Header Ads

দেবী চৌধুরানীর প্রেম


সে অনেকদিন আগের কথা ..... ইংরেজ সাহিত্যিক রুডয়ার্ড কিপলিং তার কোন এক ছোট গল্পে বাঙালি জাতিকে 'গিধড়' বা শেয়ালের সাথে তুলনা করেন। তা পড়ে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি বাংলার এই কন্যে।


কিপলিং কে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে বসলেন....... "তুমি গল্পে গিধড় বলে সমগ্র বাঙালি জাতিকে অপমানিত করেছ। এই অপমান মোচনের জন্য আমার ভাইদের যে কোন একজনের সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধে তোমাকে আহ্বান করছি। তৈরি হওয়ার জন্য তোমাকে পাঁচ বছর সময় দিলাম। বন্দুক হোক, তলোয়ার হোক যে কোন অস্ত্রে তুমি নিজেকে উপযুক্তভাবে তৈরি করে নিতে পারো, আমার ভাইরা তোমার সাথে লড়াই করতে তৈরি । তখনই তুমি বুঝতে পারবে বাঙালি শেয়াল না অন্য কিছু !"

চিঠি তো লেখা হলো কিন্তু পাঠাতে গিয়ে বিপত্তি, কিপলিং এর ঠিকানাটাই যে জানা নেই। উচিত জবাব না দিতে পেরে মানসিক শান্তি কিছুতেই পাচ্ছিলেন না তিনি। সেই সময়ে কটকে বেড়াতে এসে দেখা হয় দেশভক্ত মধুসূদন দাসের সাথে। নিজের মনের দুঃখের কথা খুলে বলেন তাঁকে । সবকিছু শুনে মধুসূদন দাস বলেন "ওকে যখন পাঁচ বছর সময় দিয়েছেন তখন নিজেও পাঁচ বছর অপেক্ষা করুন। এই সময়ের মধ্যে বাঙালি যুবকদের অস্ত্র বিদ্যায় তৈরি করে নিন।

যুক্তিটা মনে ধরেছিলো কন্যার, কলকাতায় ফিরে ২৬ নং সার্কুলার রোডে খুলে ফেলেন এক আখড়া। সেখানে মুর্তাজা নামে একজন মুসলমান ওস্তাদকে নিযুক্ত করলেন বাঙালি যুবকদের ছোরা খেলা, তলোয়ার চালানো, লাঠি খেলা এসব শিক্ষা দেওয়ার জন্য। নিজের টাকায় কিনলেন অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জাম। আখড়াটির কথা অচিরেই ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। দূর-দূরান্ত থেকে যুবকেরা সেখানে অস্ত্র শিক্ষা ও শরীর গঠনের জন্য আসতে শুরু করে। ১৯০৩ সালে তিনি কলিকাতায় চালু করলেন 'প্রতাপাদিত্য উৎসব'। প্রকাশ করা শুরু করলেন বাঙালি বীরদের কাহিনী নিয়ে ছোট ছোট পুস্তিকা।

চিনতে পারলেন কন্যাটিকে ?

রবীন্দ্রনাথের দিদি বাংলার প্রথম মহিলা উপন্যাস লেখিকা স্বর্ণকুমারী দেবীর দ্বিতীয় কন্যা এই সরলা দেবী চৌধুরানী বা সরলা ঘোষাল।বাবা জানকীনাথ ছিলেন নদীয়ার জয়রামপুরের বিখ্যাত ঘোষাল বংশের সন্তান এবং জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে একজন। রূপে গুণে অনন্যা এই কন্যের সাথে তুলনা করা হত বিখ্যাত ফরাসি স্বাধীনতা সংগ্রামী জোয়ান অফ আর্কের।

একদিকে রূপসী ও সংস্কার মুক্ত অন্যদিকে সুরেলা কন্ঠস্বর ,গান বাজনা সাহিত্যের প্রতি অসীম জ্ঞান। দেখে শুনে প্রেমে পড়ে যান জাতির জনক। 

'জীবনের ঝড়াপাতা' বইতে গান্ধীজী সম্পর্কে সরলা তাদের প্রথম আলাপের কথা লিখে গেছেন, সেটা ১৯০১ সালের কথা.....তখনও তিনি মহাত্মা গান্ধী হননি। আমাদের বাড়িতে একটি সান্ধ্য পার্টিতে এলেন। দেখতে শুনতে চটকদার নয় তবে মুখ হাসিতে ভরা, মাথায় ‘পিরিলি পাগড়ি’। অল্পক্ষণের জন্য তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হল। পরে তিনি আমায় গল্প করেন, আমায় কিরকম সমীহের চোখে দেখেছিলেন সেদিন।

আমার নিজস্ব কাজকর্মের কোনও পরিচয় সেদিন তিনি পাননি। আমি তখন ভেবেছিলাম ভারতীর (পত্রিকা) জন্য এর কাছ থেকে একটা লেখা আদায় করতে পারলে বেশ হয়।"

মাঝে কোনও যোগাযোগ ছিল না দুজনের, নিবিড় সম্পর্কের সূত্রপাত ১৯১৯ সালে।

'Mohandas: A True Story of a Man, His People, and an Empire’ বইতে রাজমোহন গান্ধী লিখেছেন, "১৯১৯ সালের ২৪ শে অক্টোবর গান্ধীজী লাহোরে যান"। ইতিমধ্যে সরলাদেবী বিয়ে করেছেন ও এক পুত্র সন্তানের মা। স্বামী রামভূজ দত্ত চৌধুরী লাহোর নিবাসী একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। জালিয়ানওয়ালা হত্যাকান্ডের তদন্ত করতে গিয়ে লাহোরে এনাদের বাড়িতেই ওঠেন গান্ধীজী, নতুন করে সরলা দেবীর প্রতি জেগে ওঠে প্রেম।

গান্ধীজী তখন ৪৭ , সরলাদেবী তিরিশের কোঠায়। রাজমোহন লিখেছেন , "গান্ধীজী যখন ওনাদের বাড়িতে গৃহকর্তা তখন জেলে। এই সময় গান্ধীজী একটি চিঠিতে লেখেন, "সরলার সান্নিধ্যে আমি আপ্লুত। উনি আমার দারুণ সেবা করছেন। পরের কিছু মাস ধরে নিবিড় থেকে নিবিড়তর হয়েছে গান্ধীজী ও সরলার সম্পর্ক । এই সম্পর্ককে গান্ধীজী এক আধ্যাত্মিক বৈবাহিক সম্পর্কের পরিচয় দিয়েছিলেন, লেখকের ভাষায় যা 'spiritual marriage'। গান্ধীজী একটি চিঠিতে লিখেছেন, "আমাদের দুজনের বন্ধন এমন একটা বন্ধন যা কোনও যৌন এবং শারীরিক সম্পর্কের ঊর্ধ্বে। এটা সম্ভবত দুই ব্রহ্মচারীর মধ্যেই হতে পারে যাদের ভাবনা, চিন্তা, লেখাপত্র সবকিছুই একে অপরের সঙ্গে মিলে যায়।"

ওই বইয়ের তথ্য অনুযায়ী গান্ধীজী একটি চিঠিতে লিখেছেন, "তুমি আমার স্বপনে,শয়নে বিরাজ করছ। আমার মনের প্রতিটি কোনায় তোমার জন্য ভালোবাসা রয়েছে। তুমি জানতে চেয়েছিলে তোমার ভালোবাসার প্রতি আমার কতটা আকর্ষণ রয়েছে...... এই হল সেই উত্তর।”

বইয়ের তথ্য বলছে দুজনের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা এতটাই ছিল যে, ওই সম্পর্কের কারণে গান্ধীজীর বিবাহ ভেঙ্গে যাওয়ার পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। দুজনের সম্পর্ক নিয়ে নানা কথা পৌঁছতে শুরু করেছিল গান্ধীর ঘনিষ্ঠদের কানে। তাঁর পরিবারেও ব্যাপক ঝামেলা হয়।

গান্ধীজীর সঙ্গে অশিক্ষিত কস্তুরবার মনের মিলের দিক থেকে একটা তো ফাঁক ছিলোই, সেই অভাব পূরণ করতে পেরেছিল সরলা।
শেষ পর্যন্ত ধর্মপত্নী কস্তুরবার জেদের কাছে মহাত্মা পিছু হঠতে বাধ্য হন, নিজেকে সরলার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেন। পরে হিমালয়ে আধাত্মিক জীবন যাপনের লক্ষ্যে চলে গিয়েছিলেন সরলা দেবীও।

বেশ কয়েক বছর পরে সরলার একমাত্র পুত্র দীপক দত্তর বিয়ে হয় মহাত্মা গান্ধীর নাতনি রাধার সাথে, দ্বিতীয় প্রজন্মে পরিণতি পেল দেবী চৌধুরানীর প্রেম। 



তথ্যসূত্র : আউটলুক ইন্ডিয়া

No comments