Header Ads

বাঙালির শার্লক হোমস পঞ্চানন ঘোষাল


উঁহু, বেকার স্ট্রিটে নয়, সাহিত্যসভা বসেছে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের ঘরে। বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিকরা সেখানে হাজির। লম্বা চওড়া চেহারার এক যুবক সেখানে ঢুকে সোজা রবীন্দ্রনাথের কাছে এসে দাঁড়ালেন। গুরুদেব তাঁর পরিচয় জানতে চাইলে জবাব দিলো তিনি জোড়াসাঁকো থানার এক পুলিশ অফিসার। কবি জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি কিছু লেখো টেকো ? উত্তরে বললেন, সামাজিক প্রবন্ধ লিখি। এই তো এ বারের ‘কল্লোল’ পত্রিকাতে ‘নীচের সমাজ’ নামে একটা প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। কবি বললেন, হ্যাঁ লেখাটা পড়েছি বলে মনে হচ্ছে। ভাল হয়েছে। তা তুমি সামাজিক প্রবন্ধ লিখছ কেন? এই বিষয়ে লেখার জন্য তো আমি আছি, শরৎ আছে। পারবে তুমি আমাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে? এবার উনি জিজ্ঞেস করলেন, তা হলে কী লিখব? রবীন্দ্রনাথ বললেন, শোনো, তুমি অপরাধীদের নিয়ে আছো, তাদের বিষয়েই লেখো।


পঞ্চানন ঘোষাল..... পুলিশ ও আইনজীবীদের কাছে পরিচিত হলেও আম বাঙালির কাছে অচেনা একটি নাম। প্রথম ভারতীয় যিনি অপরাধ ও অপরাধীদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে বিজ্ঞান সম্মত প্রবন্ধ লিখেছেন যা আজও আইন পড়ুয়াদের পাঠ্যপুস্তক।

জন্ম নৈহাটির কাছে মাদরাল গ্রামে এক ধনী ও সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে। এনার ঠাকুরদার কাছে ইংরাজি পড়তে আসতেন বঙ্কিমচন্দ্র।‌

মাদরাল গ্রামে প্রায় একশো বিঘে জমির ওপর কালাদিঘি নামে এক বিশাল দিঘি আছে যার উল্লেখ পাওয়া যায় বঙ্কিমের ‘ইন্দিরা’ উপন্যাসে। অনেক আগে থেকেই দিঘি সংলগ্ন গোটা জায়গাটা  ঘোষাল পরিবারের দখলে ছিল। সেখানকার জীর্ণ শিবমন্দিরটি তিনিই সংস্কার করেন। পরে এক ব্যবসায়ীকে দিয়ে মন্দিরের ওপরে একটি অন্নপূর্ণা মন্দির তৈরি করান। কালাদিঘির চার দিকের পাড়ে ডাকাতিয়া কালীমন্দির সহ নানা দেবদেবীর মন্দিরগুলো সংস্কার করে নতুন করে মন্দিরও গড়ে দিয়েছিলেন। এই দিঘির একটা ঘাটে পুরনো বটগাছের তলায় বঙ্কিমচন্দ্র প্রায়ই এসে বসতেন, লিখতেন। জায়গাটিকে সুন্দর করে বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন পঞ্চাননবাবু।

তাঁর পুলিশে আসার ঘটনাটা একদম সিনেমার মতো। তখন ব্রিটিশ আমল, ওনার জ্যাঠামশাই হিরণ্ময় ঘোষাল ছিলেন ভারত সরকারের পক্ষে রুশ এমব্যাসিতে ফার্স্ট সেক্রেটারি। একবার ওনারা দু’ভাই হুগলিতে গিয়েছিলেন  নজরুলের সঙ্গে দেখা করতে। জানতেন না, সেখানে স্পেশাল ব্রাঞ্চ পুলিশের গোপন ওয়াচার মোতায়েন আছে। খবরটা সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্টের কাছে পৌঁছায়। টেগার্ট সাহেব তাদের ডেকে পাঠালেন আর তাদের জ্যাঠামশায়কে ডেকে বললেন, এদের দুজনকে কলকাতার বাইরে যেতে দেবেন না। জ্যাঠামশায় বলেছিলেন এতে কী সমাধান হবে? জবাবে টেগার্ট সাহেব বললেন ‘Put them into police.’ তার পরেই ওনাকে পুলিশ ট্রেনিং স্কুলে যেতে হয়। এর পরে পঞ্চানন নিজের চেষ্টায় পুলিশ সুপার থেকে কলকাতা পুলিশের কমিশনার অব্দি হতে পেরেছিলেন। নানা বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য পেয়েছিলেন অসংখ্য পুরস্কার।‌

কলকাতার বড় বড় ডাকাত-গুন্ডা-বদমাইশরা পঞ্চানন ঘোষালকে চিনতেন ও ভয় পেতেন। বাংলা-বিহার-ওড়িশা-অসমের দুর্ধর্ষ দস্যুসর্দার খোকা গুন্ডাকে তখনও তিনি বাগে আনতে পারেননি। বহু দিন ধরে তাকে ধরার চেষ্টায় ছিলেন। হঠাৎ এক বার সিভিল ড্রেসে তিনি দেওঘর এলেন, একেবারে খোকা গুন্ডার মুখোমুখি!

পঞ্চানন ঝাঁপিয়ে পড়লেন তার ওপর। খোকা তক্ষুনি একটা ধারালো ছুরি বের করে পঞ্চাননের বুকে বসিয়ে দেওয়ার আগেই কয়েক জন লোক খোকার কোমর ধরে ঝুলে পড়ল। কিন্তু খোকা একটা বিকট হুংকার দিয়ে ধাঁই করে এক ঘুসি মারল পঞ্চাননের মুখে। ঠোঁট-মুখ ফেটে রক্তারক্তি অবস্থা। কিন্তু সেটাও তিনি গ্রাহ্য না করে পালটা ঘুসি মারলেন। কিছু ক্ষণ ধস্তাধস্তির পর, পঞ্চানন জিতলেন, খোকাকে হাজতে তুলে আনলেন।‌

বিচারে খোকা গুন্ডার ফাঁসির আদেশ হয়। ফাঁসির দিন জেলে উপস্থিত ছিলেন পঞ্চানন বাবু। 

খোকা বলেছিল, আপনার কাছে আমার একটা শেষ অনুরোধ আছে। শুনেছি আপনি শুধু পুলিশ নন, এক জন ভাল লেখকও। পারবেন, আমার জীবন-ইতিহাস লিখতে? তাঁর হাত দুটো ধরে অনুরোধ করেছিলো, মানুষ তো চোর-ডাকাতের গল্প পড়তে ভালবাসে। ফাঁসির পর‌ আমি আপনার লেখার মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকতে চাই ! ‌

কথা রেখেছিলেন ঘোষাল সাহেব, খুব শিগগির লিখে ফেললেন খোকা গুন্ডার জীবনের নানা কাহিনী। মাঝে মাঝে তাঁর নিজের জীবনের কিছু কাহিনীও এতে যোগ করলেন। দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের মানুষের জীবনকাহিনী একসঙ্গে লেখা হয়ে আছে ‘রক্তনদীর ধারা’ বইয়ের সিরিজে। অপরাধ বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও লিখেছেন অনেক রোমাঞ্চকর উপন্যাস। ১৯৯০ সালে জানুয়ারি মাসে কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলার এই শার্লক হোমস। ‌



       

No comments