Header Ads

জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত বিখ্যাত তবলা বাদক সুদীপ চ্যাটার্জীর সাক্ষাৎকার


জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত বিখ্যাত তবলা বাদক সুদীপ চ্যাটার্জীর সাক্ষাৎকার। যিনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় তবলা বাদনের জন্য আমন্ত্রণ পান। যিনি তাঁর প্রতিভার জোরে বাড়িয়ে তুলছেন বাংলার সুনাম। লিটারেসি প্যারাডাইসের নেওয়া তাঁর সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরলাম আপনাদের জন্য।

লিটারেসি প্যারাডাইস- আপনি তো একজন সফল তবলা বাদক। আপনার জীবনে বেড়ে ওঠার গল্পটা যদি একটু বলেন?


সুদীপ চ্যাটার্জী- সবথেকে হাস্যকর একটা বিষয় হয়েছে যখন আমাকে আমার মায়ের মা সুলগ্নাদৃষ্টিতা বন্দোপাধ্যায় উনি আমার মাকে প্রথম ইন্টারেস্টেড করেছিলেন যে আমাকে তবলা শেখানো হোক। আমি যে মিউজিক্যাল প্লেয়ারটা পেয়েছিলাম সেটা মায়ের দিক থেকেই। আমার মা একজন সফল গায়িকা। আমাদের বাড়িতে সংগীতের স্কুল আছে।বলতে গেলে প্রত্যেকটা দিনই মা স্টুডেন্টদের গান শেখান। আমার মায়ের তরফ থেকেই আমি অনুপ্রাণিত হই। শুরুতেই বললাম যেটা হাস্যকর ব্যাপার। সত্যি কথা বলতে শুরুতে আমার তবলার প্রতি আগ্রহ ছিলনা। একদমই আগ্রহ ছিলনা। আমি তবলা নিয়ে তখনই বসতাম যখন আমার পড়ার সময়টা আসতো। ব্রেণ ক্যানসারে আমার বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যান। তারপর আমাদের কোনো রাস্তা ছিলনা  মামাবাড়ি চলে আসা ছাড়া। আমার মায়ের বাবা মানে আমার মাতামহ বীরেন্দ্রকুমার বন্দোপাধ্যায় যদিও তিনি এখন আর নেই, উনি না থাকলে আমি ও আমার মা পুরো ভেসে যেতাম। উনিই আমাদের ওখানে রাখলেন। ওখানে রেখে আমাকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করালেন। তারপর গ্র্যাজুয়েশন ও রবীন্দ্রভারতীতে ভর্তি হলাম। এরই মাঝে মাঝে ১৯৯৮ সালে উনি ওনার গুরুজী শ্রী নিতীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়কে অনুরোধ করেন আমাকে তবলা শেখানোর জন্য। উনি আমার দাদুকে কথা দিয়েছিলেন যে আমি আপনার নাতিকে তৈরি করবো। কিন্তু আমি নিজে কতটা তৈরি হয়েছি জানিনা। তবে বলবো ওনার অবদান অনস্বীকার্য। ওনার মতো তবলা বাদকের সত্যিই তুলনা হয়না। উনি আমাকে একটি কাঠের তবলা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন হাতের ওয়েট বাড়ানোর জন্য তুমি কাঠের তবলাতে প্রতিদিন প্র্যাকটিস করবে। আমার মাস্টারমশাই প্রতিদিন আমাদের বাড়িতে আসতেন। আমাদের বাড়ি এসে তবলা নিয়ে আমার কাছে বসতেন। তারপর আমাকে বলতেন যে একটা বোলকে তুমি কুড়িবার, ত্রিশ থেকে চল্লিশবার বাজাও। এভাবেই কীভাবে তবলার প্রতি আমার ইন্টারেস্ট চলে এলো আমি নিজেই জানতে পারলাম না। কোনো একটা ভালো জিনিসকে নিয়ে এগোনো তো বিরাট একটা ব্যাপার। গানবাজনা বলুন, পড়াশুনা বলুন এগুলো তো তপস্যার বিষয়। সব জিনিসেই তো তপস্যার একটা ব্যাপার আছে। তপস্যা যেমন সফলতা আনে, অনেক সময় অনেক উল্টো-পাল্টা কথাও শুনতে হয়, আবার অনেক সময় অনেক প্রতিকূলতাও ফেস করতে হয়। আমাকেও প্রতিকূলতা ফেস করতে হয়েছে। আমি যখন বিকম কমপ্লিট করলাম, বিকম কমপ্লিট করার পর রবীন্দ্রভারতীতে ভর্তি হলাম তার আগে বিভিন্ন প্রাইজেও অ্যাচিভ করেছি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনবার ইন্টারকলেজ মিউজিক প্রতিযোগীতার প্রথম হয়েছি। এরপর এনএল চ্যাটার্জি মেমোরিয়াল ট্রফি পেয়েছি। তার আগে ২০০২ সালে অল বেঙ্গল মিউজিক কনটেস্ট থেকে প্রথম পুরস্কার পেয়েছি। তারপর ২০০৫ সালে শ্রী অরবিন্দ ইন্সটিটিউট অব কালচার থেকে প্রথম হয়েছি। অল ইন্ডিয়া আর্ট অ্যান্ড কালচার থেকে দ্বিতীয় হয়েছি। এরকম ভাবে বিভিন্ন জায়গা থেকে আমি অনেক প্রাইজ অ্যাচিভ করেছি। এরপর রবীন্দ্রভারতী বিরাট একটা জায়গা সেখানে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে ভর্তি হলাম ২০০৬ সালে।আমার যেহেতু বিকম কমপ্লিট ছিল কিন্তু অনার্স ছিলনা যার কারণে আমি তবলাতে এমএ পাইনি। অনার্স থাকলে আমি ডিরেক্টলি এমএ পেয়ে যেতাম। ফলে বি.এ কমপ্লিট করতে হয়েছে ওখানে আগে। আমার আত্মীয়দের মধ্যে কয়েকজন আমি যে চ্যাটার্জী পরিবার থেকে বিলঙ্গ করছি বা আমার মা ব্যানার্জী পরিবার থেকে বিলঙ্গ করছে তাই সেখান থেকে কোনো অসম্মানসূচক কথা আমাকে কখনো শুনতে হয়নি। কিন্তু আত্মীয় তো অনেকজনই আছেন এই দুই পরিবার ছাড়া অন্যান্য আত্মীয়দের মধ্যে কয়েকজনের কাছে কিন্তু আমাকে উল্টো-পাল্টা অনেক কথা শুনতে হয়েছিল। এমনকি এটা পর্যন্ত শুনতে হয়েছিল যে তবলা বাজানোর জন্য সারাজীবন কলকাতার ঐ মনুমেন্টের নীচে বসে এক পয়সার জন্য আমাকে ভিক্ষে করতে হবে। এতোবড়ো কথা আমাকে শুনতে হয়েছে। এমনকি এটা পর্যন্তও শুনতে হয়েছিল যে কী বলবো এতোটাই অবাক হবেন যে কারও কাছে হাত পাততে নাকি দ্বিধাবোধ করবো না। যাইহোক সেই কথাগুলোকে আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম। নিঃশব্দ প্রতিবাদের মাধ্যমে আমি বিভিন্ন জায়গায় সফল হতে শুরু করি গুরুজী ও মায়ের আশীর্বাদে। নিঃশব্দ প্রতিবাদের মাধ্যমে জানান দিয়েছিলাম যে ওনারা যেগুলো বলেছিলেন তা সর্বোপরি মিথ্যে। মানুষ একটু চেষ্টা করলেই সবকিছুতে এগিয়ে যেতে পারেন। ২০০৮ সালে একটা ট্র্যাজিক মুভমেন্ট আসে, আমি আমার দাদুকে হারাই। স্ট্রোক হয়ে গিয়েছিল ওনার। আমি ভীষণভাবে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি যে আমার কীভাবে চলবে এবার৷ আমি এগোবে কীভাবে? তখন আমি কোনো স্কুলে জবও করিনা, টিউশনও পড়ায় না, আমার কাছে কোনো অ্যামাউন্টও ছিলনা যেটা নিয়ে আমি এগিয়ে যাবো। যাইহোক ঠাকুরের কৃপায় সেটা সম্ভব হলো। ২০১০ সালে আমি রবীন্দ্রভারতী থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করলাম৷ এর আগে ২০০৮ সালে সর্বভারতীয় সঙ্গীত পরিষদ থেকে অল ইন্ডিয়া মেরিট টেস্টে দ্বিতীয় হলাম ও একটি রৌপ্য পদক পাই। আমার হাতে পদকটি তুলে দিয়েছিলেন অরুণকুমার ভাঁদুড়ি মহাশয়। ২০০৮ এর শেষের দিকে নিখিল ভারত সঙ্গীত সম্মেলন দ্বারা আয়োজিত অল ইন্ডিয়া মেরিট টেস্টে আমি প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান ও স্বর্ণপদক লাভ করি। তখন আমার হাতে প্রাইজ ও সার্টিফিকেট তুলে দেন গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনের যিনি অধ্যক্ষ স্বামী শ্রী শ্রী সোমাতজীনন্দ মহারাজ। এবং ২০১১ সালের সর্বভারতীয় সঙ্গীত পরিষদের আরেকটি টেস্টে আমি বসি। আবারও আমি সেকেন্ড হয়। ঐ যে সেকেন্ড হওয়া থেকে একটা জেদ বসে গিয়েছিল যে ফার্স্ট না হওয়া পর্যন্ত ঐ টেস্টগুলো ছাড়ছি না। ২০১৭ সালে আমি ওখানে ফার্স্ট হই ও স্বর্ণপদক লাভ করি।আমার হাতে তখন পুরস্কার তুলে দিয়েছিলেন বিখ্যাত অভিনেত্রী শ্রীমতি মিতা চট্টোপাধ্যায় মহাশয়া। তারপর বিভিন্ন জায়গা থেকে শিখতেও আরম্ভ করি। ২০০৯ সাল থেকে আমি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তবলা বাদক শ্রীরুদ্রনারায়ন কল্যাণীর কাছে তবলা শিখলাম এছাড়াও বিশ্ববিখ্যাত তবলা বাদক পন্ডিত শঙ্কর ঘোষের কাছেও কিছুদিন তবলা শিখেছিলাম। তারপর ভারতের বিভিন্ন জায়গাতে তবলাতে পারফর্ম করেছি যেমন বোকারো, ধানবাদ, পাটনা, শিলং তারপর সাউথ ইন্ডিয়ার বিভিন্ন জায়গাতে যেমন আইআইটি ম্যাড্রাস, চেন্নাইয়ের বিভিন্ন জায়গা, কর্ণাটকেরও বিভিন্ন জায়গা বা ব্যাঙ্গালোরেরও বিভিন্ন জায়গা ও নর্থ ইন্ডিয়ার বিভিন্ন জায়গাতে আর বিভিন্ন জায়গাতে পারফর্ম করবার ইচ্ছেও রয়েছে। বিদেশ বলতে গেলে ২০১১ সালে ঋষি অরবিন্দজীর ১৩৯ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে নেপালের ঋষি অরবিন্দ যোগা মন্দিরে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল৷ আমি ইন্ডিয়ার থেকে তবলাতে পারফর্ম করি। আমি যথেষ্ট সম্মাননা পাই ওনাদের কাছ থেকে। ২০১৫ সালে প্রখ্যাত শারদবাদক অর্ণব ভট্টাচার্যের সাথে আমি যাই ঢাকাতে ভারতীয় দূতাবাসের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল অ্যাকাডেমিতে।সেখানে আমরা দুজনে একটি ক্ল্যাসিক্যাল কনসার্টে পারফর্ম করি। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা যেমন অ্যাসোসিয়েশন অব হাইকমিশন ইন্ডিয়াতে, চট্টগ্রামের শরিত ললিত কলাকেন্দ্র, একজন মন্ত্রীর বাড়িতে পারফর্ম করেছিলাম। এছাড়াও ঢাকার বিভিন্ন জায়গা যেমন ঢাকা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিষদ। ঢাকাতে একটি অনুষ্ঠান খুবই উল্লেখযোগ্য যেখানে আমি ও অর্ণববাবু প্রচন্ড সাড়া ফেলেছিলাম ঢাকার অ্যামেরিকান সেন্টারের আন্ডারে। ২০১৭ সালের এই পারফরম্যান্সটাই ভীষণভাবে সাড়া জাগিয়েছিল। এটাই এখন পর্যন্ত আমার মিউজিক্যাল জার্নি। তবে বর্তমানে আমি রুবী পার্ক পাবলিক স্কুলের তবলার শিক্ষক হিসেবে আছি। যাতে সবদিক থেকে আমার ছাত্রদের এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। যাতে তারাও আস্তে আস্তে এ বিষয়ে আলোর দিশা খুঁজে পায়। আমি আমার ছাত্রদের এ কথাটা বলে থাকি যেদিন তোমরা আমার থেকে ভালো তবলা বাজাবে সেদিন জানবো আমার শিক্ষকতা সার্থক হয়েছে। 

লিটারেসি প্যারাডাইস- আপনি কোন ঘরানার তবলা বাজাতে বেশি পছন্দ করেন?

সুদীপ চ্যাটার্জী- আমার ঘরানা হচ্ছে বেনারস ঘরানা।আমার দুজন গুরুজী মানে আমার প্রথম গুরু নিতীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে আমি প্রথম শিখেছি উনি পন্ডিত শান্তামোহন মুখোপাধ্যায়ের সুযোগ্য শিষ্য যিনি গুরুগৃহে থেকে দীর্ঘ আটবছর বেনারস ঘরানাতে শিক্ষা লাভ করেন। পন্ডিত নিতীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে আমি দশ বছর শেখার পর আমি পন্ডিত শ্রী রুদ্রনারায়ন কল্যাণীর কাছে যাই তিনি সঙ্গীত দেবজী পন্ডিত রামকুমারজী ও পন্ডিত কিষাণ মহারাজজীর সুযোগ্য শিষ্য। ওনার কাছে আমি দীর্ঘ দশবছর শিক্ষালাভ করি। এরপর পন্ডিত সিংমল্লার ঘোষ যিনি পন্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সুযোগ্য শিষ্য ও পুত্র, তারপর বিশ্ববিখ্যাত তবলা বাদক পন্ডিত শঙ্কর ঘোষের কাছেও আমি তবলা শিখেছি। প্রতিটি ঘরানার প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি বলছি বেনারস ঘরানা বাজাতে আমার খুব ভালো লাগে। সমস্ত ঘরানাই আমার কাছে প্রণম্য তবে বেনারস ঘরানা বাজাতেই সবচেয়ে বেশি সাচ্ছন্দ্যবোধ করি। 



লিটারেসি প্যারাডাইস- তবলা বাদক হওয়ার ইচ্ছেটা আপনার কীভাবে জাগলো?

সুদীপ চ্যাটার্জী- আমি তো প্রথমেই বললাম। আমার তবলা বাদক হওয়ার ইচ্ছে মোটেই ছিলনা। এক্ষেত্রে একটা গল্প আছে। ২০০২ সালে সবে আমার তবলার প্রতি ইন্টারেস্টটা জন্মেছে। তবে তবলার মাধ্যমে যে এতোটা উন্নতি করা যেতে পারে সেই সংক্রান্ত কোনো ধারণাই ছিলনা আমার মধ্যে। দুটো ব্যাপার আমি বলি। প্রথমটা আমি যখন ক্লাস নাইন বা টেনে পড়ি সালটা অতোটা খেয়াল নেই। আমাদের বাড়ির সামনে একটা খেলার মাঠ ছিল। আমি স্কুল থেকে ফিরে কিছু খেয়ে নিয়ে ক্রিকেট খেলতে ছুটতাম ঐ মাঠে। প্রত্যকদিন গুরুজী বিকেলে আসতেন।আমার মা খেলার মাঠে গিয়ে আমাকে প্রায়ই ডেকে নিয়ে আসতেন। বলতেন মাস্টারমশাই এসেছেন তোমাকে শিখতে যেতে হবে। আমি খুব বিষাদ মনে চলে আসতাম।ছেলেমানুষ হলে যা হয় আর কী।একদিন গুরজী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে বাইরে তুমি কী করতে গিয়েছিলে? জানতে না যে আমি আসবো বলে। তখন আমি বললাম যে হ্যাঁ মাস্টারমশাই আমি জানতাম যে আপনি আসবেন।তো উনি জিজ্ঞেস করলেন মানে জানাসত্ত্বেও তুমি বাইরে গিয়েছিলে।তুমি বাইরে কী করতে গিয়েছিলে? আমি বললাম যে খেলতে গিয়েছিলাম। উনি জিজ্ঞেস করলেন যে কী খেলছিলে? উনি কিন্তু জানেন যে ওখানে কী খেলা হচ্ছিল। কারণ উনি মাঠের পাশ দিয়েই এসেছেন তাও জিজ্ঞেস করছেন। কী খেলতে গিয়েছিলে? না আমি ক্রিকেট খেলতে গিয়েছিলাম। তারপর উনি বললেন যে তুমি সিওর যে ক্রিকেট খেলে তুমি শচীন-সৌরভ হতে পারবে? আমি বললাম না। তাহলে তুমি গিয়েছিলে কেন? না আমি আনন্দ উপভোগ করতে গিয়েছিলাম। তার মানে একটা গেমকে তুমি আনন্দ উপভোগ করার বিষয় হিসেবে নিচ্ছো। তো আমি বললাম হ্যাঁ। তারপর তিনি বললেন তবলা নামক বিষয়টিকে যদি তুমি গেম হিসেবে নাও তাহলে এর মাধ্যমে তুমি অনেকদূর যেতে পারবে। ঐ পয়েন্টাকে অতোটা ভালোভাবে আমি গ্রহণ করিনি বা ঐ পয়েন্টটা নিয়ে অতোটা ভাবিনি। দ্বিতীয়টা হচ্ছে ২০০২ সালে তবলা কম্পিটিশনে যাই। সেটা কিন্তু শুধু তবলা কম্পিটিশনই ছিল মানে কম্পিটিশনে তো ওর পাশাপাশি অনেক বিষয়ই থাকে। আর ঐ কম্পিটিশনটা শুধু তবলা নিয়েই ছিল। বিশ্ববিখ্যাত তবলা বাদক সেখানে জার্জ হিসেবে গিয়েছিলেন৷ তো আমি চৌদ্দ মাত্রা নামক একটি তাল বাজাচ্ছিলাম। সেইসময় জার্জ আমাকে বলেন যে এই তালটা তুমি তালির মাধ্যমে দেখাও। তো আমি তালি দিয়ে দেখালাম। এরপর তিনি বললেন ডাবলটা দেখাও টেম্পার একই থাকবে কিন্তু সিঙ্গেলের ওপর বেস করে তোমাকে ডাবলে যেতে হবে। আমি সেটাও দেখালাম। এরপর তিনি বললেন চারগুণটা করে দেখাও টেম্পার একই থাকবে। ডাবলের ওপর বেস করে চারগুণে যাও। আমি এটা দেখাতে গিয়ে না একটু ভুল করে বসেছিলাম। তো উনি বিমর্ষ হয়ে বললেন লাস্ট মুভমেন্টে ভুল করে বসলে তাই আমি তোমাকে নাম্বারটা দিতে পারলাম না। আমি বুঝতেও পেরেছিলাম যে ভুলটা আমি করেছি। এর পরের দিন আমি জার্জকে ফোন করে জানলাম যে আমার ভুলটা কোন জায়গায় হয়েছে একটু বলতে পারবেন৷ আমি যে তালে বাজাচ্ছিলাম আপনি ভুল বললেন। তখন উনি ভীষণভাবে আনন্দিত হলেন। তুমি বিশ্বাস করবে না উনি আনন্দিত হয়ে বললেন তুমি তোমার ভুলটা সম্পর্কে জানতে চেয়েছো। যেটা অনেকেই কিন্তু জানতে চায়না। তোমার হাত আরো ভালো গলবে তুমি যদি তবলাকে নেশা হিসেবে নিতে চাও। তুমি যার কাছে শেখো তাকে বিন্দুমাত্র ছোটো করছি না। তুমি যদি তবলাকে নেশা হিসেবে নিতে চাও তাহলে যেমন শিখছো যার কাছে শিখছো ঠিক আছে। তুমি যদি তবলাকে পেশা করতে চাও তাহলে বিরাট স্টারওয়ার্কারের কাছে গিয়ে শেখো এটা আমি আমার তরফ থেকে বললাম৷ এই যে আমার মাথায় ঢুকলো যে তবলাকেও তাহলে পেশা করা যায়৷ কারণ আমি জানতাম উনি বিরাট মাপের শিল্পী।তবলাকে তিনি পেশা হিসেবে নিয়েছেন বলেই তো বিশ্ববিখ্যাত তবলা বাদক। তাহলে আমি কেন পারিনা তবলাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে। আমি তবলাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য পরিকল্পনা করেছিলাম। বাড়িতে ভীষণভাবে আপত্তি করেছিল এতে। কিন্তু যখন সকলে দেখলো এটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছি তখন কেউ আর বাঁধা দেননি।  

লিটারেসি প্যারাডাইস- একজন ভালো তবলা বাদক হতে হলে কী কী বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া সবচেয়ে বেশি জরুরী?

সুদীপ চ্যাটার্জী- প্রথম কথা হচ্ছে গুরুর প্রতি অকুণ্ঠ ভক্তি। আরেকটি বিশ্বাস। গুরুকে ভগবানের চেয়েও উচ্চ আসনে বসানো। তিনি ছাড়া কেউ নেই। তিনি ছাড়া জগৎ অন্ধকার। উনি যা যা বলবেন বা দেবেন সেগুলোকে যথাযথ ভাবে রেওয়াজ করা। দিনে প্রায় ছয় থেকে সাত ঘন্টার মতো প্র্যাকটিস করা এবং শুধু প্র্যাকটিসই নয়, একনাগাড়ে মন দিয়ে প্র্যাকটিস করে যাওয়া। সবথেকে বড়ো কথা হলো গান শোনা। তানসেন হওয়ার আগে কানসেন হও এটা মানে আমি অনেক বড়ো বড়ো মানুষের কাছ থেকে শুনেছি। মানে মিউজিকটা শুনতে হবে, তাহলেই আইডিয়া করা যেতে পারে কোন ক্ষেত্রে কোন জায়গাতে কোনটা ব্যবহার করা যেতে পারে। শুধু একক আইটেমের জন্যই ব্যবহার করতে হবে এমনটা নয়, প্রতিটি আইটেমের সাথে ব্যবহার করতে পারতে হবে। কোন গানের সাথে কোন আইটেম কোন তালের সাথে পুট করলে তবলাটি শুনতে শ্রুতিমধুর লাগে সেই জিনিসটির জন্য শুনতে হবে প্রচুর গান। আশি শতাংশ শোনা আর কুড়ি শতাংশ বাজনা। এই পয়েন্টগুলি মেনটেন করতে পারলেই একজন সফল তবল বাদক হিসেবে পরিগণিত হওয়া যায়।   

লিটারেসি প্যারাডাইস- কোন কোন তবলা বাদকদের কাজ আপনাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করে?

সুদীপ চ্যাটার্জী- সবারই। তবুও আমি বলছি ওটা জাকির হুসেনজী যার অবদান অনস্বীকার্য। পদ্মবিভূষণ প্রাপ্ত শান্তামোহনজী, পদ্মবিভূষণ প্রাপ্ত কিষাণমোহনজী। এছাড়াও বর্তমানে যারা আছেন যেমন পন্ডিত শঙ্কর ঘোষজী আমি যার কাছে শিখেছি, বিক্রম ঘোষজী, পদ্মশ্রী প্রাপ্ত পন্ডিত স্বপন চৌধুরীজী এছাড়াও বহু তবলা বাদক রয়েছেন। পাকিস্তানের একজন তবলা বাদক ফারি খাঁ। অসাধারণ একজন তবলা বাদক। সকল তবলা বাদকদের প্রতি আমার অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা রয়েছে।   

লিটারেসি প্যারাডাইস- ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে তবলা নিয়ে কীরকম একটা অনীহা তৈরি হয়েছে। এটা কীভাবে দূর করা সম্ভব? 

সুদীপ চ্যাটার্জী- এটা কী বলবো। আমার যেটা মনে হয়েছে যে কম শিখে পারফরম্যান্স করা এই জিনিসটা। এই জিনিসটাকে যদি পরিহার করা যায় মানে শুনবো বেশি, করবো বেশি তারপর পারফরম্যান্স। এ জিনিসটা মেনটেন করতে হবে তাহলে কিন্তু অনীহার ব্যাপারটা চলে যাবে। তারপর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো ধৈর্য্য। এই ধৈর্য্যটা যদি চলে আসে তাহলে এই অনীহাটা দূর হয়ে যাবে। বড়ো কাজ করতে হলে ধৈর্য্যটাই হলো আসল কথা। 


লিটারেসি প্যারাডাইস- আপনার তবলা জীবনের সবচেয়ে বড়ো পাওনা কী?

সুদীপ চ্যাটার্জী- আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো পাওনা হলো গুরুকৃপা। এই গুরুকৃপা না থাকলে এতদূর আমি এগিয়ে আসতে পারতাম না।     
  
লিটারেসি প্যারাডাইস- ভবিষ্যতে তবলা নিয়ে আপনার নতুন কী ভাবনা রয়েছে? 

সুদীপ চ্যাটার্জী- বিভিন্ন দেশে যাওয়া, বিভিন্ন দেশে গিয়ে তবলা বাদন পরিবেশন করা। যারা আমাকে তবলা শিখিয়েছেন তাদের নাম প্রকাশ ও প্রচার করা কারণ ওনারা না থাকলে আমার জগতটা অন্ধকার থাকতো। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো যাদের জন্য এই পৃথিবীতে এসেছি আমার মা-বাবা তাদের নাম করা। যারা আমাকে শুভকামনা দিয়েছেন তাদের নাম করা। যথাযথভাবে আমি যা যা শিখেছি সেগুলো পারফর্ম করা। যদি বড়ো বড়ো গুরু মানুষদের সাথে আমার পারফর্ম করার সৌভাগ্য হয় তাহলে তো আর কথাই নেই।    
  
প্রতিবেদন- অমিত দে

No comments