Header Ads

জালিয়ানওয়ালাবাগের চেয়ে কোন অংশে কম ভয়ংকর ছিলনা 'মরিচঝাঁপি হত্যাকাণ্ড'


২৫শে জানুয়ারী, ১৯৭৫। দণ্ডকারণ্যের মালকানগিরির জনসভায় এক বামফ্রন্ট নেতা আবেগঘন গলায় বক্তব্য রাখছেন, শ্রোতা পূর্ববঙ্গ থেকে ছিন্নমূল কয়েক হাজার বাঙালি উদ্বাস্তু। তিনি বলেছিলেন,ওরে অবুঝ তোরা বাংলায় ফিরে আয়..পশ্চিমবঙ্গের পাঁচ কোটি মানুষ দশকোটি হাত তুলে তোদের স্বাগত জানাবে!


এলো ১৯৭৭, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় এলো বামফ্রন্ট। বোকা উদ্বাস্তুরা আনন্দে  উদ্বেল হয়ে উঠলো। ঘটিবাটি বিক্রি করে রওয়ানা হলো কলকাতার দিকে, তাদের স্বপ্নের এলডোরাডো! 

আটাত্তরের মার্চ মাস অব্দি দণ্ডকারণ্য থেকে প্রায় দেড় লাখ উদ্বাস্তু পা রাখলো পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে। কিন্তু সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ভিন্ন এক বাস্তবতা। নির্বাচনের আগের বামফ্রন্ট আর ক্ষমতাসীন বামফ্রন্টের কথাবার্তায় বিস্তর ফারাক। 

কে কোথায় কি বলেছে তাই শুনেই চলে আসতে হবে নাকি ?

পুলিশ পিটিয়ে খেদালো অনেককে, মাথাদের জেলে পুরলো। ভাঙ্গা মন নিয়ে অনেকেই আবার ফিরে গেলো কিন্তু বাঙালের গোঁ..মরিয়া কয়েক হাজার  পরিবার মাটি কামড়ে থেকে গেলো।

উদ্বাস্তু সমিতি আগেই বাম নেতাদের কথামতো বসত গড়ার জায়গা ঠিক করে রেখেছিল।কলকাতা থেকে আশি কিলোমিটার দূরে সুন্দরবনের লাগোয়া ১২৫ বর্গকিমির এক দ্বীপ.....মরিচঝাঁপি। আটাত্তরের মাঝামাঝি সেখানেই আশ্রয় নিল ত্রিশ হাজার সর্বহারা মানুষ। মন্ত্রীসভা থেকে পরিষ্কার  জানিয়ে দেয়া হলো, যাচ্ছো যাও কিন্ত কোনরকম সরকারি সহায়তা পাবে না!

পাল্টা তারাও জানালো, বাঘের হাতে মরবো তবুও এখান থেকে নড়বো না। তোমরা সহায়তা না করো ঠিক আছে, বাঁধা দিও না।

সাত মাসের নিরলস পরিশ্রমে সোনা ফলালো তারা। বাদা জমিকে চাষযোগ্য করে ফলাতে লাগলো ধান ও নানান শাকসব্জি, ভেড়ি বানিয়ে শুরু করলো মাছচাষ। অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বাবলম্বী হবার পর নিজেরাই বানিয়ে নিল রাস্তাঘাট ইস্কুল। গণমাধ্যমে উঠে এলো তাদের সাফল্যের কাহিনী।

আঘাত লাগলো বাম মন্ত্রীদের। কোনরকম সাহায্য ছাড়াই একদল অশিক্ষিত ছোটলোক কি করে এ রাজ্যে স্বাবলম্বী হয়ে উঠলো? এতো বাজে উদাহরণ হয়ে থাকবে!   মন্ত্রীসভার এক অধিবেশনে ঠিক হলো উদ্বাস্তুদের ঐ দ্বীপ থেকে সরে যেতে হবে। কারণ.....ওটা নাকি সুন্দরবনের কোর এরিয়ার মধ্যে পড়ে।বাঘ সংরক্ষণে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে ঐ জনপদ। প্রয়োজনে করতে হবে বলপ্রয়োগ!

৭৯ এর জানুয়ারী থেকেই শুরু হলো উৎখাতের প্রথম পর্যায়। ৩০ টি লঞ্চ দিয়ে মরিচঝাঁপি ঘিরে ফেলা হলো। উদ্বাস্তুদের নৌকা ভেড়ি এমনকি টিউবওয়েল অব্দি নষ্ট করে দেওয়া হলো। বাইরে থেকে সাঁতরে রসদ আনার চেষ্টা করে গুলি খেয়ে মরলো বত্রিশ জন যুবক। বৃষ্টির জল ধরে রাখার জন্য যে জলাধার বানানো হয়েছিল তাতেও ঢেলে দেয়া হলো ফলিডল। জল ও খাবার না পেয়ে রোজ মরতে লাগলো শয়ে শয়ে মানুষ। এ খবর যাতে বাইরে না আসতে পারে তার জন্য  দ্বীপে যাওয়া নিষিদ্ধ হলো মিডিয়ার।

মানবিকতার এই বিপন্ন রূপ দেখে যারাই সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন, বাঁধা দিয়েছিল সরকার। মাদার টেরেসা অব্দি মিডিয়াকে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, Sorry we can't go, neither we explain why we can't....! 

তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সংবাদপত্রে বিবৃতি দিলেন,   তার কাছে পাকা খবর আছে রাজ্যে অশান্তি সৃষ্টির জন্য  উদ্বাস্তুদের আড়ালে কিছু বাংলাদেশীকে নিয়ে CIA চক্রান্ত চালাচ্ছে। তাদের সশস্ত্র ট্রেনিংও দেওয়া হচ্ছে। আমরা সমূলে এদের বিনষ্ট করবো।

মে মাসের শুরুতেই চূড়ান্ত আঘাত হানলো সরকার। আশেপাশের দ্বীপগুলোকে হুঁশিয়ারী দেওয়া হলো। এতদিন যা করেছো, ঠিক আছে আর কোন সাহায্য নয়। এলো ১৩ই মে .....নরক নেমে এলো ঐ দ্বীপে। সূর্য ডুবতেই পুলিশের সাথে পার্টির ক্যাডাররাও শুরু করলো লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ। অসহায় মানুষগুলো যখন ডিঙি নিয়ে পালাচ্ছিল তখন তার ওপর তুলে দেওয়া হলো লঞ্চ। আগুনে পুড়ে কত যে শিশু মারা গেল তার ইয়ত্তা নেই।লাশ গুম করার জন্য দেওয়া হয়েছিল নগদ পুরস্কার।

অবশেষে সাফ মরিচঝাঁপি। গোটা দ্বীপে একটাও স্থাপনা রইলো না যা দাঁড়িয়ে আছে .... ধ্বংসস্তুপ কথাটার আক্ষরিক এক প্রদর্শনী! পোড়া ছাইয়ের মধ্যে কোথাও উঁকি মারছে রোস্ট হয়ে যাওয়া ছোট্ট লাশ।

সাংবাদিক তুষার ভট্টাচার্যের সমীক্ষা অনুযায়ী জানুয়ারী থেকে শুরু হওয়া অবরোধের ফলে অনাহারে দেড়শো ও বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে ১৭৭ জন শিশু। ধর্ষিতার সংখ্যা ৪৪ ও খুন হয়েছে ২৪০ জন নারী।আহত পুরুষের সংখ্যা দুশো ও নিখোঁজ চারশো।জেলে গেছে আরও পাঁচশো জন .....! অন্য সূত্রে সংখ্যাটা কয়েকগুন বেশি! 

তারপর ....তারপর আবার কি? সব হারিয়ে নিঃস্ব রিক্ত মানুষগুলোর কেউ ফিরে গেছে দণ্ডকারণ্যে কেউবা হারিয়ে গেছে এদেশের বিশাল জনারণ্যে। স্বজন হারা যুবতী মেয়েরা বহু হাত ঘুরে অবশেষে থিতু  হলো মহানগরীর অন্ধকার গলিতে...শেষ পর্যন্ত দীর্ঘজীবি হলো বিপ্লব!

No comments