে থামলো লছমী। সে হঠাৎ দেখতে পেল, একটা জায়গায় ধীরে ধীরে মাটি দ্বিখন্ডিত হয়ে গেল। আর তখনই চারদিক থেকে দুন্দুভি  বেজে উঠল। বিল্ল বৃক্ষ থেকে পত্র ঝরে পড়তে লাগলো। নানা পুষ্প, চাপা, নাগেশ্বর, ধুতুরা আকাশ থেকে ঝরে পড়তে লাগলো। কোথা থেকে শঙ্খ, ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠল, ধূপধুনা গন্ধে ভরপুর হয়ে গেল চারদিক। লছমী দেখল, গাভীর বাট থেকে সেই দ্বিখন্ডিত মাটির কুণ্ডে দুধ গড়িয়ে পড়ল। তারপর এক সময় তার গাভীরা ফিরে গেল আর ধীরে ধীরে গর্তের মুখ বন্ধ হয়ে গেল। 

বৃক্ষের আড়াল থেকে সব কিছুই দেখতে পাচ্ছিল লছমী। এসব দেখে স্তম্ভিত হল সে। এ কোন দৈব ঘটনা ? বুঝতে পারল সে। সে ভাবলো, যাই হোক, এই গর্তেই আছে দুধ চোর। চোরকে ধরে নিয়ে তবেই আমি ঘরে ফিরবো। লছমী তখন দিনরাত এখানে বসে শংকর ভগবানকে ডাকতে থাকলো। কোথায় হরিহর--ভোলানাথ --কোথায় তুমি মহেশ্বর ? লছমী শংকর ভোলানাথকে ডেকেই চললো। একটা সময় এলো, তার দুঃখে বনের পশুপাখি, গাছপালা, লতাগুল্ম কেঁদে আকুল হল। এই ভাবে তিন দিন ধরে দিবানিশি সে ভোলানাথকে ডেকে চলেছে। অবশেষে সত্যি এক দিন শঙ্কর ভোলানাথ প্রকট হলেন। লছমী চোখ খুলে তাকে দেখতে পেল। আনন্দে তার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলো। প্রসন্ন হয়ে শিব বললেন, আমার কথা শোন--তোর ডাকে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। এবার বল কেন আমায় তুই এত  ডাকছিস ? 

লছমী বলল, আমায় বলে দাও বাবা দুগ্ধ চোর কে ?

--আমি সেই চোর। একথা সত্যি,আমি বহুদিন ধরে এই বনে আছি। নবাব সিরাজদুল্লা তা জানে। তুই সরল সাদাসিধে আমায় সদাসর্বদা ডাকিস, তাই না থাকতে পেরে তোকে দেখা দিয়েছি। এবার বল কি চাস তুই ?

লছমী বলল, আমি কিছুই চাই না, আমি যেন তোমায় জীবনভর ডেকে যেতে পারি।

শিব তুষ্ট হলেন, তাই হবে--আমি তোর জন্য এই কুন্ডে বাস করব। এখানে শুধু এই কুন্ডটা থাকবে। এই কুন্ডে যে দুধ জল পঞ্চামৃত দিয়ে আমার স্তুতি করবে তার মনোবাঞ্ছা পূরণ হবে। চাঁপা নাগেশ্বর ধুতুরায় আমি সন্তুষ্ট হবো। যে বেল পত্র ফুলে আমায় অভিষিক্ত করবে তার মনোবাঞ্ছা অবশ্যই পূর্ণ হবে। 

আমার আশীর্বাদে নিঃসন্তান সন্তান পাবে, দুরারোগ্য রোগ মুক্ত হবে, মূর্খরা পণ্ডিত হবে, কন্যারা যোগ্য স্বামী পাবে। আমার মহিমা সব ভক্ত প্রচার করবে। আমার মহিমা যারা মধুর ভাষায় বর্ণনা করবে, শুদ্ধ মনে মুক্ত হয়ে পাঠ করবে, তাদের সবার জন্য আমি চন্দনেশ্বরে বিরাজ করব। চন্দনেশ্বর বললেন--

"হুগলা বনেতে পীঠ তাই তীর্থ নাম
হবে খ্যাত  হুগলি চন্দনেশ্বর ধাম।"

এদিকে লছমীর স্বামী শাশুড়ি ননদ তিন দিন ধরে লছমীকে খুঁজে খুঁজে অস্থির হয়ে গেল। কোথাও তারা তাকে পেলো না। এবার মহেশ্বর লছমীর শাশুড়িকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে সব ঘটনা খুলে বললেন, তোমরা অযথা লছমীকে গঞ্জনা দিয়েছো। আসলে দুগ্ধ চোর তো ছিলাম আমি। লছমী আমার পরম ভক্ত। ওকে তোমরা ঘরে নিয়ে যাও !

সব জানতে পেরে শাশুড়ি ছেলে ননদ বনে এসে উপস্থিত হল। তারা দেখল, লছমী সেই শিব স্থানের কুন্ডের পাশে তখনও ধ্যানস্থ বসে আছে। ওরা সমাদরে লছমীকে ঘরে নিয়ে এল। 

তারপর থেকে এখানকার জঙ্গল ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে গেল। বহু ভক্ত পণ্ডিতদের সমাগম হল এখানে। কালক্রমে এখানে স্থাপনা হল মন্দির--বাবা চন্দনেশ্বরের মন্দির। সে সঙ্গে পান্থশালা, বিশ্রাম ভবন তৈরি হল। সমস্ত বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা থেকে ভক্তরা এখানে এসে পূজা দিয়ে যার যার মনের শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। 

No comments