Header Ads

জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. রমাতোষ সরকার যিনি বাংলার মাটি থেকেই আকাশকে চিনিয়েছেন



আমাদের এই বাংলা জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক পীঠস্থান বলা যায়।নানা জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তির আবির্ভাবে এই বাংলা সমৃদ্ধশীল হয়েছে।বাংলার মাটি থেকেই আকাশকে চিনিয়েছেন বাংলার অনেক খ্যাতনামা জ্যোতির্বিজ্ঞানী। ড. রমাতোষ সরকার তাঁদের মধ্যে অন্যতম।গত ১৫ই ফেব্রুয়ারী আমরা এই মহান জ্যোতির্বিজ্ঞানীর ৯০তম জন্মবার্ষিকী পেরিয়ে এলাম।ড.রমাতোষ সরকার ১৯৩০ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী কলকাতার নিকটবর্তী দক্ষিণ ২৪ পরগনা মগরাহাটে জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতার নাম রবতোষ সরকার ও মাতার নাম রাধারাণী দেবী।

রমাতোষ সরকার লেখাপড়া করেছিলেন কলকাতার বেলেঘাটার নারকেলডাঙ্গা জর্জ হাইস্কুলে।বর্তমানে এই স্কুলের নাম নারকেলডাঙ্গা হাইস্কুল।সেখান থেকে ম্যাট্রিক(এখনকার মাধ্যমিক)পাস করে তিনি ভর্তি হন সুরেন্দ্রনাথ কলেজে।এরপর গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।তিনি এরপর অধ্যাপনা করেছিলেন নরসিংহ দত্ত কলেজে এবং সেন্ট পলস কলেজে।১৯৬৭ সালে তিনি ইউনিফায়েড ফিল্ড থিয়োরীর ওপর গবেষণা করে ডক্টরেট বা পি.এইচ.ডি. লাভ করেন।তিনি ১৯৬২সালে যোগ দেন বিড়লা প্লানেটেরিইয়ামের সাথে। বর্তমানে জ্যোতির্বিজ্ঞানের এই সুপ্রসিদ্ধ সংস্থার নাম এম.পি. বিড়লা প্ল্যানেটেরিয়াম।তিনি সেখানে যোগদান করার সাথে সাথেই চালু করেনফ্রি ইভিনিং কোর্স অফ অ্যাস্ট্রোনমি। এই কোর্সের উদ্দেশ্য ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানের কথাকে সাধারণ মানুষের বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে প্রচার করা ও তাদের বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলা এর সাথে জ্যোতির্বিজ্ঞানের তত্ত্বকে সাধারণ মানুষের বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে প্রচার করা ও তাদের বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলা।এর সাথে জ্যোতির্বিজ্ঞানে সাধারণ মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি ঘটানো এবং ফলিত জ্যোতিষ শাস্ত্রের অবৈজ্ঞানিক ও অপ্রাসঙ্গিক দিকগুলি সম্পর্কে সচেতন করাও উল্লিখিত কোর্সটির উদ্দেশ্য ছিল। 



সেই প্রথম দিন থেকেই আমৃত্যু তিনি ছিলেন এই কোর্সের শিক্ষক।এই কোর্সটির ক্লাস  দুটি ব্যাচে মঙ্গলবার ও শুক্রবার করে সারা বছর ধরে হত।কোর্স শেষে সার্টিফিকেট পেতেন শিক্ষার্থীরা।এখনও অবশ্য এই কোর্সটি এম.পি. বিড়লা প্ল্যানেটেরিয়ামে পড়ানো হয়।কুড়ি থেকে আশি সবাই ছিল ড. সরকারের ছাত্র-ছাত্রী।সব বয়সের সব স্তরের মানুষও এই কোর্সটি পড়তে আসতেন।ড. সরকারের মোট ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা কয়েক হাজার তো হবেই!তিনি জীবনের শেষের দিকে ওই সংস্থার কিউরেটর হয়েছিলেন।তিনি ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানের এক মস্ত বড়ো পণ্ডিত।জ্যোতির্বিজ্ঞানে তাঁর ছিল ছিল এক সুগভীর জ্ঞান।আসলে তাঁর জীবনটাই যেন ছিল আকাশ দিয়ে ঘেরা।ছাত্র-ছাত্রীদের জ্যোতির্বিজ্ঞানের যে-কোনো সমস্যার সমাধান মানেই ড. রমাতোষ সরকার।আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু, ড.মেঘনাদ সাহার যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন এই বিজ্ঞানী।জ্যোতির্বিজ্ঞানকে আকাশ থেকে নামিয়ে বাঙালি পাঠকের মাঝে এনে দেওয়ার অপরিসীম ক্ষমতা ছিল তাঁর।তিনি বাংলায় আজীবন বিজ্ঞান চর্চা করে গেছেন।জ্যোতির্বিজ্ঞানের বেশিরভাগ প্রবন্ধ লিখেছেন বাংলায়।তাঁর  জ্যোতির্বিজ্ঞানের বইগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য-মহাবিশ্ব’, ‘মহাকাশ’, ‘জ্যোতির্বিজ্ঞান’, ‘প্রাচীন ভারতের গণিত চিন্তাইত্যাদি।জ্যোতির্বিজ্ঞানে তাঁর অসংখ্য প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে নানা পত্র-পত্রিকায়। বাংলার পাশাপাশি লিখেছেন ইংরেজিতেও।ইংরেজিতে তাঁর লেখা রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর জীবনী উল্লেখযোগ্য। ভাষার প্রতি সজাগ ও সঠিক শব্দ প্রয়োগের প্রতি সর্বদা সতর্ক থাকতেন।লেখাটির ভাষা তাঁর মনমতো হচ্ছে কিনা তা দেখতেন।অর্থাৎ বিজ্ঞানীর পাশাপাশি একজন সাহিত্যিকেরও গুণ তাঁর মধ্যে ছিল।আর সেজন্যই তিনি সাহিত্যের সাথে বিজ্ঞানকে বা বিজ্ঞানের সাথে সাহিত্যকে মেলাতে পারতেন।জ্যোতির্বিজ্ঞান ছাড়াও অন্যান্য বিষয়েও তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল।রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন।পত্নজ্যোতির্বিজ্ঞান ও ভাষাবিজ্ঞানে তাঁর ছিল অগাধ জ্ঞান।জ্যোতির্বিজ্ঞানে অবদানের জন্য তিনিফেলো অফ রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটিবা এফ.আর.এস. নির্বাচিত হয়েছিলেন। বর্ধমানের তারামণ্ডল স্থাপনের কাজেও তাঁর যথেষ্ট অবদান রয়েছে।

জ্যোতির্বিজ্ঞানে তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল পত্নজ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাস।জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণামূলক পত্র বা  প্রবন্ধ পাঠ করেছেন ভারতের বিভিন্ন জায়গায় এবং ভারতের বাইরে আমেরিকা, চীন, ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে।ড. সরকার বিজ্ঞানমনস্ক যেমন ছিলেন তেমনি ছিলেন সাম্যবাদী।বিজ্ঞান চর্চায়  অবদানের জন্য তিনি লাভ করেছেনজ্ঞান ও বিজ্ঞান পুরস্কারএবংসত্যেন্দ্রনাথ বসু পুরস্কার

এবার জেনে নিই,মাস্টারমশাই হিসেবে ড. রমাতোষ সরকার কেমন ছিলেনছাত্র-ছাত্রীদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো, পিতার মতো।তিনি ছিলেন ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি অসীম স্নেহশীল।অথচ ছিলেন বড়োই কঠোর, কোনোরকম বেয়াদপি বা অন্যায় সহ্য করতেন না।সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীর জীবনপঞ্জী তিনি মনে রাখতেন তাঁর প্রখর স্মৃতিশক্তির দরুন।জানা যায়, কোনো ছাত্রছাত্রী অসুস্থ হলে তিনি বড়োই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতেন এবং বারংবার টেলিফোন বা লোকের মারফতে (তখন তো আর মোবাইল ছিল না) খবর নিতেন। আবার, ছাত্র-ছাত্রীদের লেখার গঠনমূলক সমালোচনাও করেছেন।কারুর কোনো কিছুর ব্যাপারে কোনো বক্তব্য পরিষ্কার না হলে অসন্তোষ প্রকাশ করতেন।বরাবর সত্য ও আসল কথাটা বলতে ভালোবাসতেন।কোনো ছাত্র-ছাত্রী বা তাদের সন্তানেরা কোথাও সফলতা লাভ করলে তিনি তাদের সবাইকে ডেকে প্রশংসা করতেন।তখন তাঁর মধ্যে অনেকটা ঠিক যেন শিশুর মতো সরলতা প্রকাশ পেত।যেকোনো জিজ্ঞাস্য বা আলোচনার জন্যে কলকাতার ল্যান্সডাউন রোডের ফ্ল্যাটে তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যে সর্বদাই দ্বার উন্মোচন করা থাকত।তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা ছিল যেন তাঁর পরিবারের সদস্য।তিনি তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে ছিলেন পিতা,বন্ধু ও শিক্ষকের সমাহার- যেন এক সত্যিকরেরমাস্টারমশাই। তিনি ছিলেন তাঁর শিক্ষকতা ও আন্তরিকতার গুণে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে এক অতিপ্রিয় শ্রদ্ধেয় শিক্ষক।

বছর কুড়ি আগের কথা- ১২ই জুলাই,১৯৯৯।বিজ্ঞান জগতে নেমে এল এক শোকের দিন।এই বিজ্ঞান সাধক, বিজ্ঞান কর্মীর জীবনতারা ৬৯ বছর বয়সে নিভে যায়।ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তো বটেই এমনকি সমস্ত মানুষের কাছে তিনি অতিপ্রিয় ছিলেন।তাঁর সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীরা সেদিন তাঁদের প্রিয় শিক্ষককে হারানোর শোকে কেঁদে উঠেছিলেন।তিনি রেখে গেলেন তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী দীপা সরকার, দুই কন্যা শ্রবণা ও শতভিষাকে আর রেখে গেছেন ভবিষ্যৎ জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার জন্যে  তাঁর অগণিত উত্তরসূরিদের ও অসংখ্য জ্যোর্বিজ্ঞানের লেখা এবং এক আদর্শ শিক্ষকের জীবন্ত উদাহরণ। 

প্রতি বছরই বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ এই মহান বিজ্ঞানীর নামাঙ্কিত "রমাতোষ সরকার স্মৃতি বক্তৃতা'র আয়োজন করে। 


ঋণঃএনবিএ প্রকাশিত . রমাতোষ সরকার রচিতমহাবিশ্বগ্রন্থটি বিশেষ করে . সরকারের ছাত্র .শংকর কুমার নাথ রচিত ভূমিকাটির প্রতি লেখক আন্তরিকভাবেই কৃতজ্ঞ


No comments