Header Ads

পরিণতি পেলোনা যে প্রেম


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আঁচ তখন এসে পড়েছে বাংলার উঠোনেও। জাপানি বোমার ভয়ে কাঁপছে কলকাতা। গুজব রটছে অহরহ, এই বুঝি জাপানি সেনারা ঢুকে পড়ল দেশে। কোহিমায় তখন জাতীয় পতাকা তুলেছেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। আজাদ হিন্দ বাহিনী দখল নিয়েছে ইম্ফলের। জাপানিদের নিয়ে ভয়ের পাশাপাশি নেতাজীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখাও ঘন হচ্ছে। জাপানি আর নেতাজীর জোট বাংলায় ঢুকে এলে আসলে সুবিধে না অসুবিধে—তা নিয়ে তর্ক হচ্ছে ইতিউতি। কিন্তু, কিছুই যেহেতু ভালো করে স্পষ্টাস্পষ্টি বোঝা যাচ্ছে না, ফলে সব মিলিয়ে একটা ঘন ধোঁয়াশা।  



এই বিশ্বযুদ্ধের আবহেই মিত্রশক্তির পক্ষে ব্রিটিশদের সাহায্য করতে বাংলার মাটিতে পা রেখেছিল মার্কিনি সেনারা। মূল লক্ষ্য জাপানি সেনাদের ঠেকানো। বিভিন্ন জায়গায় মার্কিনি সেনা ব্যারাক তৈরি হল। আর, কলকাতা থেকে কমবেশি পঞ্চাশ কিমি দূরে তৈরি হল পুরোদস্তুর মার্কিনি সেনা উপনিবেশ--- ‘রুজভেল্ট নগর’। বিমান ঘাঁটি, সেনা-আবাস, মিলিটারি হাসপাতাল— অনেক কিছুই ছিল এখানে। শোনা যায়, গঙ্গার ধারে নদিয়া জেলার ৪৫টি গ্রাম নিয়ে এই নগরের পরিকল্পনার আড়ালে ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট স্বয়ং। ‌

এরপর হাওয়া ঘুরল। জার্মানি আত্মসমর্পণ করল। পরমানু বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত জাপানও পরাজয় মেনে নিল। এই দেশ থেকে সমস্ত কিছুর পাট চুকিয়ে বিদায় নিল মার্কিনি সেনারা। তাদের সেই সেনা ছাউনি, বিমান ঘাঁটি অপেক্ষা করতে লাগল পরিত্যক্ত হবে বলে। যুদ্ধের নানা স্মৃতি নিয়ে পড়ে থাকা এই মার্কিনি উপনিবেশ তখন মুখ ঢেকেছে জঙ্গলে, উঁচু-উঁচু ঘাসে। 

রুজভেল্ট নগর সন্নিহিত রেল স্টেশনটির নাম তখন ‘চাঁদমারি হল্ট’। এই স্টেশনটির নামই পঞ্চাশের দশকে বদলে হয়ে গেল ‘কল্যাণী’। শুধু ‘চাঁদমারি হল্ট’ স্টেশনই নয়, প্রায় সমগ্র রুজভেল্ট নগরই ততদিনে নতুন শহর ‘কল্যাণী’র নামে লীন হয়ে গেছে। 

হঠাৎ করে, পরিত্যক্ত মার্কিনি সেনা-উপনিবেশের ভোল পালটে এমন নতুন শহর গড়ে উঠল কেন? কারণ, পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের ইচ্ছে ছিল কলকাতার থেকে খানিকটা দূরে আরো একটি বড় শহর গড়ে তোলার। যেটি শিল্পাঞ্চল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হবে। কলকাতার ওপর ক্রমবর্ধমান চাপ এতে খানিক হালকাও হবে। বিকেন্দ্রীভবনের মাধ্যমে রাজধানীর পরিধিটিও এইভাবে খানিক বাড়িয়ে নেওয়া যাবে। কেউ কেউ বলেন, বিধানচন্দ্র রায়ের স্বপ্ন আসলে ছিল দ্বিতীয় কলকাতা তৈরির। রুজভেল্ট নগরের অদূরেই গঙ্গা। রেলপথে যাতায়াতেও অসুবিধে নেই। কলকাতা থেকে দূরত্ব ৫০ কিমি। ফলে, আদর্শ নগর গড়ে তোলার জন্য এই পরিত্যক্ত মার্কিনি উপনিবেশকে ভালোই মনে ধরেছিল প্রাক্তন কিংবদন্তী মুখ্যমন্ত্রীর।

কিন্তু, নতুন নগরের নাম ‘কল্যাণী’ হল কেন? উন্নয়নের কল্যাণ কামনায় তৈরি নগর বলে?  নামকরণের ইতিহাস এত সরল নয় বন্ধু........ অন্তরালে রয়েছে একটি ব্যর্থ প্রেমের উপাখ্যান !

কিংবদন্তী চিকিৎসক নীলরতন সরকারের পাঁচ কন্যার একজন হলো কল্যাণী। রূপে লক্ষী গুণে সরস্বতী কন্যাটিকে ঘরে আনতে আগ্রহী পুরানো কলকাতার এলিট সমাজের কুমার গণ। এহেন কন্যার পাণিপ্রার্থী হয়ে গেছিলেন সদ্য ডাক্তারী পাস তরুণ বিধান রায়। শহরের সবচেয়ে ধনী ও মানী ডাক্তার বাবা শুনেই তো তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন, সোজা দেখিয়ে দিলেন সদর দরজা।

জীবনের প্রথম প্রেমের অনুভূতিকে কোনোদিনই নাকি ভুলতে পারেননি বিধানচন্দ্র, অবিবাহিত থেকে গেলেন আজীবন। এই পরিণামহীন প্রণয়েরই সাক্ষ্য বহন করছে ‘কল্যাণী’ নামকরণ। ‌

১৯৫১-তে  শহরের শিলান্যাস করেছিলেন তৎকালীন রাজ্যপাল কৈলাশনাথ কার্টজু আর প্রাক্তন ‘চাঁদমারি হল্টের’ নাম মুছে স্টেশনে ‘কল্যাণী’ লেখা হয়েছিল ১৯৫৪-তে। সেসব কবেকার কথা। রুজভেল্ট নগর থেকে কল্যাণী হয়ে ওঠার মতোই তারপর অনেক বদলেছে এই শহর। ফাঁকা জমি ভরাট হয়েছে। স্মার্ট সিটির তকমা লেগেছে গায়ে। কল্যাণীকে দ্বিতীয় কলকাতা বানানোর সাধ সম্পূর্ণ হয়নি বিধানচন্দ্র রায়ের। কলকাতার থেকে দূরত্ব হয়তো একটা বড়ো কারণ। কিন্তু, দুটি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ নিয়ে এই শহর নিজের মতো দিব্যি আছে। এখনো এখানে শ্বাস নেওয়ার মতো গাছ আছে, সবুজ আছে, বনানীর ফাঁকে প্রেম করার মতো নির্জনতা আছে।

আর আছে, মার্কিনি উপনিবেশ থেকে ‘কল্যাণী’ হয়ে ওঠার আড়ালের গল্পরা। সেই গল্পে যুদ্ধও আছে, আছে নতজানু প্রেমও। বেশ খানিকটা খাঁটি সত্যি, কিছুটা রহস্যে ঢাকা। রহস্য না থাকলে কী আর টান জন্মায়!  



No comments