Header Ads

বাঙালির মধ্যে যেভাবে প্রথম ইংরেজিয়ানার আবির্ভাব হয় || দ্বিতীয় পর্ব


রামলোচন নাপিত, কৃষ্ণমোহন বসু এবং আরও অনেকেই তখন ইংরেজি শিক্ষা দিতেন অনেকটা আজ কালের ধরনে। তারও কিছু পরে ইংরেজি পণ্ডিত ভবানী দত্ত, শিশু দত্ত এমনি কেউ কেউ পূর্ণাঙ্গ ইংরেজি পণ্ডিত হিসেবে খ্যাত হয়েছিলেন। তখন টমাস ডিসের স্পোকেন বুক, স্পেলিং বুক, স্কুল মাস্টার ছাড়া আর কোন বই ছিল না। আরব্য উপন্যাস ও তুতিনামার প্রচলন ছিল। এর যে কোন একটি বই পড়া থাকলে পণ্ডিত খ্যাতি লাভ করা যেত। এ ভাবে যারা ব্যাকরণের সূত্রগুলি বলতে পারতেন তারাও পণ্ডিত নামে খ্যাত হতেন। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে মিস্টার মিলার ইংরেজি ও বাংলা একটি বই সংকলন করেছিলেন। বইটি ছিল প্রায় ১৫০ পৃষ্ঠার, তাতে বর্ণ পরিচয়, সিলেবাস বিভাগ এছাড়া ছিল কিছু দ্রব্যের নাম, আর ব্যাকরণের কিছু প্রাথমিক সূত্র। 



এই বইটির ৪০০০ কপি ছাপা হয়েছিল। বইটি ছাপাখানা থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সব কপি বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। প্রত্যেকটা কপির নির্ধারণ মূল্য ছিল ৩২ টাকা। এরপর ফস্টার সাহেবের অভিধান বেরোয় কিন্তু তার মূল্য এত বেশি ছিল যে সাধারণ লোকদের তা কেনা সাধ্যের বাইরে ছিল। সে সময়ে ইংরেজিতে থাকত রাম কোমল সেনের ভূমিকা। সে সব ছিল ১৮০১ সালের কথা। এরপর বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে গেছে, রাজনারায়ণ বসু তার যে কাল ও একাল গ্রন্থে এ রকম লিখেছিলেন—‘সর্ব প্রথমে লোকের ইংরেজী পড়িতে হইলে টমাস ডিস প্রণীত স্পেলিং বুক, স্কুল মাস্টার, কামরূপা ও তুতিনামা এই সকল পুস্তক পাঠ করিতে হইত। স্কুল মাস্টার পুস্তকে সকলই ছিল—গ্রামার, স্পেলিং ও রিডার। কামরূপাতে এক রাজপুত্রের গল্প লিখিত ছিল। তুতিনামা ওই গল্পের পারসিক পুস্তকের ইংরেজি অনুবাদ ছিল। কেহ যদি অত্যন্ত অধিক পড়িতেন, তিনি আরবি নাইট পড়িতেন। যিনি রয়েল গ্রামার পড়িতেন,লোকে মনে করিত তার মত বিদ্বান বুঝি আর কেউ নেই !’ 

তখন শব্দের অর্থ মুখস্থ করার বিভিন্ন প্রণালী ছিল, যেমন--আই মানে আমি, ইউ মানে তুমি, গড মানে  ঈশ্বর, কম মানে এস--ইত্যাদি। আবার এক একটা ইংরেজি শব্দের বিভিন্ন অর্থগুলি একবারে পড়ে নেওয়া হত, যথা—ওয়েল (well)--আচ্ছা / ভালো, বিয়ার (bear)--বহন, সহ, ভল্লুক। সে কালের লোকরা যে সমস্ত শব্দের উচ্চারণ একই ধরনের কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন অর্থের সেগুলো এক বারে অভ্যাস করতেন। যেমন ফ্লাওয়ার(flower)--ফুল, ফ্লোর (flour) ময়দা, ফ্লোর (floor) মেঝে। এমনি তিনটে শব্দকে এক রকমের উচ্চারণ করতেন। এ সব শব্দগুলো তাঁরা প্রায় মুখস্থ করে রাখতেন। তখন লোকদের ডিকশনারির শব্দ মুখস্থ করে রাখার অভ্যাস ছিল।  

সে সময়টায় ঘষানোর রীতি ছিল। ঘষানোর অর্থ হল পয়ার ছন্দে গ্রথিত কোন দ্রব্য শ্রেণীর অন্তর্গত সমস্ত দ্রব্যের ইংরেজি নাম সুর করে মুখস্থ করা। কেউ হয়ত স্কুল দেখতে গেলেন, তখন স্কুল মাস্টার তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কি ঘোষাবো—গার্ডেন (garden) না কি স্পাইস (spice) ? এর অর্থ হল উদ্যানজাত নাম না কি মশলার নাম মুখস্থ বলাবো ?

গার্ডেন ঘোষণার কথা বলা হলে ক্লাসের বা স্কুলের সর্দার মানে ক্যাপ্টেন চেঁচিয়ে বলত, পামকিন(pumpkin)--লাউ কুমড়ো আর  সঙ্গে ক্লাসের বা স্কুলের সবাই এক সুরে বলে উঠত, পামকিন--লাউ, কুমড়ো। ক্লাস ক্যাপ্টেন বলে উঠত, কোকম্বর (cucumber)--শসা। সকলে সেই শব্দ সুর করে বলে উঠত কোকম্বর--শসা। তেমনি ভাবে টেনে টেনে সুর করে বলানো হত বৃঞ্জল (brinjal)—বার্তাকু, প্লমেন (ploughman)—চাষা ইত্যাদি ইত্যাদি। 

কখনও আবার সংগীত লয়ে ইংরেজি শব্দের বাংলা অর্থ বলানো হত--যেমন খাম্বাজ রাগিণী, তাল--ঠুংরি। 

যেমন--(nigh) নাই--কাছে, (near) নিয়ার--কাছে, (nearest) নিয়ারেস্ট--অতি কাছে। এমনি কট(cut) কাটা, কট(cot)খাট,ফলোইং( flowing ) পাছে। 

এই ভাবে ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ শে জানুয়ারি হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত ইংরেজি শিক্ষার এ রকমই দুর্দশা ছিল। এই সময়টা বাঙালির মুখে ইংরেজি ভাষার হেনস্থ হওয়াটাও দেখা যায়। এ ব্যাপারে একটা গল্প প্রচলিত ছিল।

ইংরেজ সাহেবের ঘরে এক বাঙালি স্টোরকিপারের কাজ করত। ইংরেজি সে জানতো না বললেই চলে। ইয়েস, নো, ভেরি গুড, এই রকম কিছু শব্দ সে রপ্ত করে রেখেছিল। এক দিন হল কি সাহেবের ভাড়ার ঘরে এক ছড়ি কলা দড়ি দিয়ে টানিয়ে রাখা হয়েছিল। কোন এক ফাঁক পেয়ে এক বাঁদর এসে তা থেকে অনেকগুলি কলা খেয়ে গেল। লোকটা তো ভয়ে অস্থির হয়ে ছিল। 

এবার তার ইংরেজ মালিক এসে যখন বাকি কলাগুলির দিকে আঙ্গুল তুলে জিজ্ঞেস করল, where are the bananas? কলাগুলো কোথায় গেল? বাঙালি লোকটি তো কোন ভাবেই ইংরেজ লোককে বোঝাতে পারছিল না যে কলাগুলি আসলে ঘরে বাঁদর ঢুকে খেয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত কলা খাওয়ার বদনাম নিজের ঘাড়ে এসে পড়বে, এমন কি তার চাকরি পর্যন্ত যেতে পারে, এমনটা ভেবে সে অভিনয় করে দেখাল, সে নিজে দু-তিন বার নিচে থেকে ঝোলানো কলার ছড়ির কাছে লাফ দিয়ে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে হুপ হুপ বাঁদরের মত শব্দ করে বলল, বাঁদর গপগপিয়ে ইটিং--যাই হোক, সেই ইংরেজ লোকটি  শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা বুঝতে পেরে একটু হেসে ছিল। সে যাত্রা এমনি ভাবে অনেক কষ্টে বাঙালি লোকটা তার চাকরি বজায় রাখতে পেরে ছিল।

এর পরবর্তী সময় থেকেই ইংরেজি শিক্ষার সঙ্গে ইংরেজিয়ানার ঢল নামলো। তা এতই প্রবল ছিল যে ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে ১৫ই সেপ্টেম্বর সমাচার দর্পণ পত্রিকায় এক জন পত্র প্রেরককে নিতান্ত মর্মাহত হয়ে লিখতে হয়েছিল-- প্রেরিত পত্র—‘নীচের লিখিত কয়েক ধারায় প্রদেশীয় কতকগুলি লোকের আছে, ইহাতে তাহাদিগের মন্দ হইতেছে এবং অনেক দীন দুঃখী ও বড় মানুষের বালকেরাও শিখিতেছে। … বিদ্যা গোটা কতক বিলাতি অক্ষর লিখিতে শেখেন আর ইংরেজি কথা প্রায় দুই তিন শত শেখেন: নোটের নাম লোট, বডিগার্ডের নাম বেনিগারদ, লৌরি সাহেবকে বলেন নৌরী সাহেব--এই প্রকার ইংরেজি শিখিয়া সর্বদাই হুট্ গোটেহেল (go to hell), ডোনকের (don’t care) ইত্যাদি বাক্য ব্যবহার করে আর বাংলা তারা প্রায় বলেন না এবং বাঙালি পত্রও লিখেন না, সকলেই ইংরেজি চিঠি লিখেন, তাহার অর্থ তাহারাই বুঝেন। কোন বিদ্বান বাঙালি কিংবা সাহেব লোকের সাধ্য নহে যে সে চিঠি বুঝিতে পারেন।’ 

এর পরে সত্যিকারের ইংরেজি শিক্ষা আসতে দেরী হয়নি। ডেভিড হেয়ারের স্নেহে এবং ডিরোজিও রিচার্ডসনের শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিতের এক দল মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিলেন। এদের মধ্যে তারাচাঁদ চক্রবর্তী, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র, কিশোরীচাঁদ মিত্র, রাধানাথ শিকদার, রামগোপাল ঘোষ, দক্ষিণারঞ্জন মুখুজ্জ্যে, রসিক কৃষ্ণ মল্লিক,হরচন্দ্র ঘোষ, রাজেন্দ্রলাল মিত্র এঁদের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীতে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রাজনারায়ণ, ভূদেব, ভোলানাথ, গৌড় দাস ও রামতনুর দলেরা এলেন। এঁরা শুধু ইংরেজিতে স্বপ্নই দেখলেন না, ইংরেজিয়ানার প্রবল বন্যার আবেগে এবং খানিকটা উশৃঙ্খলতায় জাতীয় সমাজকে ভাসিয়ে দিতে চেয়ে ছিলেন। এমন কি পণ্ডিত বিদ্যাসাগর এবং পণ্ডিত অক্ষয়কুমার দত্ত কিছুটা বৈদেশিক আদর্শের উদাহরণ দেখিয়ে এ দেশের ছেলেদের নীতিকথা শিখিয়ে ছিলেন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে পুরানো যুগের শেষ কবি এবং নতুন যুগের কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত পর্যন্ত সে সময়টা প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে লিখেছিলেন--

“কীরূপ স্নেহ করি, দেশের কুকুর ধরি, 
            বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া।”
আবার এক জায়গায় লিখলেন--
“যে ভাষায় হয়ে প্রীত,পরদেশ গুণগীত,
           বৃদ্ধকালে গান করো মুখে।  
মাতৃসম মাতৃভাষা,পুরালে তোমার আশা, 
          তুমি তার সেবা করো সুখে।” 

No comments