Header Ads

নিষিদ্ধ দেশে এক বঙ্গসন্তান। পন্ডিত না গুপ্তচর?


সালটা ১৮৮২, মে মাসের এক বিকেলে দুর্গম পথ পেরিয়ে তিব্বতের রাজধানী লাসায় ঘোড়ার পিঠে চেপে পৌঁছাল একটি দল। দলে আছে মালবাহক ও তিব্বতি লামারা, আর আছে লামার পোশাক-পরা লাল পাগড়ি চোখে সানগ্লাসে এক ভিনদেশি। ক্লান্তিতে মাঝে মাঝে নুয়ে পড়ছে সে। চিনে পেস্ট্রির দোকানে জমায়েত হওয়া ভিড়টা তাকে দেখে মন্তব্য করল, ‘দেখেছ আবার এক বসন্ত রোগী এসে হাজির হয়েছে।' 


তারা জানে না লাল পাগড়ি ভিনদেশির সঙ্গে আছে রিভলভার, কম্পাস, সেটস্কোয়ার ও হরেক কাগজ। তিব্বতি ভাষায় সুদক্ষ মানুষটি বিভিন্ন মঠ থেকে খুঁজে পাওয়া পুঁথি অনুবাদ করে নিয়ে যাবেন তার দেশে।

তিব্বতি সংস্কৃতি ও জনজীবনে আগ্রহী এই বাবুটি  আরো একটি কাজ করছেন। চলার পথে প্রতিটি পাহাড়, নদীনালা ও ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্য কাগজে লিখে নিয়েছেন, লাসায় আসার পথে চুম্বি উপত্যকা, ‘ইয়ামদ্রোক সো’ হ্রদে ঝটিতি জরিপ করেছেন। টুকে নিয়েছেন কাঞ্চনজঙ্ঘা এলাকার হরেক পাহাড় ও পথের পরিচয়। সেগুলি ভারত সরকারের দফতরে গোপনে বাক্সবন্দি হবে।পরে বৃটিশ সেনাপতি ইয়ংহাজব্যান্ড এই তথ্যের ওপর নির্ভর করেই তিব্বত দখলের অভিযানে বেরুবেন।

ভিনদেশি ছিলেন এক বঙ্গসন্তান...শরৎচন্দ্র দাস। তাঁর পরিচয় নিয়ে কয়েক বছর পরেও তিব্বতে ঘোর ধোঁয়াশা।যে তিব্বতি লামারা তাঁকে সাহায্য করেছিলেন, সকলকেই পরবর্তী কালে এক ধার থেকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। শরৎচন্দ্র দাস তবে ঠিক কি ছিলেন....পণ্ডিত? দুর্গম পথের অভিযাত্রী? না কি এক গুপ্তচর?

লাসা সফরের তিন বছর পর এই রহস্যময় চরিত্রটিকে দেখা গেল চিনের রাজধানী পিকিং শহরে।সেখানে বাণিজ্যের খোঁজে আসা তিব্বতিরা তাঁকে ‘কা চে লামা’ বা কাশ্মীরের লামা বলে ডাকেন। শরৎচন্দ্র দাসের সঙ্গে অবশ্য কাশ্মীরের কোনও সম্পর্ক নেই, তিনি এসেছেন কোলম্যান মেকলে নামে এক ব্রিটিশ কূটনীতিককে সাহায্য করতে। কোলম্যান লাসা শহরে ব্রিটিশ দূতাবাস খুলতে যাবেন, পিকিং শহরে তাই ঘাঁটি গেড়ে বসে আছেন। চিনের রাজধানীতে বাঙালি শরৎচন্দ্র দাস এ বিষয়ে তাঁর প্রধান সাহায্যকারী।

দূতাবাস খোলা আর হয়নি। কিন্তু শরৎচন্দ্র দাসের পরিশ্রমী তথ্য থেকে ব্রিটিশরা এ ভাবেই নানা সাহায্য পেয়েছে। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘রায়বাহাদুর’ ও ‘অর্ডার অব ইন্ডিয়ান এম্পায়ার’-এ ভূষিত করেছে। হিমালয়ের খুঁটিনাটি অজানা ভৌগোলিক তথ্য আবিষ্কারের জন্য সম্মানিত করেছে লন্ডনের রয়্যাল জিয়োগ্রাফিক সোসাইটি।

আবার, কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকায় এই গুপ্তচরের লেখালিখি খুলে দিয়েছে তিব্বত ও বৌদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার নতুন দিগন্ত। নিজেই তৈরি করেছেন তিব্বতি-ইংরেজি ভাষার অভিধান। থাইল্যান্ডে গিয়েছেন, বৌদ্ধ শাস্ত্রচর্চার জন্য খেতাব দিয়েছেন সেখানকার রাজা। মৃত্যুর দু’বছর আগেও বৌদ্ধ শাস্ত্র ও সংস্কৃতি ঘাঁটতে কয়েক মাসের জন্য পাড়ি দিয়েছেন জাপান। উনিশ শতকেই তিব্বতচর্চার জন্য সারা পৃথিবীর কুর্নিশ আদায় করে নিয়েছেন এই বাঙালি।

এই পণ্ডিত গুপ্তচর আদতে চট্টগ্রামের আলমপুর গ্রামের লোক। ১৮৪৯ সালে তাঁর জন্ম। ছাত্র হিসাবে মেধাবী, উদ্ভিদবিজ্ঞান থেকে জ্যোতির্বিদ্যা, হরেক বিষয়েই তাঁর আগ্রহ। স্কুল শেষে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনার জন্য ভর্তি হয়েছেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেখানে তখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো হত। বাদ সাধল  ম্যালেরিয়া। ১৮৭৪ সালে ফাইনাল পরীক্ষার সময় অসুস্থ হলেন শরৎচন্দ্র, সারা ক্ষণই ঠকঠকে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর। বাঁচিয়ে দিলেন উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক সি বি ক্লার্ক।দার্জিলিঙের ডেপুটি কমিশনার স্যার জন এডগার তত দিনে সেখানকার শিশুদের লেখাপড়ার জন্য ভুটিয়া বোর্ডিং স্কুল তৈরি করেছেন। ক্লার্ক সেখানকার প্রধান শিক্ষক হওয়ার প্রস্তাব দিলেন ছাত্রকে। শরৎচন্দ্র প্রথমে দোনোমোনো করছিলেন। তার পর ভেবেচিন্তে, পাহাড়ি জলহাওয়ায় স্বাস্থ্য উদ্ধার হবে ভেবে সায় দিলেন।

স্কুলের ছাত্ররা না বোঝে বাংলা না ইংরেজি। এদিকে হেডমাস্টারমশাইও তাদের ভাষা বোঝেন না। কিন্তু আগ্রহী মানুষটি আস্তে আস্তে রপ্ত করে ফেললেন তাদের ভাষা। সিকিমের তৎকালীন রাজা, মন্ত্রী, অমাত্যরাও ইংরেজি শেখাতে তাঁদের ছেলেদের পাঠাচ্ছেন ভুটিয়া বোর্ডিং স্কুলে।

দু’বছর পরে হেডমাস্টারমশাই ছুটিতে ছাত্রদের এক্সকারশনে নিয়ে গেলেন পাশের দেশ সিকিমে, পেমিয়াংচি মঠে।

১৮৭৯ সালে এই পেমিয়াংচি মঠের লামা উগ্যেন গিয়াতসো-কে নিয়ে তিব্বতে পাঞ্চেন লামার তাশি লুনপো মঠে পৌঁছলেন শরৎচন্দ্র। সেখানে পাঞ্চেন লামার প্রধান সহকারী, তাশি লামা হিন্দি ও ইংরেজি শিখতে চান, সিকিমবাসী তিব্বতি বৌদ্ধ উগ্যেন সেই সূত্র ধরে সহজেই জোগাড় করে ফেললেন তাঁর ও শরৎচন্দ্র দাসের তিব্বত যাত্রার অনুমতি।

দার্জিলিং থেকে পেমিয়াংচি, তারপর কাঞ্চনজঙ্ঘা ধরে জোংরি। সেখান থেকে চাং থাং গিরিপথ। বরফে পা ডুবে যাচ্ছে, এক এক জায়গায় উগ্যেন কোমরের কুকরি দিয়ে বরফ কেটে তৈরি করছেন পায়ে চলার ধাপ।গাছের শাখাপ্রশাখা কেটে তৈরি করছেন রাস্তা। ঝুরো পাথর নেমে আসছে, ১৯০০০ ফুট উচ্চতায় দুজনেরই নিশ্বাস পড়ছে ঘন ঘন। রাতে থাকার জায়গা বলতে পাহাড়ি গুহা। চাং থাং পেরিয়ে এ ভাবেই ওঁরা ঢুকে এসেছেন তিব্বতি সীমানার মধ্যে।

তিব্বতি সংস্কৃতিতে আগ্রহী শরৎচন্দ্র সে যাত্রায় প্রায় ছয় মাস ছিলেন পাঞ্চেন লামার তাশি লুনপো মঠে। নিয়ে এসেছেন ভারতে হারিয়ে-যাওয়া নানা বৌদ্ধ গ্রন্থের অনুলিপি। তারই মধ্যে ব্রিটিশ সরকারকে জানাচ্ছেন দেশটা নিয়ে হরেক তথ্য। ভারতের তৎকালীন সার্ভেয়ার জেনারেল, বাবু শরৎচন্দ্র দাসের পাঠানো রিপোর্ট সম্বন্ধে লিখছেন, ‘ওঁর পাঠানো প্রতিটি তথ্য মূল্যবান, মানচিত্র তৈরিতে কাজে দেবে।’ অচেনা দেশকে জানতে গেলে দখল করতে গেলে প্রথমেই দরকার তার মানচিত্র। ব্রিটিশ সরকার শরৎচন্দ্রকে তাদের মতো ব্যবহার করছে। আবার শরৎচন্দ্র গুপ্তচরবৃত্তির ফাঁকে জেনে নিচ্ছেন বৌদ্ধ ধর্মের হরেক তথ্য, নিয়ে আসছেন তিব্বতি ভাষায় লেখা বিভিন্ন সংস্কৃত পুঁথি। এই সব পুঁথিপত্র সংগ্রহ তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগের ফল, সরকারের এ বিষয়ে কোনও মাথাব্যথা ছিলো না।

দু’বছর বাদে শুক্লপক্ষের এক রাতে ফের দার্জিলিং থেকে রওনা দিলেন শরৎচন্দ্র ও উগ্যেন। এ বার ১৪ মাসের সফর। তাশি লুনপোয় ফের পরিচিতদের সঙ্গে দেখা। দেখা গেল, পাঞ্চেন লামার দরবারে এক মন্ত্রীর বউ সিকিমের রাজকন্যা। মেয়েরা নাচগানে অভ্যর্থনা জানালো পরিচিত অতিথিদের।

পাঞ্জাবকেশরী রণজিৎ সিংহ একবার তিব্বত দখলের প্রবল চেষ্টা চালিয়েছিলেন।শেষ পর্যন্ত তিব্বতি ও চিনা সৈন্যরা এই তাশি লুনপায় শিখদের পরাস্ত করে। সেখানে পাঁচ মাস থেকে শরৎচন্দ্র পৌঁছান এ বার লাসা শহরে। 

দু’মাস লাসায় থাকতে থাকতে ১০ই জুন সকালে পরিচিত এক তিব্বতি লামা তাঁকে নিয়ে গেলেন পোতালা প্রাসাদের অভ্যন্তরে, দলাই লামার দর্শনে। বিশাল হলঘরের প্রতিটি আসবাবে সোনার আবরণ। ছয় ফুট লম্বা, চার ফুট উঁচু সিংহাসনে বাবু হয়ে, করজোড়ে বসে তখনকার আট বছর বয়সী শিশু ত্রয়োদশ দলাই লামা। মাথায় হলুদ চাদর। সোনার বাটিতে জাফরান মেশানো হলুদরাঙা জল নিয়ে এক জন এগিয়ে গেল সেই শিশুর কাছে। তিনি উচ্চারণ করলেন, ‘ওম মণিপদ্মে হুম।’ তার পর লামার সোনার কাপে মাখন চা ঢেলে দিলেন এক জন, শরৎচন্দ্র প্রণামী হিসেবে শিশুর কোলে রেখে দিলেন এক তোলা সোনা। এ বার সোনার বাটিতে চাল নিয়ে এগিয়ে এলেন এক জন, শিশু লামা সমবেত অতিথিদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন সেটি। বেরিয়ে আসার সময় শরৎচন্দ্রকে এক লামা পরিয়ে দিলেন লাল রঙের খাদা বা চাদর। ঘটনার বিবরণ দিতে দিতে প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন ছাত্র শরৎচন্দ্র এ কথাও লিখেছেন, ‘ফুটফুটে শিশুটির চোখে যেন ক্লান্তির ছাপ। রোজ রাজসভার এই বাঁধাধরা রিচ্যুয়াল, ধর্মীয় আচার নিশ্চয় ক্লান্ত করে তাকে!’ তখন কে জানতো পরবর্তী একশো বছরের মধ্যে এই শিশু লামার উত্তরসূরি চতুর্দশ দলাই লামা চিনের হাত থেকে বাঁচতে শরৎচন্দ্রের দেশ ভারতেই স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে আসবেন ?

দুর্গম এই সফর পণ্ডিত গুপ্তচরকে কখনও ক্লান্ত করেছে, কখনও বা হতবাক। দেখেছেন নীল পোশাকে, ঘোড়ায় চড়া ‘তেসি’-দেরও। তেসি-রা এক রকমের কুরিয়ার, হলুদ ব্যাগে চিঠিপত্র ও দলিল দস্তাবেজ নিয়ে লাসা-পিকিং যাতায়াত করেন। এই ঘোড়সওয়ার বা ডাকহরকরাদের ছিল অন্যরকম খাতির। লাসা ভ্রমণের এ রকমই সব বিবরণ লিখে গিয়েছেন এই পণ্ডিত গুপ্তচর তার লেখা "A journey to Lhasa and Central Tibet" গ্রন্থে।

সে যাত্রা লাসা থেকে ফেরার পর আর তিব্বতে ঢোকার অনুমতি তিনি পাননি। কিন্তু হিমালয়ের গহনে সেই দুর্গম দেশটিকে কোনও দিনই ভুলতে পারেননি তিনি। বাড়ি করলেন দার্জিলিঙে, নাম রাখলেন ‘লাসা ভিলা।’ সেখানেই থাকত তিব্বতি পুঁথিপত্র ও মূর্তিসম্ভার। মাঝে মাঝে কলকাতায় মানিকতলার বাড়িতে স্ত্রী, পুত্রদের কাছে আসতেন। জাপান থেকে ফেরার পর ১৯১৭ সালে এই দার্জিলিঙের বাড়িতেই মারা যান শরৎচন্দ্র।

দার্জিলিঙে স্টেশনের কাছে ‘লাসা ভিলা’ বাড়িটি টিকে আছে হতমান অবস্থায়। ভিলার বর্তমান মালিক সুদীপ তামাং পণ্ডিত গুপ্তচরের কাহিনি জানেন, তিনিই কোনও মতে ঐতিহাসিক বাড়িটিকে প্রোমোটারের আগ্রাসন থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। ভোলেননি স্থানীয় তিব্বতিরাও। বছর পাঁচেক আগে নোরবু নামে তিব্বতি বংশোদ্ভূত স্থানীয় এক ভারতীয়ের ব্যক্তিগত উদ্যোগে দার্জিলিঙে তৈরি হয়েছে ‘হিমালয়ান টিবেট মিউজিয়াম।’ সেখানে আধুনিক তিব্বতচর্চার অন্যতম পথিকৃৎ হিসাবে শরৎচন্দ্র সসম্মানে উল্লিখিত।

মৃত্যুর একশো বছর পরে যদিও আম বাঙালির কাছে তিনি অচেনাই রয়ে গেলেন। ‌


তথ্যসৌজন্য: আনন্দবাজার আর্কাইভ

No comments