Header Ads

রবীন্দ্র সঙ্গীতের মহান অভিভাবিকা সুচিত্রা মিত্রের স্মরণে আজও রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষদের কানে বেজে ওঠে 'যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে।'


প্রখ্যাত কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর সম্বন্ধে এক কবিতায় লেখেন "আকাশ যখন চক্ষু বোজে, তখন যেমন সবাই খোঁজে সুচিত্রা মিত্রকে। তেমন আবার কাটলে আঁধার, সূর্য্য উঠলে ফের আমরা সবাই খোঁজ করি কার? সুচিত্রা মিত্রের। তাঁরই গানের জ্যোৎস্নাজলে ভাসাই জীবনখানি। তাইতো তাঁকে শিল্পী বলে বন্ধু বলে জানি।" সুচিত্রা মিত্র একজন প্রথিতযশা রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী যার কণ্ঠে রবীন্দ্র সঙ্গীত হয়ে উঠেছিল অনন্য। 'না হয় তোমার যা হয়েছে তাই বল', 'মম-মম উপবনে', 'সুখের মাঝে তোমায় দেখেছি', 'শেষ বেলাকার শেষের গানে'র মতো অনবদ্য রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে তিনি অমরত্ব লাভ করেছেন। 


বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন "আমার গান তোমাদের গাইতে হবে, তোমরা আমার গান এমনভাবে করো যাতে মনে হয় ওটা আমারই গান"। গায়িকা সুচিত্রা মিত্র রবীন্দ্রনাথকে কথা দিয়েছিলেন। রবীন্দ্র সঙ্গীতকে তিনি অধিকতর মর্যাদা দান করেছিলেন। গায়ক পঙ্কজ কুমার মল্লিক তাঁকে বিশেষ ভাবে সঙ্গীতচর্চায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। সেকেলে মাত্র একুশ বছর বয়সে তিনি গান রেকর্ড করেন। রবীন্দ্র সঙ্গীতের জন্য তিনি নিজেকে পুরোপুরি ভাবে উৎসর্গ করেন। অগণিত শ্রোতাদের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্র সঙ্গীতের তুলনারহিত প্রতিমূর্তি। সমসাময়িক রসবেত্তা মানুষদের কাছে তিনি বিশেষ সম্মানীয় হয়ে উঠেছিলেন। তাঁকে রবীন্দ্র সঙ্গীতের একজন মহান অভিভাবিকাও বলা যেতে পারে।    
              
রাময়ণের বাংলা অনুবাদক কৃত্তিবাস ওঝার উত্তরপুরুষ বিশিষ্ট লেখক ও অনুবাদক সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় এবং সুবর্ণলতা দেবীর চতুর্থ সন্তান ছিলেন সুচিত্রা মিত্র। বাড়িতে সবাই তাঁকে ডাকতেন গুজা বলে। সঙ্গীতের মাধ্যমে চলমান ব্যক্তি হিসেবে সুচিত্রা মিত্রের জন্ম হয় ট্রেনের মধ্যে। ঝাড়খণ্ডের গুঝাণ্ড রেলস্টেশনে ট্রেনের কামরায় তাঁর জন্ম হয়। কলকাতার হাতিবাগান অঞ্চলে ছিল তাঁদের পৈত্রিক নিবাস। 

সুচিত্রা মিত্র ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী। বিদ্বান্বেষী সুচিত্রা মিত্র পড়াশোনা করেছেন স্কটিশ চার্চ কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড়ো বড়ো প্রতিষ্ঠানে। অল্প বয়সেই রবীন্দ্র সঙ্গীত শিখতে শুরু করেন। পিতা সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিশেষ রবীন্দ্র সঙ্গীত অনুরাগী। তাঁদের বাড়িতে সঙ্গীতের একটা আলাদা পরিবেশ ও আবহ লক্ষ্য করা যেত। বাড়িতে কখনো কখনো তাঁদের গানের আসর, আড্ডা, পসরা বসতো। মায়ের গলায় তাঁর রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে চোখে ভিজে যেত অশ্রুবৃষ্টিতে। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহচর্য লাভ করেছিলেন। শান্তিনিকেতনের সঙ্গীত ভবন থেকে তিনি বৃত্তি লাভ করেছিলেন। 

তেইশ বছর বয়সে ধ্রুব মিত্রের সাথে তাঁর বিবাহ হয়। ছাব্বিশ বছর বয়সে তিনি জন্ম দেন এক পুত্র সন্তানের যিনি বর্তমানে মেরিল্যান্ডের বাসিন্দা। স্বামীর সাথে বিশেষ কারণে তাঁর সম্পর্ক খুব বেশিদিন টেকেনি। মাত্র নয় বছরেই ভেঙে যায় তাঁদের বৈবাহিক সম্পর্ক। কলেজজীবনে তিনি রাজনীতিতে সমৃদ্ধ হয়েছিলেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠণের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মুক্তির আবেদনে তিনি কালো পতাকা নিয়ে রাস্তায় মিছিল করেছেন। টিয়ার গ্যাসের ঝাঁঝকেও তিনি আন্দোলনের মাধ্যমে হার মানিয়েছেন। ৪৬ এর দাঙ্গার বিরুদ্ধেও তাঁকে প্রতিবাদ করতে দেখা গিয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামও তাঁকে মনপ্রাণে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীতকে অস্ত্র হিসেবে বারবার ব্যবহার করেছেন। 

গানের জন্য তিনি যেমন শ্রোতাদের অন্তরে স্থান করেছিলেন তেমনি গান গাওয়ার কারণে তাঁকে সইতে হয়েছে নির্বাসনও। আকাশবাণীতে তিনি প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুকে কটাক্ষ করে বাল্মিকী প্রতিভায় গান গেয়েছিলেন। যার ফলে তাঁকে ছয় বছর আকাশবাণীতে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল৷
তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত নিয়ে গবেষণা করে লিখেছিলেন অসংখ্য গ্রন্থ। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র সঙ্গীত বিভাগের তিনি দীর্ঘদিন প্রধান ছিলেন। ভারতীয় গণনাট্যের সাথেও তিনি নিযুক্ত ছিলেন। বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষের 'দহন' ছবিতে তিনি অভিনয় করেন। সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের জন্য পদ্মশ্রী সম্মানে তিনি ভূষিত হন। ২০১১ সালের ৩ রা জানুয়ারি কলকাতার নিজস্ব বাসভবনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজ তাঁর নবম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি আজ আমাদের মধ্যে সশরীরে জীবিত না থাকলেও জীবিত রয়েছেন গানে-গানে। আজও রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষদের কানে বেজে ওঠে 'যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে।'



No comments