Header Ads

মুক্তির দশক ও এক 'বাঙালী'র স্বপ্নভঙ্গের কাহিনী


বর্ষবরণের রাত এলে অনেকের স্মৃতিতেই ভেসে ওঠে সার্জেন্ট বাপি সেনের কথা, ষোল বছর আগে এক অজ্ঞাত পরিচয় মহিলার সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণ দিয়েছিলেন অকুতোভয় এই সেন, নিজেরই সহকর্মীদের হাতে।


আরও এক সেন প্রাণ দিয়েছিলেন তবে বেঘোরে নয়, রীতিমত পরিকল্পনা করে ..... আজ আর কেউ মনে রাখেনি তাঁকে ! ‌

ঠিক ৫০ বছর আগের কথা, দিনটা ছিল ৩০শে ডিসেম্বর ১৯৭০। কলকাতারই এক বিশ্ববিদ্যালয়ের  উপাচার্যের সেদিন ছিল কাজের মেয়াদের শেষ দিন। অফিসের শেষ ফাইলে সই করে সন্ধে সাড়ে ছ’টা নাগাদ বাড়ি ফিরছিলেন প্রতিদিনের মত হেঁটে লাইব্রেরির পাশে পুকুরপাড় দিয়ে। একটু আগেই রেজিস্ট্রারের গাড়িতে করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

সেই ফেরা অবশ্য আর হয়ে ওঠেনি। অন্ধকারে ওত পেতে ছিল আততায়ীরা, দেখামাত্র ভোজালি রড নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার ওপর। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন আজীবন শিক্ষাব্রতী অকৃতদার মানুষটি। ‌

তার আগেই অবশ্য রাজনৈতিক ফতোয়া দেওয়া হয়েছে ৭০-এর দশকের শুরুতেই - 'বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হোক, পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা বাতিল হোক।' স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক সন্ত্রস্ত, তবে উনি অকুতোভয় ও নারাজ। তাঁর বিবেচনায় পরীক্ষা স্বেচ্ছায় না দেওয়ার স্বাধীনতা সব ছাত্রের আছে, তবে দায়িত্ববান শিক্ষক হিসাবে ইচ্ছুক ছাত্রদের পরীক্ষা নিতে তিনি বাধ্য। ১লা আগস্ট কর্তৃপক্ষ তাঁকে স্বল্পকালীন মেয়াদে উপাচার্য নিযুক্ত করে তাঁর কাঁধেই ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষা নেওয়ার ভার ন্যস্ত করল।

অস্থায়ী এই উপাচার্য কোনও ভাতা নিতেন না গাড়ি ব্যবহার করতেন না, এমনকী উপাচার্যের চেয়ারেও বসতেন না। বসতেন পাশের একটি চেয়ারে। প্রাণনাশের হুমকি পাওয়া সত্ত্বেও তিনি নির্বিঘ্নে পরীক্ষা নিলেন , ফলও ঘোষিত হল যথাসময়ে। 

ইতিমধ্যে পুজোর ছুটি পড়ে গিয়েছে, ছাত্ররা পরীক্ষা পাশের সার্টিফিকেট নেবে কী ভাবে? সমস্যার সমাধান করলেন উপাচার্য নিজে। ঘোষণা করলেন, ছুটিতে ছাত্ররা তাঁর বাড়িতে এসে পরীক্ষা পাশের প্রভিশনাল সার্টিফিকেট নিয়ে যেতে পারে। সেই ছুটিতে সকাল-বিকেল তাঁর বাড়িতে ছাত্রদের ভিড়, উপাচার্য নিজের হাতে বিলি করছেন সার্টিফিকেট। ভদ্রলোকের নাম ডক্টর  গোপালচন্দ্র সেন, বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম যাদবপুর।

মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনি প্রায় দেড় বছর কাজ করেছেন অধ্যাপক বোস্টনের সঙ্গে। বোস্টনকে অনেকেই আমেরিকার ‘প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর পুরোধা মনে করেন, অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি তখন গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা ‘জেনারেল মোটরস’-এর অন্যতম উপদেষ্টা।

প্রোফেসর বোস্টন ক্লাসে এক দিন বিশেষ একটি মডেল বোঝাচ্ছিলেন। গোপালচন্দ্র অনেক ক্ষণ উসখুস করছিলেন,পর দিন সকালে উঠেই শিক্ষকের কাছে। ছাত্রের মনে হয়েছে, অধ্যাপকের গাণিতিক মডেলটি ভুল, অন্য ভাবে করা যায়। বোস্টন মেনে নিলেন সে কথা। ভারতীয় ছাত্রটির মেধায় তিনি তখন চমৎকৃত। মার্কিন গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থাকে জানালেন, তাঁরা যেন অচিরে এই ভারতীয় তরুণের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে কাজে লাগান। জেনারেল মোটরস উপদেষ্টার কথা মেনে নিল।

কিন্তু গোপালচন্দ্রের মাথায় তখন ঘুরছে স্ব-দেশ বলে এক ভৌগোলিক পরিসরের সাবেকি ধারণা, অধীত বিদ্যা স্বদেশি ছাত্রদের শেখাতে হবে। জেনারেল মোটরসের মোটা মাইনের চাকরির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ফিরে এলেন দেশে, মেকানিক্সের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন সদ্য গঠিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরের ক্রমগুলো গতানুগতিক, কোনও ডবল প্রমোশনের গল্প নেই। 

সেদিন ছাত্র দরদী পন্ডিত মানুষটিকে যারা ভোজালি দিয়ে কুপিয়ে খুন করেছিল তারা আর কেউ নয়,অতি বাম ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়েরই একদল  ছাত্র !

শোনা যায় শ্রেণীশত্রু গোপাল সেনকে পিছন থেকে ছুরি মেরেছিলেন যে কমরেড, তিনি নাকি কলকাতার এক বিখ্যাত ডাক্তারের ছেলে স্বভাবতই তাই ধরা পড়েনি বা ধরা হয়নি। রত্নটিকে রাতারাতি পুঁজিবাদের পীঠস্থান আমেরিকাতে পাঠিয়ে দেন ডাক্তার বাবা।

সত্তরের দশকের স্লোগান "বিপ্লব দীর্ঘজীবি  হউক", হয়েছে কিনা জানিনা তবে যাদবপুর নিয়ে এক  'সেন' এর দেখা স্বপ্ন যে বাস্তবায়িত হয়নি তাতে আজ আর কারও  সন্দেহ নেই ! ‌


তথ্য:- আনন্দবাজার পত্রিকা
    

No comments